দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বড় বড় আলেমগণ ও পীর-মাশায়েখ এর হাতে চুমু খাওয়া, পায়ে চুমু খাওয়া বিষয়টি সম্পর্কে গবেষক ফকীহ্গণের মাঝে গবেষণাগত কিছু মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। নির্ভরযোগ্য সনদসূত্রের হাদীসসমূহ দ্বারা এবং সাহাবাকিরাম ও পূণ্যবান পূর্বসুরীদের বাণী-বক্তব্য দ্বারা তা জায়েয বলে প্রমাণিত; এমনকি তাঁদের ‘তা‘আমুল’ তথা পরস্পর আচরিত রীতির দ্বারাও তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তবে তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত ব্যতিক্রমী হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দ্বারা তেমন চুমু খাওয়ার নিষেধাজ্ঞাও বোঝা যায়। এ কারণে বিষয়টি গবেষণা-অনুসন্ধানের দাবী রাখে।
হাদীসের বর্ণনাগুলোর সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে, এতদসংক্রান্ত হযরত শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিন্ধী র. এর লিখিত কিতাব ‘আল-কারামাতু ওয়াত-তাকবীলু’ এর গবেষণা-অনুসন্ধানই এ বিষয়টিতে অনেকটা যথার্থ ও যথেষ্ট হতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি ফিকাহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদির অনুসন্ধান ও সমন্বয় তুলে ধরেননি। আর এমন বিবেচনায় তার প্রয়োজনও পড়ে না যে, যেহেতু অনেকগুলো সহীহ হাদীস এবং খোদ মহানবীনবী (স.) ও বিশিষ্ট সাহাবাগণের আমল, জীবন চরিত দ্বারাই বিষয়টি বৈধ মর্মে প্রমাণিত হয়। তাই ফিকাহ-ফাতাওয়াগত প্রমাণের আর প্রয়োজনও থাকে না। তবে গবেষক ফকীহগণের মধ্যে যাঁরা তা নিষেধ করে থাকেন, তার কারণ এমনটি নয় যে, শরীয়তের মূল বিবেচনা মতেই তা নিষেধ ও হারাম; বরং কিছু কিছু মন্দ-অনিষ্টের অনুপ্রবেশের কারণে তাঁরা সেসব মন্দের অনুপ্রবেশ গোড়াতেই যেন বন্ধ হয়ে যায়, এমন লক্ষ্যে হাতে চুমু খাওয়া ও পায়ে চুমু খাওয়াকে নিষেধ করে থাকেন অনেকটা সতর্কতামূলক বিবেচনায়। আমরা প্রথমে এখানে হযরত শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিন্ধী র. এর সংশ্লিষ্ট আরবী গ্রন্থটি থেকে বিষয়টির সার-সংক্ষেপ আলোচনা করছি। তারপর গবেষক ফকীহগণের গবেষণা অভিমত, স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগ আলোচনার প্রয়াস পাব।
হযরত শায়খ সিন্ধী র. এর ১২২৪হি. সনের প্রবন্ধটির সার-সংক্ষেপ
কাউকে চুমু খাওয়া বিষয়টি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। ১) কু-প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে কামনা-বাসনা চরিতার্থের কারণে চুমু খাওয়া। এটা সকল ফকীহ্গণের ঐকমত্যে একমাত্র বিবাহিত স্ত্রী বা খরিদকৃত ক্রীতদাস (যা বর্তমান যুগে অবলুপ্ত) ব্যতীত আর কারও ক্ষেত্রে জায়েয নয়; হোক তা পুরুষ বা নারী এবং হোক তা হাতে চুমু খাওয়া বা মাথায় ও মুখমন্ডল ইত্যাদিতে চুমু খাওয়া। ২) চুমু খাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হয়ে থাকে, দয়া-মায়া ও ¯েœহ-মমতা এর বহিপ্রকাশস্বরূপ; যেমন কোন পিতা-মাতার নিজ সন্তান-সন্ততির মাথা বা মুখমন্ডল ইত্যাদিতে চুমু খাওয়া। ৩) তৃতীয় কারণ হয়ে থাকে সম্মান-মর্যাদা প্রদর্শনার্থে, যেমন আলেমগণ, পীর-মাশায়েখ বা ন্যায়-পরায়ণ বাদশার হাত ইত্যাদিতে চুমু খাওয়া। এর মধ্যে শেষ দু’অবস্থায় চুমু খাওয়া জায়েয এবং তা হাদীস-দলীল, সাহাবাগণের বাণী-বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত।
¯েœহ-মমতাকেন্দ্রিক চুমু খাওয়া: রাসূল স. হযরত হাসান রা. এর দেহে চুমু খেয়েছেন এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. হযরত আয়েশা রা.-কে জ¦রে আক্রান্ত দেখে তাঁর মুখে চুমু দিয়েছেন (আবূ দাউদ শরীফ: খ-২, পৃ. ৭০৯; দারুল ইশাআতিল ইসলামিয়া, কলুটোলা স্ট্রীট, কোলকাতা, তা. বি.)। এ ছাড়া, হযরত রাসূল স. হযরত জা‘ফর ইবন আবূ তালেব রা. এর কপালে চুমু খেয়েছেন (প্রাগুক্ত)। এগুলো হচ্ছে তেমন সব ঘটনা যেক্ষেত্রে বড় হিসাবে, ¯েœহ-মমতার বশে চুমু খাওয়া হয় এবং এতে গবেষক ফকীহগণের গবেষণা মতেও কোন মতানৈক্য নেই।
