বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল কোরআনের পর দুনিয়ার বিশুদ্ধতম কিতাব হাদীস সংকলন বোখারী শরিফ। এটি একজন অনারবের অনন্য অবদান। তার জন্ম মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানে। পাশে তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, চেচনিয়া ইত্যাদি। পশ্চিমে বাড়তে থাকলে ইউক্রেন, রাশিয়া, চেক ইত্যাদি। সাথে কৃষ্ণ সাগর। যার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো ইতিহাসের আকর। দক্ষিণে পর্বতমালা। নূহ (আ.)-এর কিশতি যে পাহাড়ে গিয়ে ভিড়েছিল সেই জুদী পর্বত। অল্প পশ্চিম উত্তরে সদ্দে সিকান্দরী।
ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্র দখল করে মোট পনেরটি রাষ্ট্র নিয়ে ১৯১৭ সালে গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এলাকাটি ইসলামের আওতায় এনেছিলেন নবী করিম (সা.)-এর চাচাতো ভাই কুসাম ইবনে আব্বাস (রা.)। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে অলৌকিক কারামত প্রদর্শন করে উত্তর বিশ্বের এই বিশাল অঞ্চলটিকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসেন। সাহাবীদের হাতে বিজিত অঞ্চল চিরস্থায়ীভাবে হাতছাড়া হয় না। মাত্র ৭০ বছরের ব্যবধানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। ১৯৯২ সালের মধ্যে ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্র আবার স্বাধীন হয়।
কমিউনিস্ট বিপ্লবের ফলে শত শত বছরের মুসলিম ঐতিহ্য স্থাপনা ও সমাজ ধুলায় মিশে যায়। একসময়ের তুর্কি খেলাফতের অধীনস্থ গোটা এলাকাটি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। কমপক্ষে ৬০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধ হয় ইসলাম, কোরআন, নামাজ, মসজিদ, মাদরাসা, হিজাব ও বোরকা। ইমাম বোখারীর দেশ পরিণত হয় বিধ্বস্ত কবরস্থানে। অস্ত্রের জোরে নয়, মুসলমানদের নিরব মেহনতে আল্লাহর রহমত কার্যকর হয়। ত্যাগ কোরবানি কাজে লাগে। কমিউনিস্টদের হাতে শহীদ জনৈক হায়দারের পুত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি মিখাইল গর্বাচেভ নিজেই কমিউনিস্টদের স্বর্গ ভেঙে টুকরো টুকরো করে মাটির সমতলে নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে ইসলামের নিদর্শন স্পষ্ট হতে থাকে। মরা গাঙে জোয়ার আসার মতোই নতুন করে জেগে ওঠে মুসলিম মধ্য এশিয়া।
ধ্বংসপ্রাপ্ত মীরে আরব মাদরাসা, ইমাম বোখারীর নিজ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. আরবদের সমন্বয়ে ট্রাস্ট গঠন করে পুনঃনির্মাণ ও চালু করেন। শত শত প্রতিষ্ঠান নতুন করে সুসজ্জিত হয়। কাছেই নকশবন্দ। প্রায় বছরখানেক যাবৎ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের আসা যাওয়া বাড়ছে। মাস দু’য়েক আগে ইমাম বোখারী কমপ্লেক্সে আল্লামা মুফতি তকী উসমানী গিয়েছিলেন। ইমাম বোখারীর জায়গাটিতে বোখারী শরিফ কিছু অংশ তেলাওয়াত করেছেন। গত মাসে দেওবন্দের দুই বড় মুহাদ্দিস সেখানে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছেন।
হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রহ.)-এর ওফাত ৭০০ বার্ষিকী উপলক্ষে দুনিয়াব্যাপী সাড়া পড়েছে। দলে দলে আলেমরা উজবেকিস্তান আসা-যাওয়া করছেন। এবার ১৮টি ভাষায় বোখারী শরিফ অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন হবে। একদিনের প্রোগ্রামে অভাজনকে চিফ গেস্ট করা হয়েছে। সেখানে দুনিয়ার অন্য অনেক মনীষীর সাথে তাদের তুলনায় এই শিক্ষার্থীর ছবিসহ পোস্টার প্ল্যাকার্ড ফেস্টুনও ঝুলছে। বোখারী শরিফের একটি সবকও তার জিম্মায় সঁপে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে নানা স্কুল অব থটের প্রায় ৮০ জন এবার যাচ্ছেন। রয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব মাওলানা শাব্বীর আহমাদ মোমতাজীর নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের একটি প্রতিনিধিদল। এতে আছেন, মাওলানা আ খ ম আবু বকর সিদ্দিক, ড. মো. ইদ্রিস খান, মাওলানা নুরুল ইসলাম, মাওলানা আনসার উল্লাহ, মাওলানা নোমান আহমাদ প্রমুখ। বোখারার সে মিলন মেলায়, তিরমিজের পুণ্যভূমিতে, নকশবন্দের আনন্দ ভুবনে ৮৩টি দেশের যত মানুষ কেউই আমাদের কাছে পর নন। যেমন বাংলাদেশীরা তেমনই মরক্কোর রাবাত থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের বোখারী ও নকশবন্দী প্রেমী সব লোক। শুধু তাই নয়, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এমন অঞ্চল নেই, যেখানে বোখারী শরিফ পৌঁছেনি আর সেখান থেকে লোক আসবে না। আর নকশবন্দী তরীকা তো মোজাদ্দেদী রূপরেখাসহ গোটা পৃথিবীতেই জড়িয়ে আছে, বিশ্বনবী (সা.)-এর বিশ্বাস চেতনা মমতা নৈতিকতা মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রেষ্ঠতম জীবন চেতনার ধারক হয়ে।
আজ সকালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের তাশখন্দগামী ফ্লাইটটি যখন ট্রানজিট নেয়ার জন্য ঢাকা থেকে দুবাইয়ের পথে উড়তে শুরু করবে, তখন আমার চোখে একটি অদেখা সেতুবন্ধ ধরা পড়বে। আমি দেখব, ৭০০ বছর আগে নকশবন্দী পীর জাহাঙ্গীর সিমনানী পারস্য থেকে বাংলার রাজধানীতে আখি সিরাজ, আলাউদ্দিন আলাওল হক, নূর কুতবে আলমদের নির্মাণ করেছিলেন, যাদের হাতে তৈরি মুসলমানের এই বাংলাদেশ। ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি ও মানবতার মসলায় যে বাংলাদেশ তারা তৈরি করে গেছেন। ইয়ামেন থেকে তুরস্কের কোনিয়া হয়ে বাগদাদ, এরপর লাহোর মুলতান দিল্লি গৌড় সোনারগাঁও পাড়ি দিয়ে জীবনের শেষ ধাপে যিনি বাংলাকেই নিজের ঠিকানা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। হযরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদেরই ভক্ত কিছু লোক ছুটে চলেছি ইমাম বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রহ.)-এর দেশে। ইমাম মোহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বোখারীর শহরে। শত সহস্র জ্ঞানী দার্শনিক লেখক কবি ও আধ্যাত্মিক মনীষীর স্মৃতিবিজড়িত বোখারা-সমরকন্দের পথে পথে একটু ঘুরব বলে। কিছুই তো শেষ হয়ে যায় না। সেখানে গিয়ে আমরা হয়তো অতীতকে খুঁজে পাবো। সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের অতীত। হযরত শাহ জালালের পুণ্য স্বদেশ থেকে বাহাউদ্দিন নকশবন্দীর মাতৃভূমিতে। সেতুবন্ধনটি যেমন আলোয় নির্মিত, তেমনই আমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া বিষয়গুলোও ভক্তি প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা প্রজ্ঞা ও পাঠের।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।