Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষার মান : মান নির্ণয়ের অংক নয়

প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. ইশা মোহাম্মদ
সেদিন শিক্ষামন্ত্রী বললেন, শিক্ষিতের সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। শিক্ষায় সংখ্যাগত দিক দিয়ে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এখন শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশব্যাপী শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। আগামীতে অসংখ্য শিক্ষকের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আশা করা যায়, শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষার মানের অধঃগতি কি কেবলমাত্র শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবের কারণেই? অসংখ্য কারণ আছে শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পেছনে। পাকিস্তান আমলে শুনতাম, ব্রিটিশ আমলে শিক্ষার মান ভালো ছিল। বাংলাদেশ আমলে শুনি, পাকিস্তান আমলে শিক্ষার মান ভালো ছিল। কেন এত কথা শুনতে হচ্ছে? কারণ একটাই। সত্যি সত্যিই শিক্ষার মানমর্যাদা বলে আর কিছুই নেই। বলা হয়, শিক্ষকের মান নেই বলেই শিক্ষারও মান নেই। শিক্ষকের মান নেই কেন? না, তাদের দারিদ্র্যই তাদের অপমান করছে। এই দারিদ্র্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তারা বিবেক বর্জিত উপায়ে টাকা-পয়সা কামাই করছেন। শিক্ষার মান বজায় রাখার জন্য যে কর্তব্য নিষ্ঠার অনুশীলন প্রয়োজন তা টাকা-পয়সা ও সম্মান কেনার জন্য দৌড়াদৌড়ি করলে সম্ভব হয় না। বাজার অর্থনীতি সবকিছুই টাকা দিয়ে পরিমাপ করে। যে কারণে সমাজে শিক্ষকরা অবহেলিত নিগৃহীত হচ্ছেন। শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ।
শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ কী? এ প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। শিক্ষকরা, বিশেষ করে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা তাদের মানমর্যাদা এবং চাকরির নিশ্চয়তা বাড়ানোর জন্য ক্যাডার হওয়ার আন্দোলন করেছিল অতীতে। তদানীন্তন সরকার অনেকগুলো ক্যাডার করেছিল সে সময়ে। শিক্ষকরাও ক্যাডারভুক্ত হয়েছিল। তাদের চাকরি পাকা হওয়ার পর থেকে অনেকেই মনে করেন, শিক্ষার মান বাড়েনি, বরং কমেছে। শোনা যায়, অনেক কলেজেই প্রিন্সিপালকেও পাত্তা দেন না ক্যাডার শিক্ষক-কর্মকর্তারা। কারণ তারা জানেন প্রিন্সিপালের কোনো ক্ষমতাই নেই। কোনো দায়িত্বহীন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা এখন কার? শিক্ষক-কর্মকর্তা নামে মন্ত্রণালয় তাদের সম্বোধন করে। কোনো শিক্ষকই তাতে লজ্জা বোধ করেন না। কিন্তু জোর গলায় তারা বলেন, আমরা শিক্ষক। কর্মকর্তা নই। আমরা দেশ গড়ার কারিগর। এই যে শিক্ষকরা কর্মকর্তা হয়ে গেল, সেই থেকে তাদের দায়িত্বও হয়ে গেল রুটিন ওয়ার্ক। কর্মচারী-কর্মকর্তারা রুটিন ওয়ার্কেই অভ্যস্ত। তার প্রভাবে প্রভাবিত হলো শিক্ষকরা। ফলে শিক্ষার মান তো গেলই, সাথে গেল শিক্ষকদের মানও।
কদিন আগে পুরান ঢাকার একটি সরকারি কলেজে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটা অনেকটা এরকম। একজন ইংরেজির শিক্ষক, সম্ভবত অধ্যাপকই হবেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরীক্ষা পরিদর্শক হিসেবে আগত একজন শিক্ষককে হাতে পেয়ে দেখে নেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন। কোনো একটি কারণে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের উপরে ক্ষিপ্ত ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পেয়ে তিনি মনের ঝাল ঝাড়ার সময় অসৌজন্যমূলক শব্দাবলীর অপপ্রয়োগ করেছিলেন।
