Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

গমের লক্ষ্যমাত্রা ৪ কোটি টন

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দু’দফার প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেও খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশে ৪ কোটি টনেরও বেশি খাদ্যশষ্য উৎপাদনের লক্ষে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ কৃষি যোদ্ধাগণ। গত মে মাসে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘ফনি’ এর আঘাতের পরে ১০ নভেম্বর আরো তীব্রতার ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর আমন ফসলে বিপর্যয় ডেকে আনে। এর সাথে এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ছিলো স্বাভাবিকের চেয়ে কম। আমন বীজতলা তৈরির সময় দেশের আরো কয়েকটি জেলায় অকাল বন্যায়ও আমন আবাদ ব্যাহত করে। কিন্তু এর পরেও ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার টন আমন, ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন বোরো, ৩৩ লাখ টন আউশ ছাড়াও সাড়ে ১২ লাখ টন গম উৎপাদনের লক্ষে কাজ করছে কৃষকগন। তবে চলতি শৈত্যপ্রবাহ বোরো বীজতলার জন্য যথেষ্ঠ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও গমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদগণ।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ধান উৎপাদনে বিশে^ ৪র্থ স্থান লাভ করেছে। তবে আমাদের দেশ এখনো ধানের গড় ফলন ৪.০১ টন। যা চীন, জাপান ও কোরিয়াতে ৫-৬ টনের মতো। ১৯৭০-৭১ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ছিলো ১ কোটি টন। যা ২০০৮-০৯ সালে ৩ কোটি ৩৪ লাখ টনে উন্নীত হয়। বর্তমানে তা সাড়ে ৩ কোটি টনেরও বেশি। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট-ব্রি প্রতিষ্ঠার পরে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগি উফসী ধানের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। ইতোমধ্যে ব্রি ৯২টি উন্নত জাতের ধানবীজ উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৬টি হাইব্রিড, অন্যগুলো ইনব্রিড। বর্তমানে দেশের ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত উ”চ ফলনশীল জাতের ধান আবাদ হয়েছে। ফলে গত ৪ দশকে দেশে ধান উৎপাদনে নিরব বিপ্লব ঘটে গেছে। এমনকি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশে^র প্রায় ২০টি দেশে এখন ব্রি উদ্ভাবিত ধানের আবাদ হয়েছে।
এবার কয়েকটি বিপর্যয় কাটিয়ে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফসল উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হলেও হতাশ হবার মতো কিছু ঘটেনি। সদ্য সমাপ্ত খরিপ-২ মৌসুমে দেশে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার হেক্টরে আমন আবাদ লক্ষ অতিক্রম করে প্রায় ৫৮ লাখ ৯৫ হাজারে আবাদ সম্পন্ন করেন কৃষকগন। তবে বুলবুল এর আঘাতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএই’র মতে ৪ হাজার হেক্টরের আমন ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে উৎপাদন ঘাটতি দাড়াতে পাড়ে ১২-১৫ হাজার টন। তবে বন্যার কারণে আরো কিছুটা উৎপাদন ঘাটতি হয়েছে। এর পরেও আমনে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ অর্জিত হবে বলে আশা করছে ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। গত শনিবার পর্যন্ত দেশের প্রায় ৮৫% জমির আমন কর্তন সম্পন্ন হয়েছে। বুলবুল এর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের যেসব নিচু জমিতে পানি জমে যায়, সেসব জমির ধান কাটা চলছে এখনো। গত বছর দেশে ৫৬ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার টন আমন চাল উৎপাদন হয়। এবার দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭শ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টন আমন উৎপাদন লক্ষ থাকলেও