Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিধন কাজের গতি কমিয়েছে

কমেছে এডিস মশা বেড়েছে কিউলেক্স

সায়ীদ আবদুল মালিক : | প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম


রাজধানীতে এডিস মশা কিছুটা কমে এলেও বেড়েছে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণা। এডিস মশার পাশাপাশি এখন কিউলেক্স মশাও নানা রোগ ছড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এডিস বা ডেঙ্গু নিয়ে ভাবলেই চলবে না, কিউলেক্স নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ কিউলেক্স থেকেও জাপানিজ এনসেফালাইটিসের মতো মারাত্মক রোগ হয়ে থাকে, যা কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, শহরে এডিস ইজিপটাই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। স¤প্রতি জানা গেছে, এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত¡বিদরা বলছেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, গোদ, জাপানিজ এনকেফালাইটিসসহ আরো অনেক রোগের বাহক মশা। হেমন্তের শুরুতেই শীত পড়তে শুরু করে। এসময় রাজধানীসহ সারা দেশেই মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমলেও এটা এখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এডিসের আতঙ্ক শেষ না হতেই এখন শুরু হয়েছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব ও এই মশা বাহিত নানা রোগের প্রদুর্ভাব।

অ্যানোফিলিস, এডিস ও কিউলেক্স এ তিন ধরনের মশা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। এদের চেনার উপায় হল, অ্যানোফিলিস মশা লেজের দিকটি উঁচু করে বসে। এডিস ও কিউলেক্স মশা লেজের দিকটি উঁচু না করে বসার স্থানের সঙ্গে তাদের শরীরকে মোটামুটি সমান্তরাল করে রাখে। এডিস মশার পায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা থাকে। এডিস মশা দিনের বেলাতেও কামড়ায়। প্রতিবছর অনেক মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চলতি বছরে এডিস মশার কামড়ে মারা গেছে সরকারি হিসেবে শতাধিক আর বেসরকারি হিসেসে ২৪০ জন। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে হাজারো মানুষ।

অ্যানোফিলিস মশা পুকুরের বা খেতখামারের পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে। এডিস মশা ডিম পাড়ে গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ছাদের ওপরে বা বারান্দায় থাকা ফুলের টব, পরিত্যক্ত নারকেলের মালা, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে জমে থাকা অল্প পরিমাণ পরিষ্কার পানিতে। আর কিউলেক্স মশা ডিম পাড়ে বদ্ধ নোংরা পানিতে (যেমন, বদ্ধ ড্রেনের নোংরা পানি)। মশার ডিম থেকে পরিণত মশা হতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। পরিণত মশা মোটামুটি এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। কামড় দিয়ে অসুস্থ মানুষের রক্ত চুষে নেওয়ার সময় রক্তে থাকা জীবাণুগুলোও মশার পেটে প্রবেশ করে। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই জীবাণুগুলো সংখ্যায় বেড়ে মশার লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করে। তখন এই মশা অন্য কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে মশার লালায় থাকা জীবাণুগুলো সুস্থ মানুষের রক্তে প্রবেশ করে। মশা নানান রোগের বাহক। কিউলেক্স মশা ছড়ায় ‘ফাইলেরিয়া’ বা গোদরোগসহ নানা রোগ ব্যাধি।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেই নতুন করে মশার উপদ্রব দেখা দিয়েছে। কয়েকটি এলাকার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু দিন আগে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের যেভাবে দেখা যেত এখন আর তাদের সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, এখন সন্ধ্যা হলে ঘরে বাইরে কোথায়ও একটু শান্তিতে বসতে পারি না। মশা এতটাই বেড়েছে যে এক মিনিটের জন্যও বসে থাকা যায় না। আসলে সিটি কর্পোরেশন লোক দেখানোর জন্য কিছু কাজ করেছিল। এখন আর তাদের খোঁজ নেই। একই অবস্থা কাঁঠালবাগান এলাকায়। কাঠালবাগানের বাসিন্দা সামছুল হক বলেন, গত ১৫ দিন সিটি কর্পোরেশনের কোন মশক নিধনকর্মীকে দেখি নাই। সিটি কর্পোরেশন কি কোনো কাজ করে? কয়েকদিন লোক দেখানোর জন্য কিছু কাজ করেছিল। তিনি বলেন, রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোন ভুমিকা আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা মানুষ নিজের প্রয়োজনে সচেতন হওয়ার কারণেই কমেছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন যে ড্রেন পরিষ্কার করবে, শহর পরিষ্কার রাখবে সেই কাজই তো করে না। তারা আবার মশা মারবে কিভাবে বলেও মন্তব্য করেন?