অবাক হওয়ার বিষয়টি হচ্ছে, প্রিন্সিপাল সাহেব সামনেই তার চেয়ারে বসাছিলেন। তিনি ওই শিক্ষককে থামানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন দেখলেন, প্রিন্সিপাল মহোদয় তাকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই করলেন না, তখন দ্রুত ওই কলেজ থেকে বিদায় নেয়ার চিন্তা করতে থাকলেন। পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যখন তাকে বলা হলো, ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় একজন সিনিয়র অধ্যাপক এবং যাকে হাতে পেয়ে দেখে নেয়া হচ্ছে তিনিও তার চাকরিতে যোগদানের বহু আগেই সরকারি কলেজের লেকচারার ছিলেন, তখন প্রিন্সিপাল মহোদয় একটুখানি তৎপরতা দেখিয়ে দু-একটা কথা বললেন মৃদুস্বরে। পরিস্থিতি একসময় শান্ত হলো সম্ভবত এ কারণে যে, এক হাতে তালি আর কত বাজানো যায়। তবে শেষ করার আগে তিনি সগর্বে জানালেন যে, তিনি কাউকে ভয়ও করেন না, কাউকে পরোয়াও করেন না।
বিষয়টির অবতারণা করা হলো এ কারণে যে, সেদিন প্রিন্সিপাল সাহেবকে বড়ই অসহায় মনে হচ্ছিল। এরকম অসহায় অবস্থা অনেক প্রিন্সিপালের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। শিক্ষকদের সমিতি এতই শক্তিশালী যে, কোনো কর্তৃপক্ষ কাউকে কিছুই করতে পারে না। একজনকে ধরলে সবাই হাজির হয়। আর প্রিন্সিপাল সাহেব তো তাদের মতোই একজন ক্যাডার কর্মকর্তা। বাংলাদেশে শিক্ষার মান শেষ হয়ে গেছে ওই কারণে। কেউই বিশ্বাস করবে না যে, ক্যাডার হওয়ার কারণেই শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন না করেই বেতন পান। ক্লাস না নিয়ে অন্যবিধ কাজ করে অর্থ সংগ্রহ করেন। এক কলেজে দেখা গেল কয়েকজন শিক্ষক দল পাকাচ্ছে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পরীক্ষার ডিউটি না দেওয়ার কারণেই তারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করছেন। তাদের কথা হচ্ছে, ক্লাস তো পরেও নেওয়া যাবে কোনো এক সময়। কিন্তু পরীক্ষার ডিউটি তো পরের দিন পাওয়া যাবে না। ডিউটি না পেলে আর্থিক ক্ষতি হয়। বলুন তো, শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার কারণ কী?
আগের দিনে ভালো শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় টিকে যেতেন এ কারণে যে, তারা ভালো পড়াতেন। এখন ভালো পড়ান কিনা তা দেখা হয় না। কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সেটিই দেখা হয়। আর সরকারি কলেজের পদোন্নতির জন্য অতিরিক্ত কোনো যোগ্যতাই লাগে না, কেবলমাত্র বয়স বাড়লেই পদোন্নতি হয়, একেবারেই ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতো। ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য অভিজ্ঞতা লাগে, এসিআর লাগে আর লাগে তেল। শুনেছি কোনো কোনো সময় ‘বেলপাতা’টাও লাগে। শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য কী কী লাগে? কিছুই লাগে না। যে কারণেই হয়তো বা ওই ইংরেজির বড় শিক্ষক যা-তা বলতে পারেন একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে। কেননা, তার হারানোর কিছুই নেই।
শিক্ষার মান মানবেতর পর্যায়ে নেমে গেছে কি ওই কারণে? আমার মনে হয় আরো অনেক কারণ আছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোনো শিক্ষকই সমাজের কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহি করে না। সাধারণ সামাজিক মানুষ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না কোনোভাবেই। বেতন-ভাতাদি দেওয়ার প্রশ্নও নেই। যদিও শিক্ষকরা ওইসব সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের পড়ায়। যারা পড়ে তারা তো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই রাখে না। শোনা যায়, বিদেশের স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েরা যেসব শিক্ষক পড়াতে পারে না তাদেরকে নম্বর দেয়। ওই নম্বরের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষক পরিবর্তন করা হয়। আমাদেও দেশে কেন শিক্ষকদের ব্যাপারে কমিউনিটির মতামত নেওয়া হয় না? মূলত মন্ত্রণালয়ের জাত যাওয়ার ভয়ে। মন্ত্রণালয় নিজেদের মানমর্যাদার ব্যাপারে খুবই সচেতন। তাদের কথা হলো, আমার ছাগল, লেজের দিকে কাটি না গলার দিকে কাটি, তাতে কার কী?
