Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পেঁয়াজ নিয়ে তেলেসমাতি

আমদানি করা পেঁয়াজ দুই দিনের মধ্যে বাজারে পাওয়া যাবে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রঁসুই ঘরের অপরিহার্য মশলা জাতীয় পণ্য পেঁয়াজ নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। এক মাস আগে যে পেঁয়াজ ত্রিশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে; সেই পণ্যে দাম উঠেছে ১৩০ টাকা। কয়েকদিন থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া পণ্যটির একদিনে দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ টাকা। রাজধানীতে ৪৫ স্পটে ৪৫ টাকা কেজি দরে টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করছে। কিন্তু অনেকেই দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। পণ্যটির মূল্য বৃদ্ধি রোধে অভিযানও চালাচ্ছে আইন শৃংখলা বাহিনী। আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি বিদেশী পেঁয়াজের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছে। বাণিজ্য সচিব জাফর আহমদ বলেছেন, বন্দরে নোঙ্গর করা পেঁয়াজ দুই দিনের মধ্যে বাজারে পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হলো বন্দরে নোঙর করা জাহাজের পেঁয়াজ কাস্টম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দুই দিনের মধ্যে ভোক্তাদের রঁসুই ঘরে পৌঁছানো কি সম্ভব? বাণিজ্য সচিব আরো বলেছেন, পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে বাজারে প্রভাব পড়বে না। তাহলে দাম নাড়লো কেন? নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পেঁয়াজ নিয়ে কার্যত চলছে তেলেসমাতি কারবার।

বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েই ভারত রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের বাজারে গত দুদিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম উঠেছে ১৩০ টাকায়। দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। খুচরা বাজারে ১১০ টাকার নিচে পেঁয়াজ নেই।

পেঁয়াজের দাম ঠিক কী কারণে বাড়ছে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার মূলে হাত দেয়া হয়েছে। মূলত সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে পেঁয়াজ। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে খবর পেয়েই অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন দাম। চট্টগ্রমের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা মূলত কমিশনে ব্যবসা করেন। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা রেখেছেন আমদানিকারকরা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন বলছে, ব্যবসায়ীদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কারসাজির হোতা আমদানিকারকদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির হোতা আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ তালিকা পাঠানো হবে।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম মিডিয়াকে জানান, দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে অভিযান চালানো হয়েছে। দেখা গেছে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বেশ কয়েকজন আমদানিকারক। তিনি বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন আমদানিকারকের তথ্য আমরা পেয়েছি। এসব আমদানিকারকের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুর পর্যন্ত খাতুনগঞ্জের আড়তে মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪৮-৫০ টাকা, ভারতের পেঁয়াজ ৫১-৫৫ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এরপর বিকেলে ভারতে পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞার খবর খাতুনগঞ্জের বাজারে পৌঁছার পর হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। সন্ধ্যা নাগাদ পেঁয়াজ বেচাকেনা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর ঢাকার ৩৫টি স্থানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)‘র মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম রাখা হচ্ছে মাত্র ৪৫ টাকা। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে টিসিবি‘র মুখপাত্র হুমায়ন কবির বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পেয়াজ আসছে। ফলে ২/১ দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমে যাবে বলে আশা করছি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর যে ৩৫টি স্থানে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সেগুলো সচিবালয়ের গেইট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, শাহজাহানপুর বাজার, ফকিরাপুল বাজার ও আইডিয়াল জোন, মতিঝিল বক চত্বর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, কাপ্তান বাজার, শান্তিনগর বাজার, মালিবাগ বাজার, বাসাবো বাজার, রামপুরা বনশ্রী, খিলগাঁও তালতলা বাজার, রামপুরা বাজার, সায়েন্সল্যাব মোড়, নিউ মার্কেট/নীলক্ষেত মোড়, ঝিগাতলা মোড়, পলাশী মোড়, শ্যামলী/কল্যাণপুর, খামারবাড়ি ফার্মগেট, রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট, কলমীলতা মোড়, কচুক্ষেত, আগারগাঁও তালতলা ও নির্বাচন কমিশন অফিস। এছাড়াও উত্তরার রাজল²ী কমপ্লেক্স, আশকোনা হাজি ক্যাম্প, মহাখালী কাঁচাবাজার, মিরপুর-১ নম্বর মাজার রোড, মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর, শেওড়াপাড়া বাজার, মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার, দিলকুশা, মাদারটেক নন্দীপাড়া কৃষি ব্যাংকের সামনে ট্রাকে টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।