দুই সিটি কর্পোরেশন যে মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে তাও স্বীকার করেছেন ঢাকার একজন মেয়র। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমি একমত মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের কাজ কিছুটা ধীরগতির হয়েছে। তবে আমরা বসে নেই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্প চ‚ড়ান্ত করেছি। সেই প্রকল্প অনুমোদন হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ মেয়াদী কাজ হবে। তিনি বলেন, শহরের ডেঙ্গু কমে এসেছে, তবে দেশব্যাপী এর প্রাদুর্ভাব এখনও শূন্যের পর্যায়ে আসেনি। শহরে শীতের মধ্যে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়ে যায়, যদিও এটা প্রাণঘাতী কোন মশা নয়। কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের চলমান কার্যক্রম কিছুটা ধীর হয়েছে, এ বিষয়ে আমি একমত। তাই মন্থর গতিটা কাটিয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
অন্যদিকে মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সবশেষ অবস্থা জানাতে গত বুধবার ডিএনসিসির নগর ভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন মেয়র মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম। সেখানে মশক নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কার্যক্রম ও বছরব্যাপী পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন তিনি।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মশা নিধনে যে আয়োজন ছিল তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না চলতি মাসে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে। এদিকে শীতের আগমনী বার্তায় সারা দেশেই মশার উপদ্রবও আবার বেড়ে গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন মশা নিধন কার্যক্রম শিথিল হওয়ার প্রশ্নে বলেন, কার্যক্রম শিথিল হয়নি, এখনো প্রতিদিনই কাজ চলছে। তবে ঘটা করে অভিযান কিছুটা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তিনি বলেন, এখন যেহেতু এডিসের দাপট একটু কম, তাই আমরা কিউলেক্স মশার অবস্থা দেখে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে সার্ভে শুরু করেছি। শিগগিরই এর ফলাফল পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ আহম্মেদ বলেন, গত মাসে যেভাবে বহুমুখী অভিযান কিংবা সচেতনতা কার্যক্রম দৃশ্যমান ছিল সেটা কিছুটা শিথিল হয়েছে। তবে মশা নিধনে ওষুধ প্রয়োগ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো মূল যে কাজ, সেগুলো নিয়মিতভাবেই চলছে। আমাদের কীটনাশকও এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, ঢাকায় আমরা সার্ভে করেই দেখেছি শীতকালে মাত্র ১-২ শতাংশ থাকে এডিস মশা, বাকি ৯৮-৯৯ শতাংশই থাকে কিউলেক্স মশা। অন্য সময়ে কিছুটা হেরফের হলেও বেশির ভাগই কিউলেক্সের রাজত্ব বা উৎপাত থাকে। তাই এ মশার ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, প্রথমত, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমলেও এটা এখন একদম বন্ধ হয়ে যাবে তেমনটা ভাবা যাবে না। কম মাত্রায় সারা বছরই চলতে থাকবে। শীতের দিনে তুলনামূলক খুবই কম দেখা যাবে ডেঙ্গু। আবার এডিস মশার উপদ্রবও শীতে কম থাকে। এডিসের সঙ্গে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণাও কম নয়।

কিউলেক্স মশার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে : ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, শুধু এডিস নিয়ে ভাবলে চলবে না, আমাদের কিন্তু কিউলেক্স মশার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এটা থেকেও জাপানিজ এনসেফালাইটিসসহ (জেই) আরো কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। বিশেষ করে আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরেই ‘জেই’ আছে। ফাইলেরিয়াও আছে। এ ছাড়া ওয়েস্টার্ন ভাইরাসও ছড়ায় এই কিউলেক্সের মাধ্যমে। তবে ফাইলেরিয়া এখন মাত্র উত্তরের কয়েকটি এলাকায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘জেই’র ঝুঁকি সব জেলায়ই আছে। তিনি বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত আইইডিসিআরে স্যাম্পল পরীক্ষায় ৪৯ জন ‘জেই’ আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। এর বাইরে আরো রোগী থাকতে পারে। এবারে মৃত্যুর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই। ডেঙ্গুর সঙ্গে ‘জেই’র উপসর্গে অনেকটা মিল আছে, আবার ভিন্নতাও আছে। বিশেষ করে কিউলেক্স মশা পাখি বা কোনো প্রাণীকে কামড়ালে ‘জেই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। সেই মশা মানুষকে কামড়ালে মানুষের মধ্যে তা ছড়ায়। কোনো মানুষ ‘জেই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত ৫-১৫ দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় জ্বর, প্রচÐ মাথা ব্যথা, বমি ভাব, ডায়রিয়া, দুর্বলতা, কাঁপুনি, খিঁচুনি হয়ে থাকে। এমনকি মূত্রাশয়ে সমস্যা, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, কোনো অঙ্গ প্যারালাইজড হওয়ার ঘটনাও ঘটে। মানসিক রোগের ল²ণও দেখা দেয় অনেকের। এ ছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে জাপানিজ এনসেফালাইটিস মারাত্মক হতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের যেমন ঝুঁকি আছে, তেমনি মৃত্যুর ঘটনাও আছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡বিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় সিটি কর্পোরেশন বেশ তৎপর ছিল মশা নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এখন তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। তবে সরকার এবং সিটি কর্পোরেশনের উচিত মশা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া। নয়তো মশা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