আমলারা কখনই সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তারা যাদেরকে চালান, তাদেরকেও সম্প্রদায়ের কাছে কৈফিয়তযোগ্য করতে চান না। ফলে পদ্ধতিগত কারণেই শিক্ষকরা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ইডেন বিল্ডিং থেকে বের করে নিয়ে আসা। স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন মন্ত্রণালয় হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা। অনেক দেরিতে হলেও বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হয়েছে। তবে প্রকৃত স্বাধীন হতে আরো বহুদিন লাগবে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীন করতে বহুদিন সময় লাগবে না। স্বাধীন শিক্ষা কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পরিচালনা করা হলে ভালো হয়। মন্ত্রী সাধারণ মানুষের মাঝেই অফিস করবেন। তবে সচিব সাহেবরা সাধারণ মানুষের মাঝে অফিস করলে তাদের জাত যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রশাসনে যারা কাজ করবেন, তারা সাধারণ আমলা না হয়ে বিশেষ জাতীয় শিক্ষা আমলা হতে পারেন। আগে যেমন প্রশাসকরা বিচার করতেন, এখন কেবলমাত্র বিচার ক্যাডারের লোকরাই বিচার করবেন, অনেকটা তেমন। শিক্ষা প্রশাসনে লোক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশেষ কমিশন করতে হবে। এখন শিক্ষক ক্যাডারে যেভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া হয় সেটা খুবই ত্রুটিপূর্ণ। বিষয় বিশেষজ্ঞরা নিয়োগ পাবেনই এমন কোনো কথা নেই। যারা চৌকস তারাই নিয়োগ পাবেন।
শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু তা হবে না। কারণ শিক্ষকরা অনেক সংগ্রাম করে ক্যাডার হয়েছে। তারা স্বর্গ ছেড়ে নরকে নামতে নারাজ হবেই।
কমিউনিটির হাতে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিলে মার্জিত রুচির এবং বিনয়ী শিক্ষকরাই শিক্ষকতা করতে পারবেন। অহংকারী এবং দুর্বিনীত লোকজন শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করতেই পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ গরিব দেশ। এখানে সম্প্রদায় শিক্ষক পুষতে পারবে না। পারলেও এখন যে অবস্থা তাতে সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে পারবে। কেননা, শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতি যদি অব্যাহত থাকে তবে কমিউনিটি সম্পদশালী হবেই। তখন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যয় নিজেরাই বহন করতে পারবে। তবে এখন ব্যয়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। বাজেটের বরাদ্দকৃত টাকা কমিউনিটির কাছে ন্যস্ত করা হলে শিক্ষকরা তাদের বেতন-ভাতার জন্য কমিউনিটির দ্বারস্থ হবেন। তাহলেই কেবল উভয়ের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা জনিত দূরত্ব দূর হবে। প্রত্যেক কমিউনিটি তাদের মতো করে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মনিটর করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ। কলেজগুলোকে মনিটর করবে বিশ্ববিদ্যালয়। এখন যেমন আমলাতান্ত্রিক মনিটরিং চলছে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এর চেয়ে মনিটরিং কমিউনিটির ওপরে ছেড়ে দেওয়া যায়। তবে বড় কা-কারখানা হলে ডিসি এসপি তো আছেই। তারা সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় করে অপরাধ ও দুর্র্নীতির বিষয়ে মনিটরিং করতে পারবেন।
