Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বদর ও পলাশী থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই

প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
আজ বৃহস্পতিবার ২৩ জুন তথা ১৭ রমজান। পলাশীর আ¤্রকাননে, ভাগিরথী নদীর তীরে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে, বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। সেই সূর্য পুনরায় উদিত হয়েছিল একশত নব্বই বছর পর ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে। ’৪৭ এর স্বাধীনতা টেকসই হয়নি; ছিল ভঙ্গুর। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই ছিল দুর্বলতা এবং প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে ছিল আগ্রাসী তৎপরতা। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, জনসংখ্যায় বেশি ছিল বাঙালি এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বেশি করতো পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিগণ ছিল অবহেলা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। ফলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল অপরিহার্য ও অবশ্যম্ভাবী। কেনই-বা বাঙালি স্বাধীনতা হারিয়েছিল এটা জানা প্রয়োজন; তাই পলাশীর যুদ্ধ সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে লিখলাম। আমি ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এটা যেমন সত্য, তার থেকেও পুরানো সত্য হলো এই যে, আমি একজন মুসলমান। মুসলমানদের ইতিহাসে তথা দ্বীন-ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ১৭ রমজান তারিখ অতি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখ, সংঘটিত হয়েছিল বদরের যুদ্ধ। তাই বদরের যুদ্ধ নিয়েও লিখলাম।
পশালীর যুদ্ধ : বাংলাদেশে যেই নদী পদ্মা, ভারতে সেই নদীই গঙ্গা। গঙ্গার একটি শাখা নদীর নাম ভাগিরথী। কলকাতা মহানগরী থেকে ১৫০ কিলোমিটার বা ৯৩ মাইল উত্তরে এবং তখনকার মুর্শিদাবাদ শহরের দক্ষিণে, অবস্থিত ছিল পলাশী নামক একটি গ্রাম, ভাগিরথী নদীর তীরে। বর্তমান ভারতের প্রশাসনিক ম্যাপে, পলাশীর অবস্থান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলায়। ঐ গ্রামটি বিখ্যাত ছিল বিশাল আম বাগানের জন্য। আম বাগান এবং নদীর তীরের মাঝখানে উন্মুক্ত প্রান্তর ছিল; সেটাই পলাশীর প্রান্তর। আজ থেকে পেছনের দিকে দুইশত ঊনষাট বা ষাট বা দুইশত সত্তর বছর আগে ঐ আমলের ভারতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে দুইটি কোম্পানি ছিল। একটির নাম ফরাসী তথা ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অপরটির নাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মোঘল বংশের চতুর্থ স¤্রাট, বাদশাহ জাহাঙ্গীর অনুমতি দিয়েছিলেন ইউরোপীয়গণকে, তৎকালীন ভারতের ভূখ-ে ব্যবসা করার জন্য। ফরাসীগণ, পর্তুগীজগণ এবং ইংরেজগণ ক্রমান্বয়ে তাদের ব্যবসা এবং ব্যবসার ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছিলেন। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণ ক্রমান্বয়ে যেমন ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করা শুরু করছিলেন, তেমনই তারা পরস্পরের মধ্যেও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছিলেন। প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য তারা ছল-বল-কৌশল সবকিছুই সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করছিলেন। সম্পদে ভরপুর, তৎকালীন বাংলা প্রদেশ ছিল ইংরেজদের শীর্ষস্থানীয় লক্ষ্যব”স্তু। অপরপক্ষে, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে, মোঘল সা¤্রাজ্য ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মোঘল সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ হতে স্বাধীন হয়ে উঠছিল। ঐ রকম একটি স্বাধীন প্রদেশ ছিল তৎকালীন বাংলা। তৎকালীন বাংলা বলতে আজকের বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা-বিহার-আসাম ও মেঘালয়। সেই স্বাধীন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন সিরাজ-উদ-দৌলা। তিনি ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন  করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। তিনি বল বা শক্তিতে হারেননি; তিনি পরাজিত হয়েছিলেন ইংরেজদের