সম্মানপূর্বক চুমু খাওয়া: শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিন্ধী র. নিজ পুস্তকে লিখেছেন, “সম্মান প্রদর্শনার্থে হাতে চুমু বা পায়ে চুমু কেবল সেসব নেককার আলেম বা ন্যায়-পরায়ণ বাদশার ক্ষেত্রে অথবা তেমন কারও ক্ষেত্রে জায়েয যাঁরা ধর্মীয় বিবেচনায় বিশেষভাবে সম্মান-মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকেন। এঁরা ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রে তা হারাম ও না-জায়েয। কেননা হাদীসের নস্ (হাদীস-সুন্নাহ্র মূল বাণী/দলীল) দ্বারা তার বৈধতা কেবল ধর্মীয় ফযীলত ও ধর্মীয় বিবেচনায় বিশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রেই প্রমাণিত আছে; এঁরা ব্যতীত অন্যদের বেলায় তা প্রমাণিত নয়।
অবশ্য ধর্মীয় ও দীনী জ্ঞান-বিদ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মানের অধিকারীদের হাতে চুমু খাওয়া এমনকি পায়ে চুমু খাওয়াও, হাদীসের শক্তিশালী বর্ণনাসমূহের দ্বারা প্রমাণিত।
সম্মানপূর্বক চুমু খাওয়াসংশ্লিষ্ট হাদীসের বর্ণনাসমূহ:
১। ইমাম আবূ দাউদ র. তাঁর সুনানগ্রন্থে এবং ইমাম বুখারী র. ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ গ্রন্থে হযরত যাবিল রা. সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাসূল স. এর দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরই বর্ণনা, “আমরা যখন মদীনা শরীফে পৌঁছলাম তখন আমরা নিজ নিজ বাহন থেকে দ্রুত অবতরণ করলাম এবং রাসূল স. এর হাত মুবারকে চুমু খেলাম” (প্রাগুক্ত: আবূ দাউদ: পৃ. ৭০৯)।
২। অনুরূপভাবে ইমাম আবূ দাউদ র. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর রা. সূত্রে উক্ত ঘটনা বর্ণনান্তে এই বাক্যÑ
“আমরা রাসূল স. এর খেদমতে পৌঁছে, তাঁর নিকটবর্তী হলাম এবং তাঁর দু’হাতে চুমু খেলাম” Ñলিখেছেন (ইবনু মাজাহ : আদব পর্ব + আবূ দাউদ প্রাগুক্ত)।
৩। একইভাবে ইমাম আবূ দাউদ র. হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, “রাসূল স. যখন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতেন তখন তিনি সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং তাঁর দু’হাতে চুমু খেতেন” (আবূ দাউদ : প্রাগুক্ত)।
৪। একইভাবে ইমাম আবূ দাউদ র. হযরত সাইয়্যেদ ইবন হুসাইন সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি একজন আনসারী সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, “একদিন কয়েকজন লোক বসে পরস্পর বাক্যালাপ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন কিছুটা হাস্যরসে অভ্যস্থ ছিলেন, যিনি তাঁদেরকে হাসাচ্ছিলেন। রাসূল স. তার কোমরে একটি লাঠি দ্বারা খোঁচা দিলেন। তখন লোকটি রাসূল স.-কে বললো, (আপনি আমার কোমরে লাঠি দ্বারা খোঁচা দিয়েছেন, আমি তার বদলা নিতে চাই) আপনি আমাকে তার বদলা নিতে দিন। রাসূল স. বললেন, ‘এসো বদলা নিয়ে নাও!’ সে বলল, আমার দেহে তো জামা ছিল না। খালি দেহে আপনার খোঁচা লেগেছিল, অথচ আপনার দেহে তো জামা বিদ্যমান। এতে তো বিনিময় গ্রহণ পূর্ণ হবে না! রাসূল স. জামা মুবারক কিছুটা উঠিয়ে দিলেন। এতে লোকটি অগ্রসর হয়ে রাসূল স.-কে জড়িয়ে ধরল এবং তাঁর বাহুতে, দু’পাশে চুমু খেতে শুরু করল। আর বলল, ইয়া রাসূল্লাহ্ ! আমার কথা’র উদ্দেশ্য এটিই ছিল” (প্রাগুক্ত)।
৫। তাবারানী র. কা‘ব ইবন মালেক রা. সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, “মহানবী স. যখন তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তখন তিনি রাসূল স. এর হাত মুবারক নিজ হাত দ্বারা ধরলেন এবং তাতে চুমু দিলেন” (ব. হা. জাওয়াহিরুল ফিকাহ: মুফতী শফী র., খ-১, পৃ.১৯০-১৯১)। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।