বাংলাদেশে চৌষট্টি জেলায় নিদেনপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার কথা। শেখ হাসিনা অনেক আগেই এ ঘোষণা দিয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে কেমন হয়? প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতির বিদ্যা শিক্ষা হলে প্রতিযোগিতা হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। তবে এখন যে ব্যারোমিটার দিয়ে প্রতিযোগিতার পরিমাপ করা হচ্ছে, সে রকম নয়। জাতীয় ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধির হিসাব থাকতে হবে। তোতা পাখি নয়, প্রকৃত শিক্ষিত কিনা সেটা যাচাই করতে হবে। সর্বোপরি তাদের মানবিক গুণাগুণের বিকাশ হয়েছে কিনা তা পরিমাপ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের কোনো পরিমাপ যন্ত্র নেই। যদি মানদ-ের মধ্যে একটি অপরিহার্য শর্ত থাকে ওই কলেজ কতজনকে ‘মানুষ’ করেছে, তবে হয়তো শিক্ষার মান নিয়ে সংশয় দূর হবে।
শিক্ষার মানের সঙ্গে কলেজের শিক্ষকদের মান বিচার কেন করা হবে না? কতজন শিক্ষক কতটি পুস্তক প্রন্ধাদি রচনা করেছেন সেটি কি বিচার করা হয়? অনেক শিক্ষক আছেন যারা গাইড বইয়ের চেয়ে নি¤œমানের পাঠ্যবই লিখে ছেলেমেয়েদেরকে চাপ দিয়ে কিনতে বাধ্য করেছেন। ওইসব শিক্ষকের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে কলেজের মান নির্ণয়ে সেগুলো কি বিচার করা হয়েছে? কখনই এসব বিষয় বিচার করা হয় না। ভুল টেক্সটবই লেখার জন্য কোনো কোনো শিক্ষকের চাকরি যাওয়া উচিত। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, ভুল লেখার কারণে শিক্ষার্থী নম্বর কম পায়। কিন্তু যে বই পড়ে সে ভুল লিখেছে, সে বইয়ের লেখককে ‘নম্বর’ দেওয়া হবে না কেন? এবং ওইসব লেখক যেসব কলেজে ‘চাকরি’ করেন সেসব কলেজকেও কেন ‘নম্বর’ দেওয়া হবে না?
শিক্ষার মান এবং শিক্ষকের মান নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। তা দিয়ে শেষ করি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কলেজের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সময় হয়েছে। সরকারি কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিকমতো পাত্তা দিতে চায় না। যে কারণে শিক্ষার মান উন্নয়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। কলেজের শিক্ষকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতাই নেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। যে কারণে কদাকার পরিস্থিতির উদ্ভব হয় প্রায়ই। এদেরকে নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়ের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তবে কমিউনিটি যদি প্রশাসনিক ক্ষমতা পায় তবে সমস্যা চিরতরে দূরীভূত হবে। শিক্ষা বাণিজ্যও শিক্ষার মানের অধগতির জন্য দায়ী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই মুনাফা সংগ্রহের ফাঁদ। সরকারের বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা কম হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয়ের দায় কার? মন্ত্রণালয় মনিটরিংয়ের কাজ করতে পারে না। জাতীয় শিক্ষা কমিশন হয়তো করতে পারত। কিন্তু ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বন্ধ করার ক্ষমতা কারোরই নেই। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেই যাচ্ছে। এদের দেখাশোনার ভার কমিউনিটির ওপরে ছেড়ে দিলে সাধারণ পাবলিক এদেরকে সোজাপথে চলতে বাধ্য করাতে পারত। যত দিন না তেমন ব্যবস্থা হচ্ছে, ততদিন ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি তত্ত্বাবধায়নে থাকবে। সরকার পুলিশি কায়দায় ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করবে। শিক্ষাবাণিজ্য নৈতিক অপরাধ। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য কেবলই সেবা ধর্ম। এখানে বাণিজ্য চলতেই পারে না। সবচেয়ে ভালো হয়, অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত থেকে রক্ষা করা। একই সাথে সাধারণ মানুষকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা।
