বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
লিয়াকত আলী ভুঁইয়া
দিন বদলের ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। একসময়ের মৃত ক্রিকেটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে গেছেন বিশ্ব দরবারে। তার সরকারের আমলেই বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাত ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টর যেমন এগিয়েছে, তেমনি এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। বাংলাদেশেন ক্রিকেটের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা স্মরণীয়। খেলোয়াড়দের উৎসাহ যোগানোর পাশাপাশি তিনি বরাদ্দ বাড়িয়েছেন ক্রিকেটে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন ক্রীড়া প্রেমী মানুষ তাইতো বাংলাদেশের খেলায় তিনি ছুটে যান খেলার মাঠে। একজন সাধারণ দর্শকের মতো খেলোয়াড় উৎসাহ জাগাতে হাত তালি দেন মাঠে বসে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) সহযোগী সদস্যে পরিণত হয় ১৯৭৭ সালে। সর্বপ্রথম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে। সেবারের টুর্নামেন্টে চার ম্যাচের দু’টিতে তারা হেরে যায় এবং দু’টিতে জয়লাভ করে। এর সাত বছর পর ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ এশিয়া কাপে ক্রিকেটে তারা তাদের সর্বপ্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটি খেলে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতে এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। বিশ্বকাপে তারা পাকিস্তান এবং স্কটল্যান্ডকে পরাজিত করে।
১৯৯৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইসিসি ওয়ানডে খেলুড়ে দেশ হিসেবে ওয়ানডে খেলে আসছে। ২০০০ সালের ২৬ জুন তারা দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে আইসিসি’র সদস্যপদ লাভ করে। আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে। এটাই ছিল বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। ভয়াবহ বন্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আয়োজক হিসেবে সফলতার পরিচয় দেয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পর বাংলাদেশ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম জয়ের দেখা পায় ১৯৯৮ সালে। দীর্ঘ ২২ খেলায় হারের পর মো. রফিকের অসাধারণ নৈপুণ্যে (৭৭ রান ও ৩টি উইকেট) কেনিয়ার বিপক্ষে ভারতে অনুষ্ঠিত খেলায় বাংলাদেশ এই জয়লাভ করে। আতহার আলী খান মোহাম্মদ রফিক জুটি ১৩৭ রান গড়েছিল। আতহার আলী খান করেন ৪৭ রান। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে আইসিসি নক-আউট ট্রফি আয়োজন করে বাংলাদেশ যেখানে সকল টেস্ট খেলুড়ে দল এই একদিনের আন্তর্জাতিক নক-আউট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জেতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার নিয়মিত সদস্য পদ লাভ করে। প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। দলের অসাধারণ ফিল্ডিং এবং খালেদ মাহমুদের ব্যক্তিগত বোলিং (৩/৩১) নৈপুণ্যে বাংলাদেশ ১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানকে ৬২ রানে পরাজিত করে। ম্যাচ সেরা বিবেচিত হন খালেদ মাহমুদ। স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে হারানোর পরও বাংলাদেশ বিশ্বকাপের পরবর্তী রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই জয় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক টেস্ট দলের সদস্য হতে সহায়তা করে।
২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নাইমুর রহমানের অধিনায়কত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট অঙ্গনে পা রাখে। ভারতের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি (১৪৫) করে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান ও জিম্বাবুয়ের ডেভিড হটনের পাশে নাম লেখান আমিনুল ইসলাম। অধিনায়ক নাইমুর রহমানের ১৩২ রানে ৬ উইকেট অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে কোনো বোলারের সেরা বোলিং। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ ৯ উইকেটে হেরে যায়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোর এসএসসিতে অভিষেক টেস্টে ১৭ বছর ৬১ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েন মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচি টেস্টে প্রথমবারের মতো প্রথম ইনিংসে লিড নেয় বাংলাদেশ। মুলতানে তৃতীয় ও শেষ টেস্টে জিততে জিততে ১ উইকেটে হেরে বসে তারা। এই সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হ্যাট্রিক করে অলোক কাপালি। টানা ২১ টেস্ট হারার পর হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে ২য় টেস্টে ড্র করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ যদিও খারাপ আবহাওয়ার কারণে ৩দিন খেলা বন্ধ থাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৪ সালে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে তিন ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরির কল্যাণে প্রথম নিজেদের কৃতিত্বে ড্র করে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে হাবিবুল বাশার ও মোহাম্মদ রফিকের পর দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন খালেদ মাসুদ। চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ ২০০৫ সালে। ম্যাচ সেরা হন এনামুল হক জুনিয়র। সিরিজের অপর টেস্টটিও অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে প্রথম ইনিংসে ১৫৮ রানের লিড নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েও শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩ উইকেটে পরাজয় হয় বাংলাদেশের। ২০০৯ সালে দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয় বাংলাদেশের।
অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। এক সময় বলা হতো, ক্রিকেটে আমরা মাঝেমধ্যে জয় পাই, পরাজয়টাই স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু এখন ক্রিকেটের দিন বদল হয়েছে। আমরা দেশের মাটিতে সর্বশেষ ১০টি ওডিআই-এর সকল ম্যাচেই জয় পেয়েছি। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে দেশের বাইরে সর্বশেষ পরাজয়টিও ছিল বিতর্কিত, সেখানেও জয় আসতেও পারত।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়ানডে-তে বাংলাদেশের র্যাংকিংয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। পাকিস্তানকে টপকে ৯ নম্বর থেকে ৮ নম্বরে উঠে আসে। পরবর্তীতে আইসিসি ওডিআই র্যাংকিংয়ে অষ্টম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ সমান পয়েন্ট নিয়ে ৭ নম্বরে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টপকে গেল।
২০১৫ সাল ছিলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য স্মরণীয় বছর। এ বছর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ (৩-০) করার মধ্যে দিয়ে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের সাফল্যযাত্রা শুরু হয়। টেস্টে হারলে এক ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজটি জিতে নেয় বাংলাদেশ। সেবছরেই ঘরের মাটিতে দ্বিতীয় সাফল্যটি এসেছে ভারতের বিপক্ষে। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ বাংলাদেশ জিতে নেয় ২-১ ব্যবধানে। ২০১৫ পাকিস্তান, ভারতের পর টাইগারদের তৃতীয় শিকার দক্ষিণ আফ্রিকা। জুলাইয়ে ঘরের মাটিতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে পিছিয়ে থেকেও ২-১ ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ।
এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান সান রাইজার্স হায়দারাবাদের হয়ে আইপিএল খেলে সারা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু আইপিএল নয় মুস্তাফিজ অভিষেক ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে বিস্মিত করেছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে তেমনি দ্বিতীয় বিস্ময় ছিল আইসিসি একাদশে তার স্থান পাওয়া। এবার তৃতীয় বিস্ময় দেখালো সেই মুস্তাফিজই। বাংলাদেশ দলের নির্ভরযোগ্য সব খেলোয়াড় যেমন মুশফিকুর রহিম, তামিন ইকবাল, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদ আইপিএল নিলামে অবিক্রিত থাকলেও মুস্তাফিজকে বেইজ প্রাইজমানি ৫০ লাখ রুপি থেকে ডাকতে ডাকতে এককোটি ৪০ লাখ রুপিতে কিনে নেয় হায়দারাবাদ সানরাইজার্স। অর্থাৎ বেইজ মানির চেয়ে ৯০ লাখ রুপি বেশি।
আজকাল যে টি-২০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় তারই গোড়াপত্তন করেছিল আইপিএল। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ। সেই আদলেই বাংলাদেশে বিপিএল, পাকিস্তানে পিপিএল যেখানে খেলতে গেছে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম প্রমুখ সেরা খেলোয়াড়রা। প্রায় দেড়শ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতে অসংখ্য খেলোয়াড় থাকার পরেও বাংলাদেশের মুস্তাফিজকে নিয়ে হায়দারাবাদ সানরাইজার্স ও রয়েল চ্যালেজ্ঞার বেঙ্গালুরুর মধ্যে ডাকাডাকিতে বেইজ মানির দ্বিগুণের উপরেও ৪০ লাখ রুপি বেশিতে কিনে নেয়া তার প্রতিভারই বিকাশ বলে আমরা মনে করি। শুধু বাংলাদেশিরাই না বিদেশিরাও এখন বাংলাদেশ কে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলে। সারাদেশের ক্রিকেটপ্রেমি মানুষদের সাথে আমারও প্রত্যাশা বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তাদের প্রতিভা দিয়েই নিজেরাই যেমনি টিকে থাকবে তেমনি দেশেরও মুখোজ্বল করবে।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) রিহ্যাব, জেনারেল বডি মেম্বার, এফবিসিসিআই
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।