ছল এবং কৌশলের নিকট; তিনি পরাজিত হয়েছিলেন তাঁরই সঙ্গী আমত্য এবং সেনাপতিবর্গের বিশ্বাসঘাতকতার নিকট। তাই ২৩ জুন তথা পলাশীর যুদ্ধ স্বাধীনতা হারানোর প্রতীক। পলাশীর আ¤্রকাননে বাঙালির স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গিয়েছিল ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে; সেই স্বাধীনতা সূর্য পুনরায় উদিত হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরের বিপ্লব উদ্যানে, এবং ১৭ এপ্রিল তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আ¤্রকাননে (পরিবর্তীত নাম মুজিবনগর)। তাই আজকে এই কলামের একদম শেষাংশে আমরা পলাশীর যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছি।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সৈন্য বাহিনীতে পদাতিক সৈন্যের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের উপরে, অশ্বারোহী ছিল আঠারো হাজারের বেশি। অপরপক্ষে দক্ষিণ থেকে উত্তরে নৌযানে করে এবং নদীর তীর দিয়ে পদব্রজে অগ্রসরমান ইংরেজদের সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা ছিল কমবেশি মাত্র তিন হাজার। এই তিন হাজারের মধ্যে আটশত ছিল ইউরোপীয় সৈন্য। বাকিরা ছিল ভারতীয় ভাড়াটে। এই তিন হাজার বাহিনীর প্রধান ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। নবাবের বাহিনীতে কামান ছিল। কামানের দায়িত্বে নিযুক্ত যারা, তারা কামানের গোলা-বারুদগুলোকে অযতœ করে ইচ্ছাকৃতভাবে। বর্ষাকাল, বৃষ্টি হয়েছিল, বৃষ্টিতে গোলাবারুদ ভিজে যায়। অতএব, কামান ব্যবহার করা যায়নি। এইরূপ পরিপ্রেক্ষিতে, যুদ্ধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বলছেন যে, যুদ্ধ চলাকালে নবাবের পদাতিক বাহিনী যদি শুধু তীর-ধনুক ছুড়তো, তাহলেও ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হতো। কিন্তু টাকার বিনিময়ে, নতুন নতুন গদি পাওয়ার লোভে, বিদ্যমান ব্যবসা রক্ষণাবেক্ষণের লোভে কিছু সংখ্যক সেনাপতি ও আমত্য বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন; তারা অধীনস্ত সৈন্যগণকে সময়োপযোগী আদেশ প্রদান করেননি। আধুনিক যুগে ফুটবল এবং ক্রিকেটে যেমন ম্যাচ ফিক্সিং হয়, তেমনই যুদ্ধ-ফিক্সিং হয়েছিল। এমনভাবে ফিক্সিং হয়েছিল যে, ইংরেজগণ যুদ্ধে জিতে যায়।  
বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন নবাব বাহিনীর সেনাপতি মীর জাফর আলী খান; সংক্ষেপে মীরজাফর। বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে, এই নামটি এখন বাংলায় একটি ঘৃণিত শব্দ। মীরজাফর মানেই বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতায়, গোপন আর্থিক সহযোগী ছিলেন রাজবল্লভ-কৃষ্ণবল্লভ ও উমিচাঁদ নামক বিখ্যাত ব্যবসায়ীগণ এবং মাহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ নামক দুই বিখ্যাত ব্যবসায়ী যাদেরকে যুগলভাবে বলা হয় জগৎশেঠ। জগৎশেঠ-এর মহাজনী কারবার তথা ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা ব্যবসার নামে ইংরেজদের নামে পাচার হয়ে যায় এবং ইংরেজদের কাছ থেকে আসা ঘুষের টাকা স্থানীয়দের নিকট বিতরণ হয়। যুদ্ধের মাঠে, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণায় মীর জাফরের সঙ্গী ছিল ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ সেনাপতিগণ। অপরপক্ষে নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছিলেন মীর মদন, সেনাপতি মোহনলাল এবং কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে নবাবকে সাহায্য করতে আসা ফরাসী সেনাপতি সিন ফ্রে। যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে, যখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন অতি অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর দিকে ছুটে যাওয়ার সময় নবারের সেনাপতি মীর মদন ইংরেজদের প্রত্যক্ষ গুলিতে নিহত হন।