বুলবুল-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জমির কিছু ধানে চিটা হয়েছে। এদিকে আমন ওঠার মধ্যেই সারা দেশে বোরো বীজতলা তৈরি ও রোপনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি রবি মৌসুমে দেশের ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের মাধ্যমে সর্বকালের রেকর্ড ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ নির্ধারণ করছে। গত বছর দেশে বোরো আবাদ লক্ষ অতিক্রম করে ৪৯ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯৬ লাখ টন অতিক্রম করে ২ কোটি ৩ লাখ টনে পৌছে বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে বোরো আবাদ ও উৎপাদন নিশ্চিত করার লক্ষে সুষ্ঠু সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করণের তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। আর এ লক্ষে সেচ কাজে বিদ্যুৎ সরবারহ নির্বিঘœ করা ছাড়াও ডিজেল এর যোগান এবং সার ও বীজের ন্যায্য মূল্যসহ তা সহজলভ্য করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে কৃষিবিদদের তরফ থেকে। এদিকে বিগত খরিপ-১ মৌসুমে দেশে প্রায় সোয়া ১১ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদের মাধ্যমে প্রায় ৩৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ ছিলো। তবে সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় আবাদের সাথে উৎপাদনেও কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তা ৩০ লাখ টনের বেশি হয়েছে বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট স¤প্রতি ‘ব্রি ধান-৮৭’ নামের আরো একটি হাইব্রীড জাতের আমন বীজ উদ্ভাবন করেছে। যার ফলন হেক্টর প্রতি ৬টন বলে জানা গেছে। এটি আমন মৌসুমের আগাম জাত।
ব্রি জানিয়েছে, এ জাত ২০০৮ সালে উদ্ভাবিত আমন জাত ‘ব্রি ধানÑ৪৯’এর চেয়ে সাত দিন আগে ওঠে। পক্ষান্তরে ‘ব্রি-৮৭’র ফলন আগের জাতগুলোর তুলনায় হেক্টর প্রতি এক টন বেশি। এজন্য আমন মৌসুমের আগাম জাত হিসেবে ‘ব্রি ধান-৮৭’ চূড়ান্তভাবে নির্বচিত হয়েছে। এ জাতের ধানের দানা লম্বা ও চিকন। পূর্ণবয়স্ক একটি গাছের গড় উচ্চতা ১২২ সেন্টিমিটার। কাÐ শক্ত বলে গাছ লম্বা হলেও ঢলে পড়ে না। এর পাতা হালকা সবুজ। ধান পাকার সময় কান্ড ও পাতা সবুজ থাকে। পরিপুষ্ট এক হাজার ধানের ওজন ২৪ গ্রামের বেশি। অপরদিকে চলতি রবি মৌসুমে দেশের ৩ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন গম উৎপাদনের লক্ষে কাজ করছে কৃষকগণ। গত বছর দেশে গমের আবাদ ছিলো ৩ লাখ ২৮ হাজার হেক্টরের মত, আর উৎপাদন ছিলো ১১ লাখ ৪৮ হাজার টন। গত কয়েকটি বছর ছত্রাকবাহী ‘বøাস্ট’ রোগের সংক্রমণে দেশে গমের আবাদকে সরকার কিছুটা নিরুৎসাহিত করায় এর সম্প্রসারণ যথেষ্ঠ হোঁচট খেয়েছে।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, ছাত্রাক আক্রান্ত এলাকায় পর পর দু’বছর গমের আবাদ না করলে এ রোগের প্রকোপ কমে আসে। সে হিসেবে ভোলা ও সাতক্ষীরাসহ ৫টি জেলায় গমের আবাদ নিরুৎসাহিত করা হয়। গম শীত প্রধান এলাকার ফসল হলেও আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগন কম তাপ সহনশীল জাতের গম বীজসহ বøাস্ট প্রতিরোধী জাতের গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন। ফলে আমাদের দেশে গম আবাদের সম্ভাবনা খুবই উজ্জল বলে মনে করছেন কৃষিবিদগন। দেশে খুব সহসাই গমে আবাদ ন্যুনতম ৫ লাখ হেক্টরে উন্নীত করার মাধ্যমে উৎপাদনও ২০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবিদগন। সেচ ও বালাই ব্যবস্থাপনা ব্যায় সাশ্রয়ী হবার পাশাপাশি ধানের চেয়ে ভাল দামের কারণে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে গম আবাদে যথেষ্ঠ আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে আবাদ প্রযুক্তিসহ উন্নত বীজ সহজলভ্য না হওয়ায় এর আবাদ সম্প্রসারণ হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