Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধাপ চাষে মিলল বিশ্ব স্বীকৃতি

উথান মন্ডল, নাজিরপুর (পিরোজপুর) থেকে : | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:৫৪ এএম

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বিলাঞ্চল দেউলবাড়ী-দোবরা, কলারদোয়ানিয়া ও মালিখালী ইউনিয়নের জলাভ‚মির বাসিন্দাদের ব্যতিক্রমী উদ্ভাবন ভাসমান বীজতলা ও সবজি চাষ। স্থানীয়দের কাছে যা ধাপ চাষ নামে পরিচিত। দু’শত বছরেরও কিছু আগে থেকে চলে আসা এ বিরল কৃষি পদ্ধতি আজ দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আনুষ্ঠানিকভাবে ওই স্বীকৃতিপত্র বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেছে।

নাজিরপুর উপজেলার মুগারঝোর, বেলুয়া, চিথলিয়া, উত্তর কলারদোয়ানিয়া, গাওখালী, মনোহরপুর, পদ্মডুবি, বিলডুমুরিয়া, গজালিয়া গ্রামের শত শত একর জলাভ‚মিতে বাণিজ্যিকভাবে ধাপের উপর শাক সব্জির চারা উৎপাদন হয়। অর্থকরী ও লাভজনক হওয়ায় স্ব-উদ্ভাবিত এ বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদ এলাকার কৃষকের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়।

নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে বৈঠাকাটা বাজার সন্নিহিত মুগারঝোর গ্রামের জলাভ‚মিতে নয়নাভিরাম ব্যতিক্রমী এ চাষাবাদের ব্যাপকতা দেখা মেলে। বর্ষার শুরু অর্থাৎ আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত এ পাঁচ মাস কৃষকদের ভাসমান ধাপের উপর ৪১ প্রজাতির শাকসব্জির চারা উৎপাদন ও তা বিক্রির সময়। আষাঢ়ে এসব গ্রামের নীচু জমি পানিতে প্লাবিত হওয়ার সাথে সাথে কৃষকরা নেমে পড়ে ধাপ চাষে। কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা, টেপাপানা, গুড়িপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সাথে খড়কুটা এবং নারিকেলের ছোবড়াগুড়া মিলিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি করা হয় ভাসমান বীজতলা বা ধাপ। যা পচে তৈরি হয় জৈবসার। ১০০-১৮০ ফুট লম্বা ৫-৬ ফুট চওড়া এবং এক-দেড় ফুট পুরু বীজতলা পানিতে তৈরি হয়, যা থাকে ৮-১০ ফুট পানিতে ভাসমান। পুরুষরা ধাপ তৈরি, চারা স্থাপন, পরিচর্যা ও চারা বিক্রির কাজ করে। নারীরা ও ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়িতে বসে চারা তৈরির প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটানোর কাজ করে। শ্যাওলা, নারিকেলের ছোবরা ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট বল আকারের বস্তু তৈরি করে থাকে। স্থানীয় ভাষায় একে টেমা বা দৌল্লা বলে। এর মধ্যে বীজ রেখে অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয়। যা পরে ভাসমান বীজতলা বা ধাপের উপর স্থাপন করে নির্দিষ্ট সময় পরিচর্যার পর চারায় পরিণত করা হয়।
এ ছাড়া ধাপের উপর সরাসরি কিছু কিছু সব্জির অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয়। ধাপচাষীরা লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করল্লা, পেঁপেঁ, টমেটো, শশা, পুইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, মরিচ, টমেটো ইত্যাদি শাকসব্জি ও মশলার চারা তৈরি করে ধাপের উপর। কেউ কেউ লাল শাক, ঢেড়স, হলুদ ইত্যাদিও ফলায়। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে ক্ষেত থেকে শাকসব্জির চারা ক্রয় করে নৌপথে নিয়ে তা সব্জি আবাদকারীদের কাছে বিক্রি করে।

মুগারঝোর গ্রামের ধাপচাষী রুহুল আমীন (৩৫) জানান, অতিবৃষ্টিতে বিপর্যয় না ঘটলে আষাঢ় থেকে কার্তিক পাঁচ মাসে চার বার চারা উৎপাদন করে বিক্রি করা যায়।

কৃষক আলাউদ্দিন গাউস (৬০) জানান, তার বার্ষিক আয়ের প্রধান উৎস ধাপ চাষ। তিনি বছরে এই চাষ দিয়ে দু’আড়াই লাখ টাকা লাভ করেন। তিনি আরো জানান, ১০০ ফুট দীর্ঘ একটি ধাপ তৈরি এবং সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির চারা উৎপাদনে পাঁচ মাসে খরচ হয় ৬/৭ হাজার টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে ঐ চারা বিক্রি হয় ১৬/১৭ হাজার টাকা। চারা তোলা শেষে কান্দির সব্জি ক্ষেতেও ধাপ ব্যবহার হয়, যা জৈবসারের কাজ করে।

এদিকে, এ ধাপ চাষকে কেন্দ্র করে নাজিরপুর বিল অঞ্চলে গাঁওখালী, বৈটাকাটা ও মনোহরপুর বাজারে ধাপ তৈরির বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের হাট বসছে। এখন সবজি চাষের ভরা মৌসুম তাই সবজি চাষে ব্যবহৃত এ সকল জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ ও বিক্রি করেও শতশত লোকের জীবন জীবিকাও চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