বদরের যুদ্ধ : মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কিংবা বিধর্মীদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম যুদ্ধ। এই যুদ্ধটি ছিল ইতিহাস নির্ধারণকারী একটি যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধে যদি মুসলমানগণ পরাজিত হতেন তাহলে দ্বীন ইসলামের ভাগ্যে কী ছিল কিংবা মহান  আল্লাহকে ডাকার মতো কোনো লোক এই পৃথিবীতে থাকত কিনা তা কেবল সেই মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো জানা ছিল না। শত্রুদের দৃষ্টিতে বদরের যুদ্ধ ছিল সবে মাত্র চারা গজাচ্ছে ঐরূপ নগর রাষ্ট্র মদিনাকে এবং প্রতিষ্ঠাতা মুসলমানগণকে অঙ্কুরেই আল্লাহর জমিন থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের অপর একটি তাৎপর্য হলো দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে রণাঙ্গণের একজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে; বদরের যুদ্ধ দিয়ে সেটা শুরু। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় তাৎপর্য হলো যে মহান আল্লাহ তায়ালা অনেকটাই অদৃশ্যমানভাবে তার প্রিয় বান্দাদের বিপদে কীভাবে সাহায্য করেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যুদ্ধে বিদ্যমান।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পরের কথা। মক্কার কুরাইশগণ চিন্তা করল যে, আমরা তো সকলে মিলে মক্কায় তাকে (মুহাম্মদ সা.) দমন করে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদিনায় গিয়ে তিনি নতুনরূপে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করতে লাগল। অতএব, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই মদিনা এবং মুসলমানগণকে, অঙ্কুরেই বিনাশ করা প্রয়োজন। অপরদিকে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং উনার সাথীরা চিন্তা করলেন যে, আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছি ঠিকই কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহর দ্বীনকে তার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে শত্রুদেরকে মোকাবিলা করার কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া পরোক্ষভাবে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছিল যুদ্ধের প্রুস্তুতি গ্রহণ করার।
মক্কার একটি বাণিজ্য কাফেলা, সিরিয়া থেকে ফেরত আসার পথে, বিপদের আশংকা করছিল। তাদের সাহায্যের নিমিত্তে, মক্কা থেকে আগত সাহায্যকারী দল যখন বদর নামক স্থানে এসে অবস্থান করছিল, তখন তারা সংবাদ পেল মুসলমানগণ তাদের আশেপাশে আছে। আবার মুসলমানগণ বদর নামক স্থানটির কাছেই অবস্থান করেছিল, ফলে তারাও জানতে পারল যে, মক্কা থেকে আগত অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্য বাহিনী তাদের কাছাকাছি অবস্থান করছে। যুদ্ধটি অনিবার্য হয়ে উঠলো। বদর নামক স্থানে কাফেরগণ একদিকে অবস্থান নিল অন্যদিকে মুসলমানগণ অবস্থান নিল। মুলসমান বাহিনী যে স্থানটিতে অবস্থান নিলেন সেখানে একটি পানির কূপ ছিল, তথা জল আহরণের জন্য কুয়ায় সহজে যাওয়া যেত। যেহেতু পানির কূপটি মুসলমানদের দখলে সেহেতু কাফেরগণ পানির সংকট অনুভব করল।  
যুদ্ধের ক্ষেত্রটির অবস্থান এবং পরিবেশের বর্ণানা দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। যে স্থানটিতে মুসলমানরা অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যেরে তেজ সরাসারি তাদের মুখের ওপরে পতিত হয়। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনের বেলায় সূর্যেরে আলো পড়ে না। মুসলমানরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম যা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অপরদিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি উপযুক্ত। কিন্তু অবস্থান নেওয়ার ফলে অবশেষে কী হলো? পাঠক মনে করুন আমরা সবাই সেই রাত্রিতে অবস্থান করছি! রমজান মাসের ষোলো তারিখ দিনটি শেষ মাগরিবের পর তারিখ বদলে গেল অতঃপর সতেরো রমজান শুররু হলো। সেই রাতে উৎকণ্ঠিত মুসলমানগণ এবং উৎকণ্ঠিত কাফেরগণ নিজ নিজ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। সেই রাতে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট সেজদায় পড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)। কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন অনেকটা এরকম: “হে দয়াময় আল্লাহ, আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য ছাড়া বিজয় লাভ করতে পারব না আর আমরা যদি পরাজিত হই হয়তো তোমাকে সেজদা করার কিংবা তোমার নাম ধরে ডাকার লোক এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে পারে। অতঃপর তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর কী করবে; কারণ তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাব। আমরা আমাদের জীবন তোমার পথে উৎসর্গ করলাম। বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে আমরা তোমার জামিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তুমি আমাদেরকে বিজয় দান করো। আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই”। রাসূল (সা.) এর আন্তরিক আকুতি-মিনতি মহান আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গেল। হযরত জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব এলো, সাহায্য আসবে তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও তোমাদের শিরকে উঁচু কর এবং দৃৃঢ় পদক্ষেপে দাঁড়াও।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে, মহান আল্লাহ তায়ালা ঐশী-সাহায্য সম্পর্কিত ঘোষণা দিয়েছেন। ওই রাতে মরুভূমিতে প্রবল বৃষ্টি হলো। যেটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। বৃষ্টি মুসলমানদের উপকারে লাগল। বৃষ্টির কারণে কাফেরদের যুদ্ধের মাঠের শক্ত মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেল। অপরদিকে মুসলমানদের যুদ্ধের বালুর-মাঠ শক্ত বা কমপ্যাক্ট হয়ে গেল। বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া শীতল হলো উৎকন্ঠিত উদ্বিগ্ন মুসলমানগণের চোখে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে প্রশান্তি এসে গেল। অপর একটি ঘটনা যেটি মহান আল্লাহ তায়ালা ঘটিয়েছেন, কাফেরগণ যখন মুসলমানদে ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল ঠিক তখন কাফেরদের চোখে মুসলমানদের ক্যাম্প অনেক বড় মনে হচ্ছিল। তারা চিন্তায় পড়ে গেল এতো মুসলমান কোত্থেকে এলো! অপরপক্ষে মুসলমানগণ যখন কাফেরদের ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল তখন কাফেরদের ক্যাম্প মুসলমানদের চোখে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল এবং তারা ভাবতে লাগল কাফেররাতো তেমন বেশি না আগামী কালকের যুদ্ধে এদেরকে আমরা পরাজিত করতে পারব। অতঃপর এমন মনে হচ্ছিল যে মুসলমানগণের চোখে দেখা দিয়েছিল অন্য এক স্বপ্ন যে আমরা তাদের সমান সমান। আর এই ধরনের চিন্তা চেতনা মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে মুসলমানরা তাদের মনোবল হারিয়ে না ফেলে। অতঃপর দিনের বেলায় যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথমে তিনজন করে উভয় পক্ষ থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে এলেন এবং কাফেরদের তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অতঃপর প্রথা মোতাবেক উন্মুক্ত প্রান্তরে উন্মুক্তভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সেই আমলের যুদ্ধের অস্ত্র হতো তরবারি, তীর-ধনুক, বর্ম, বল্লম ইত্যাদি। মুসলমানগণ প্রাণপন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক পর্যায়ে যুদ্ধ চলাকালে, জিব্রাইল (আ.) এসে মহানবী (সা.)-কে জানালেন যে, হে আল্লাহর রাসূল আপনি আপনার হাতে একমুষ্ঠি ধুলা নিন আর শাহাদাত আঙ্গুল ইশারা করে কাফেরদের দিকে ছুড়ে দিন। রাসূল (সা.) একমুষ্ঠি ধূলা তার হাতে নিলেন এবং শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করলেন। সম্মানিত পাঠককূল বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যের। আমরা চাইলেই, আজকে মাঠে বা বাড়ির উঠানে বা বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, একমুষ্ঠি ধুলা কিংবা বালু হাতে নিয়ে এই কাজটি করতে পারি। বাচ্চারা খেলার মাঠে দুষ্টামিবসত এই কাজটি করে থাকে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয়টি হলো, এশমুষ্ঠি ধুলা যদি কেউ কারো দিকে ছুড়ে দেয়, তাহলে তা কতদূর উড়ে যাবে? অসংখ্য প্রমাণে এসেছে, সেই বদরের মাঠে রাসূলের ছুড়ে দেওয়া ধুলা সেদিন অনেকদূর পর্যন্ত গিয়েছে এবং সকল কাফেরদের চোখে-মুখে-নাকে গিয়ে লেগেছে। এছাড়া পবিত্র কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, হে রাসূল সেদিন সেই ধুলা আমি সকলের চোখে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি কেবল নিক্ষেপ করেছেন। এর কারণ ছিল কাফেররা যেন ভালোভাবে তাদের যুদ্ধের অবস্থান না দেখতে পারে এবং অতি দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, এমনকি বলা হয়েছে তারা তাদের হাতের অস্ত্র ছেড়ে চোখ কচলাতে শুরু করেছিল। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, যদিও আমরা জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলাম ধুলাগুলো রাসূল (সা.) তার হাত দিয়ে ছুড়েছেন কিন্তু এই একমুষ্ঠি ধুলা কীভাবে এতদূরে এবং এতগুলো শত্রুর চোখে গেল? তাই বলতেই হচ্ছে, এটা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সম্ভব নয়, এটা হয়েছে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে; যা স্বয়ং আল্লাহ ঘটিয়েছেন। আর এটাই হলো ঐশী বা গায়েবী সাহায্য।  
