একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা আগামী ২৬ মার্চ (স্বাধীনতা দিবস) প্রকাশ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি নয়।

গতকাল রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ তালিকা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী বলেন, আমরা প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করেছি। ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধিনতাবিরোধীরা রাজাকার-আল বদর নামে সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করা ছিল আমরা প্রতিশ্রæতি। সংসদেও এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। এরই আলোকে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংরক্ষণাগারে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা দালিলিক প্রমাণাদি রয়েছে, ওই সময়ের সংরক্ষিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা আশানুরূপ সাড়া পাইনি। তবে আমরা আবারও তাদের অনুরোধ করব, জানুয়ারি মাসের মধ্যে সেই সময়ের তথ্যাদি পাঠিয়ে সহযোগিতা করবেন। মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা কোনো তালিকা তৈরি করিনি, প্রকাশ করেছি মাত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা স্বাধীনতাবিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ করে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তৎকালীন বিভিন্ন জেলার রেকর্ড রুম হতে এবং ওই সময়ে বিজি প্রেসে ছাপানো তালিকাও সংগ্রহের প্রচেষ্টা চলছে। যাচাই বাছাই করে ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানান, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের খুবই গুরুত্বপ‚র্ণ অনেক নথি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও অনেক নথি খোয়া গেছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চ‚ড়ান্ত করার কাজ চলছে। এই তালিকা আগামী ২৬ মার্চ প্রকাশ করা হবে। তালিকার প্রাথমিক খসড়া আমাদের কাছে রয়েছে। বর্তমান তথ্যমতে, কোনো না কোনো তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬ জন। এর মধ্যে দাবিদার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জন।
আর বর্তমানে ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ১ হাজার ৪৬১ জন জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জনের নামে একাধিক গেজেট ও অন্য দলিল থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি নয়। একই মুক্তিযোদ্ধার নাম একাধিক গেজেট ও অন্য দলিলে থাকার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তার নিজের নামই ৫টা দলিলে রয়েছে। এছাড়া কারো কারো নাম ১২ বার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তিনি বলেন, ২৬ মার্চের প্রাক্কালে দ্বিতীয় দফা রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। কোনো ব্যক্তি যাতে অযথা তালিকাভুক্ত না হয় সে বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। বেসরকারিভাবে যাদের নাম আসবে তাদের বিষয়ে তদন্ত করে শেষ ধাপে তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রয়োজনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য শোনা হবে।

স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার অধিকার বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কারো ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাকে দেশের মানুষ রায় দিয়েছিল। অনেকেই তা পাঠ (স্বাধীনতার ঘোষণা) করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও বিভিন্ন জনসভায় পাঠ করেছি। তাই বলে কেউ দাবি করতে পারে না যে, তিনি ঘোষক। ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ডাকেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সরকারের হাতে থাকা নথির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর বেতনভোগী ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর প্রথম তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হেফাজতে থাকা দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম তালিকা রোববার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি বাহিনীর সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের সন্ত্রমহানি করেছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী। তখন যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আনসার বাহিনীকে এই বাহিনীতে একীভ‚ত করা হয়েছিল। এরপর গত ২৫ অগাস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহে কাজ শুরু হওয়ার কথা জানানো হয়।

মন্ত্রী বলেন, প্রথম ধাপের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় চিহ্নিত করা হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বেচ্ছায় যারা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন তারাও স্বাধীনতাবিরোধী। এদিকে রাজাকারদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। একাধিক দলিলভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চ‚ড়ান্ত একক তালিকা তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ খসড়া তালিকা উপজেলা থেকে পরীক্ষণ সম্পন্ন করে প্রকাশ করা হবে।