বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কোরআন মাজীদের দাওয়াত ও শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সর্বাধিক জোর দেয়া হয়েছে, তন্মধ্যে একটি হলো ইনসাফ ও ন্যায়বিচার। আসলে এটি সততা ও সত্যাবাদিতারই এক বিশেষ প্রকার। এর মর্মার্থ হলো, প্রত্যেকটি লোকের সাথে পক্ষপাতহীন আচরণ করা এবং তার ব্যাপারে এমন সত্যনিষ্ঠ কথা বলা, বাস্তবে যে যার অধিকারী।
এই ন্যায়-নিষ্ঠার ওপরই সমগ্র জগৎ-সংসারের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা নির্ভরশীল। যে জাতি ও সমাজে ন্যায়বিচার থাকবে না, সেটি আল্লাহ তায়ালার রহমত ও করুণা থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং এজগতেও এর পরিণাম মন্দ হবে। কোরআন মাজীদ তার দাওয়াত ও শিক্ষায় ন্যায়বিচারের প্রতি যে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে, তা সূরা হাদীদের একটি আয়াত থেকে অনুমান করা যায়।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার রাসূলদের পাঠিয়েছি খোলাখুলি বিধান সহকারে। আর তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি (দিকনির্দেশনার) কিতাব ও ন্যায়বিচারের বাণী, যাতে করে মানুষ নিজেদের ব্যাপারে ন্যায়ানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে।’ (সূরা হাদীদ : আয়াত ২৫)।
এ আয়াতে ‘আল মীযান’ শব্দের মর্মার্থ হলো, ন্যায়বিচারের বিধান ও আইনকানুন। এই প্রেক্ষাপটে আয়াতের তাৎপর্য হলো এই যে, আল্লাহ তায়ালা তার নবী-রাসূলগণের সঙ্গে যেমন বিভিন্ন সহিফা (পুস্তিকা) অবতীর্ণ করেছেন, তেমনিভাবে ন্যায়বিচারের ফরমান ও আইনকানুনও নাজিল করেছেন। যাতে করে তার বান্দারা সেসব পুস্তক-পুস্তিকার আলোকে তার দাসত্ব ও বন্দেগীর পথে চলে এবং ন্যায়বিচারের বিধিবিধান অনুসারে পারস্পরিক ন্যায়ানুগ আচরণ করে।
যাহোক, এ আয়াতে আল মীযান তথা ন্যায়বিচারের উল্লেখ যেভাবে আল কিতাব শব্দের সাথে করা হয়েছে, তাতেই বোঝা যেতে পারে, আল্লাহ তায়ালার নজরে কোরআনী দাওয়াত ও শিক্ষায় ন্যায়বিচারের গুরুত্ব কতখানি।
কোরআনের অন্যত্র আল্লাহর কিতাবের সাথে ন্যায়বিচার সংক্রান্ত একটি ফরমান এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা শুরায় মহানবী সা.-এর প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি (এসব ইহুদি-খ্রিষ্টানদের) বলে দিন, আমি ঈমান এনেছি সেই পবিত্র কিতাবের প্রতি, যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। আর আমার প্রতি নির্দেশ রয়েছে, যেন আমি তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করি। আল্লাহ আমাদের মালিক এবং তোমাদেরও।’ (সূরা শুরা : আয়াত ১৫)।
এ আয়াতেও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত ফরমানের আলোচনা যেভাবে কিতাবের প্রতি ঈমান আনার সাথে মিশিয়ে করা হয়েছে, তা কোরআনের ইঙ্গিত বিশারদদের পক্ষে এ কথা উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট যে, কোরআনী দাওয়াত ও শিক্ষায় ন্যায়বিচারের গুরুত্ব কতখানি। এ কারণেই সূরা নাহলের যেখানে ঈমানদারদের অতি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও চারিত্রিক বিধিমালা দেয়া হয়েছে, সেখানে সর্বাগ্রে ন্যায়বিচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে রুকুটি শুরুই হয়েছে এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা হুকুম দিচ্ছেন ন্যায়বিচারের এবং সদ্ব্যবহারের।’ (সূরা নাহল : আয়াত ৯০)।
এ ছাড়া সূরা আন’আমের যেখানে আল্লাহ তায়ালা বিধিনিষেধসমূহকে একত্রে বর্ণনা করেছেন, সেখানেও ন্যায়বিচারের তাকিদ করে বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো (বিবদমান) বিষয়ে তোমাদের কোনো কিছু বলতে কিংবা মীমাংসা করতে হয়, তখন ন্যায়বিচার করবে যদিও (বিবদমান পক্ষ) তোমাদের কোনো নিকটাত্মীয় হয়।’ (সূরা আনআম : আয়াত ১৫২)।
সূরা নিসার এক আয়াতে আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন ন্যায়পরায়ণ হওয়া ও আল্লাহর ওয়াস্তে সত্য সাক্ষ্য দান করা ঈমানদারদের জন্য ফরজ। যদিও তাতে সে নিজে কিংবা তার পিতা-মাতা অথবা তার আত্মীয়-আপনজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও এবং ইনসাফের সমর্থক ও আল্লাহর ওয়াস্তে সত্য সাক্ষ্যদানকারী থাক, যদিও (সে সত্য সাক্ষ্য ও ন্যায়নিষ্ঠা) তোমাদেরই বিরুদ্ধে যায় কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে যায়।
বিবদমান পক্ষদ্বয় বিত্তবান হোক কিংবা বিত্তহীন (উভয় অবস্থাতেই) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চাইতে তাদের অধিক কল্যাণকামী। কাজেই তোমরা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নিজের নফস (রিপু)-এর অনুসরণ করো না। যদি তোমরা (কারো আত্মীয়তা কিংবা দারিদ্র্য-ধনীত্বের প্রেক্ষাপটে বিচার মীমাংসা বা সাক্ষ্যদানে) হেরফের বা ঘোরঘাপলা করো কিংবা ন্যায়ানুগ কথা বলতে পাশ কাটিয়ে যাও, তাহলে নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত।’ (সূরা নিসা : ১৩৫)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।