এই যুদ্ধের আরেকটি ঘটনা হলো আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে সাহায্য করেছিলেন ফেরেস্তা দিয়ে। বোখারি শরীফের হাদিস মোতাবেক যুদ্ধের শেষে সাহাবিগণ সাক্ষ্য দিয়েছেন কেউ কেউ যে, আমরা সাদা পোশাক পরিহিত কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে য্দ্ধু করতে দেখিছি। তাদেরকে আমরা যুদ্ধের আগে কখনো দেখিনি এমনকি যুদ্ধের পরেও দেখিনি। আবার কিছু সংখ্যক সাহাবি বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখছি না কিন্তু তরবারিটি দেখছি। তাদের তরবারিগুলো আমাদের তরবারিগুলোর চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা এবং সেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল। সেদিন সাদা পোশাক পরিহিত ফেরেস্তাদের আকৃতি কারো চোখে দেখা গিয়েছিল আবার কারো চোখে দেখা যায়নি। মূলত তারা ছিল আল্লাহর প্রেরিত ফেরেস্তা। মুসলমানদের হয়ে বদরের প্রান্তরে তারা যুদ্ধ করেছিলেন।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা আর কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে ছোটখাট মত-পার্থক্য আছে। তবে যে মতামতটি জোরালোভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা এইরকম: মুসলমানগণ ছিলেন ৩১৩ জন অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আওশ গোত্রের আর বাকি ৬৯ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো তিনশত ১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি, আর ঘোড়া ছিল মাত্র দুইটি। অপরপক্ষে কাফেরদের এক হাজারের দলের ছয়শ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম, এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল দুইশটি। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল যে কাফেরদের মধ্যে থেকে ৭০ জন নিহত হয়েছে এবং সত্তর জন বন্দি হয়েছে। অপরপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে থেকে শহিদ হয়েছিলেন ১৪ জন তার মধ্যে ছয়জন ছিলেন মোহাজের সাহাবা অপর আটজন ছিলেন আনসার সাহাবা।
বদরের যুদ্ধ ও পলাশীর যুদ্ধ তথা যুদ্ধগুলোর শত শত বছর পর, আমাদের আশা, ইনকিলাবের পাঠক এবং শুভাকাক্সক্ষীগণ, বদরের এবং পলাশীর সেই অকুতভয় সৈনিকদের স্মরণ করবেন; আলোচনা করবেন। বদরের যুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো, অজাগতিক তথা সকল কিছুর জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা বা তওয়াক্কুল করা। তওয়াক্কুলের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় আমরা বলতে পারি যে, নিজের দ্বারা সম্ভব সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে কিন্তু সাফল্যের জন্য সেই প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করা যাবে না, সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর। পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো, বন্ধুত্ব বা আনুগত্যের ছদ্মাবেশে লুক্কায়িত বিশ্বাসঘাতকগণকে সময়মতো চিনতে হয়; নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা চিনতে দেরি করেছিলেন।
য় লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
িি.িমবহবৎধষরনৎধযরস.পড়স



 

Show all comments
  • আল আমিন ২৩ জুন, ২০১৬, ৩:০৩ এএম says : 2
    এই বিষয় নিয়ে লেখায় মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Rejaul Karim ২৩ জুন, ২০১৬, ৮:৫৫ এএম says : 2
    প্রিয় স্যার দলমত নির্বিশেষ কোরআন কিভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় সে বিষয়ে আমরা আপনার লেখা চাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বদর ও পলাশী থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