খোলাবাজারে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ কিনতে ভিড় করছেন ক্রেতাদের। সরেজমিন দেখা গেছে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে শ্রমিক-দিনমজুর ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী আর গৃহিণীরা পেঁয়াজ সংগ্রহ করছেন। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ নিয়ে এসে কেউ কেউ পেঁয়াজের সারিতে দাঁড়িেেছন। আবার স্কুল-মাদরাসা ছুটির পর সন্তানদের হাত ধরেই শামিল হয়েছেন পেঁয়াজ কেনার সেই লাইনে। অনেকেই অফিসের কর্মঘণ্টার কোনো এক ফাঁকে এসেছেন ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ কিনতে। কিন্তু ক্রেতাদের ভিড় আর লম্বা লাইনে ধৈর্যহারা হয়ে অনেকেই খালি হাতে ফিরে গেছেন।

মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে পেঁয়াজের লাইনে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা পেঁয়াজ পেয়েও খুশি নন। তাদের বক্তব্য দীর্ঘ সময় ব্যায় করে মাত্র দুই কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। কমপক্ষ্যে ৫ কেজি হলে ভাল হতো। জলিল নামের এক মাছ ব্যবসায়ী বললেন, মাছের ব্যবসা করি। ব্যবসার ফাঁকেই দুই কেজি পেঁয়াজ কিনতে পালে ক্ষতি কি? সেই জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ভাল না হওয়ায় পেঁয়াজ পেলাম না।

ফার্মগেইটের খামারবাড়ি মোড়ে রাখা টিসিবি পণ্যের ট্রাকে মিরপুর থেকে পেঁয়াজ কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী মো. লিটন। তিনি বলেন, দুই ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও পেঁয়াজ পাইনি। পেঁয়াজসহ ন্যায্যমূল্যে যা দেওয়া হয় সবই কিনব। কারণ বাজারের দামে এখন আর ওসব পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই। লিটনের সামনের দাঁড়ানো বেসরকারি চাকরিজীবী ওয়াহিদুল আলম খান বলেন, দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও লাইনের সামনে অনেক মানুষ। কখন সিরিয়াল পাব জানি না। বাজারে পেঁয়াজের দাম লাগামছাড়া। এখানে কষ্ট হলেও কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। আবার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতাদের সবাই শেষ পর্যন্ত ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ পাবেন কিনা- এমন উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করলেন কয়েকজন।

ইন্দিরা রোডের গৃহিনী আছমিতা। মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে লাইনে দঁড়িয়ে পেঁয়াজ আর তেল কিনেছেন। তিনি বলেন, এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনতে পেরেছি। আমি তো পেলাম। কিন্তু এখনও যারা লাইনে আছে তারা তো পেঁয়াজ পাবেন না। কারণ ট্রাকে করে যা এনেছিল তা বিক্রি শেষ। তেঁজকুনিপাড়ার আরেক গৃহীনি শামসুন্নাহার লাইলি বলেন, দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কিনেছি ২ কেজি। ৫ কেজি দিলে ভালো হতো। ২ কেজি তো কম। এত সময় নষ্ট করে ২ কেজি পেঁয়াজ কেনা অযৌক্তিক। দৈনিক বাংলা মোড়ে পেঁয়াজ কিনতে আসা আবু জাফর বললেন, সরকারের ভুল নীতি এবং ভারতপ্রীতির কারণেই আমাদের এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। বাণিজ্য সচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকলে এতো দাম বাড়লো কেন?

টিসিবির পণ্যের ট্রাকের দায়িত্বে থাকা বিক্রেতারা জানান, কয়েকদিন ধরে প্রত্যেক স্পটে ১ হাজার কেজি করে পেঁয়াজ দেওয়া হয়েছে বিক্রির জন্য। কোথাও কোথাও দেয়া হচ্ছে কম। ফলে এত অল্প পেঁয়াজ বিক্রির জন্য এসে মানুষের কথা শুনতে হয়। ##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পেঁয়াজ

১৩ এপ্রিল, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