Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাব্রুম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ বন্ধ রাখতে সম্মত ভারত

ফেনী নদী থেকে চুক্তির অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর

ছাগলাইয়া থেকে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৯, ৮:২৮ পিএম

ফেনী নদীর উপর মৈত্রীসেতু-১ এর নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ভারত সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন এ সেতুটির নির্মাণকাজ ২০২০ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এটি নির্মাণ হওয়ার পরই বহু প্রতীক্ষিত রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হবে। বাংলাদেশের ১৫তম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এ স্থলবন্দর চালু হলে দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্য, পর্যটনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে দুই দেশের মানুষ। অন্যদিকে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সেভেন সিস্টারখ্যাত তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ৭টি অনুন্নত রাজ্যের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে দেখছে মৈত্রী সেতুটিকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রামগড়-সাব্রুম স্থল বন্দর চালুর লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ফেনীনদীর উপর মৈত্রী সেতু-১ নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে আগরওয়াল কনস্ট্রাকশন নামে গুজরাটের একটি প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিযুক্ত করে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েস এন্ড ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল) সংস্থাটি। নির্মাণকাজের নিযুক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের দুই লেন বিশিষ্ট এক্সট্রা ডোজড, ক্যাবল স্টেইড আরসিসি মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। রামগড় পৌর এলাকার মহামুনি এবং ভারতের সাব্রুমের নগর পঞ্চায়েতের নবীনপাড়া এলাকায় সীমান্তবর্তী ফেনীনদীর ওপর দ্রুত গতিতে চলছে সেতুর নির্মাণ কাজ।

কর্তব্যরত ভারতীয় প্রকৌশলী মতিউর রহমান সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন, ৬৫ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তিনি জানান, সেতু থেকে ২৪০ মিটার এপ্রোচ রোড নির্মাণ করে রামগড়-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কে সাথে এবং ওপারে সেতু থেকে প্রায় ১২শ মিটার এপ্রোচ রাস্তা নবীনপাড়া-ঠাকুরপল্লী হয়ে সাব্রুম-আগরতলা জাতীয় সড়কে যুক্ত হবে। প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয় করে সেতুটি নির্মাণ করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।

সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অতি দূরত্বের কারণে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই সেদেশের সরকার রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর ও ফেনীনদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রামগড় থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বন্দরকে টার্গেট করেই তাদের এ পরিকল্পনা।

মৈত্রী সেতুর সাব্রুম অংশে নির্মাণ কাজ পরিদর্শনকালে সংবাদ মাধ্যমকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বলেন, ফেনী নদীর উপর নির্মাণাধীন ফেনী ব্রিজ হবে ভারত বাংলাদেশ দু’দেশের বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন। ত্রিপুরা পাবে ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর। এ বন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরাতে অর্ধেক খরচে পৌঁছে যাবে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী। ফেনী ব্রিজই দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের সেতুবন্ধন রচনা করবে। ত্রিপুরার বিরাট সমস্যার সমাধান হবে। ত্রিপুরার উন্নয়নে এখানবাসীর দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন পুরণ করবে ফেনী ব্রিজ।

এদিকে, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সরওয়ার উদ্দিন জানান, মৈত্রী সেতু ও এপ্রোচ রোড নির্মাণের জন্য ২.৮৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়েছে। বন্দরের বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের জন্য ১০একর ভূমিসহ কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, বিজিবি ও পুলিশ চেক পোস্ট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলছে। রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক হিসেবে ঢাকা চট্টগ্রাম মহা সড়কের বারৈয়ারহাট হতে রামগড় পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে জাইকা কাজটি করবে। বর্তমানে এ সড়কে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ করছে জাইকা। চট্টগ্রামের নাজিরহাট হতে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অপরদিকে কাঁটাতারের বেড়ার নকশার ব্যাপারে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের যৌথ সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ত্রিপুরার সাব্রুম সীমান্তে বেড়া নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে সন্মত হয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। মঙ্গলবার সাব্রুম সীমান্তে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফের এক পতাকা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে, দুপক্ষের বৈঠকের পর সীমান্তের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে অতিরিক্ত সৈন্য। সীমান্ত সূত্রে জানাযায়, ২২১৭/৪ আর বি সীমানা পিলার সংলগ্ন রামগড়ের কাশিবাড়ি সীমান্তের ওপারে সাব্রুমের কাঁঠালছড়ির আইল্যামারা নামক এলাকায় ভারত সম্প্রতি কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ শুরু করে। সীমান্তের শূন্য রেখা হতে মাত্র প্রায় ৫০ গজের মধ্যে এ কাজ শুরু করলে বিজিবি এতে বাধা দেয়। কিন্তু বিএসএফ বাধা উপেক্ষা করে কাজ অব্যাহত রাখে। এনিয়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।

এদিকে গত ৫ নভেম্বর বিকেলে ফেনী নদীর উৎসস্থল ফেনীছড়া,তাইন্দং ছড়া এবং আচালং ছড়ার মিলিতস্থান ফেনী নদী পরিদর্শনে করেন ভাষানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ টিম। বিশেষজ্ঞ টিমের অভিযোগ ফেনী নদী থেকে চুক্তির অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের বিরৃপ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর। ফেনী নদী পানির উপর মুহুরী, কহুয়া, কালিদাশ পাহাড়িকাসহ অসংখ্য ছড়া ও খালের অস্বিত্ব নির্ভর করছে। শুস্ক মওসুমে পানি প্রত্যার ও বর্ষাকালে ভারত একতরফা বাংলাদেশে পানি ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টিসহ নানা দূর্যোগের কারণে প্রতিবছর মুহুরী সেচ প্রকল্পের ইরি বোরো আবাদ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ফেনী নদী থেকে চুক্তির পানি বা চুক্তির অতিরিক্ত পানি ভারত প্রত্যাহার করে নিলে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে শুস্ক মওসুমে ইরি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গড়ে ওঠা দেশের ষষ্ট বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় ফেনী নদী, মহুরী-কহুয়া নদীর তীরবর্তী জমিতে শুস্ক মওসুমের আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে । ভারত ফেনী নদীর পানি নিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের ষষ্ঠ মুহুরী সেচ প্রকল্প। ফেনী নদীর পানির উপর চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার কয়েককোটি মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। তীরবর্তী কয়েক লাখ মানুষ ফেনী নদীর পানির উপর প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল । কয়েক হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ফেনী নদী। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কয়েক লাখ মৎস খামার। ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়ার কারণে সমগ্র অঞ্চলে দেখা দিতে পারে মরুময়তা, ধ্বংস হবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশ-পরিবেশ । বন্ধ হয়ে যেতে পারে সাগর মোহনায় মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকার পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। কারণ ফেনী নদীই মুহুরী নদীর ৮০ভাগ পানির উৎস । ভাষা অনুসারী পরিষদের পরিদর্শন টিমের সদস্য গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা বলেন, বন্ধুপ্রতিম ভারতের জনগণের কষ্ট, প্রয়োজনীয়তা এবং মানবিক বিবেচনায় সম্পাদিত ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার চুক্তিকে অশ্রদ্ধাভরে দেখছি না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাম্প দিয়ে পানি তুলে নেয়ার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। কারণ চুক্তিতে যে পরিমান পানি প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পানি অবৈধভাবে নেয়া হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত-বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