একটি জাতীয় শিক্ষানীতি থাকবে। যার আলোকে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব কারিকুলাম করবে। আঞ্চলিক সংস্কৃতির স্বকীয়তা বজায় রেখে তারা তাদের এলাকার শিক্ষার্থীদের মানুষ করবে। তথাকথিত শিক্ষিতরা বেকার হয়, দেশের জন্য আপদ হয়, সম্পদ হয় না। মানুষ হলে অবশ্যই কিছু একটা করে খেতে পারবে। এরা দেশপ্রেমিকও হয়। সব কিছুই নির্ভর করে কারিকুলাম এবং শিক্ষার মানের ওপরে। বইয়ের অভাব হওয়ার কথা নয়। বাঙালিরা বই লিখতে ব্যর্থ হলে বিদেশি বই অনুবাদ করে পড়ানো যায়। তবে শিক্ষা সাহিত্যের জন্য দেশীয় ও উৎকৃষ্ট লেখকদের বই পড়াতে হবে। দেশীয় লেখক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রতিভাবান লেখকদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে, থার্ড ক্লাস লেখকদের দারোগা বাবুর সাথে দেখা করার সুবন্দোবস্ত করতে হবে। যারা ভাবেন বই লিখলে পয়সা পাওয়া যায় এবং ওই কারণে লেখেন, লেখার কোনো যোগ্যতা নেই, তাদের আয়কৃত টাকার সমপরিমাণ টাকা বেতন থেকে কর্তন করে নেওয়া যেতে পারে। এভাবে উৎকৃষ্ট মানের বই বাজারে স্বল্পমূল্যে পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা মন দিয়ে পড়বে। প্রত্যেক মানসম্পন্ন লেখককে অর্থমূল্যে পুরস্কার দিতে হবে। কিন্তু তার আগে নি¤œমানের লেখকদের শ্রম শিবিরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকবে, ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে কিনা?
শিক্ষা খাতে ব্যয় কখনই অপচয় নয়। এটি জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। শিক্ষকদের ভালো বেতন-ভাতাদি দিলে অবশ্যই জাতির উৎকৃষ্ট মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন। ভালো শিক্ষকরা অনেক সময় ভালো বইও লেখেন। বই লেখার ব্যাপারে প্রণোদনা দিলে একসময় দেখা যাবে দেশে আর কোনো বইয়ের অভাব নেই। তবে সারা দেশে একই লেখকের একই বই পড়ানোর অসৎ প্রবণতা প্রতিরোধ করতে হবে। মানুষ মাত্রই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকেরই রুচি ও পছন্দ আলাদা। এ জন্যই পড়ার বইও তাদের পছন্দের লেখকের হতে হবে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বই পড়ে অনেকেই আনন্দ পায় না। লেখাপড়ায় আনন্দ না থাকলে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার ব্যাপারটি উহ্য হয়ে যায়। এরা রেজাল্ট ভালো করলেও এদের শিক্ষা তোতা পাখির শিক্ষার মতো হয় এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সম্পদ না হয়ে আপদ হয়। অথচ তাদের এই পরিণতির জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। সরকারের উচিত হবে প-িতম্মন্য প-িতদের হাত থেকে উদ্ধার করে শিক্ষাকে বাঁচানো, একই সাথে শিক্ষার্থীদেরও বাঁচানো।
শিক্ষার মান নিয়ে কথা। যাদের কারণে মানহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে, তারাই বলছে শিক্ষা শেষ। তাহলে কী করা যায়। শিক্ষাকে স্বাধীন করে প্রতিযোগিতামূলক করেই এই অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচানো যায়। কিন্তু তা কখনই হবে না। কেননা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকবেই এবং ক্যাডার শিক্ষকও থাকবেন। যাদের চাকরি এবং বেতনের নিশ্চয়তা আছে, তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। এই কিম্ভূতকিমাকার শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রকৃত শিক্ষিত তৈরি করা কি সম্ভব? শিক্ষার বর্তমান মান দেখে কি ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পারা যায় না? খোলনলচে পুরোপুরি পাল্টাতে না পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পুরো দেশটাই অশিক্ষিতের দেশ হয়ে যাবে। তখন আর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কেউ থাকবে না। কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাই-ই চায়। সরকার হয়তো তাদের মনস্কামনাই পূরণ করছে। তাই সব কিছুই বৃত্তাবদ্ধ করে রেখেছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষার মান : মান নির্ণয়ের অংক নয়
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