পুনরায় যমুনা ব্যাংকের এমডি হলেন মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ
যমুনা ব্যাংক লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে আরও ৫ বছরের জন্য পুনরায় নিয়োগ পেয়েছেন মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে পুনঃনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে।
এনায়েত আলী বিশ্বাস
নূরজাহান বেগম ছিলেন বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত। তিনি ভারত উপমহাদেশের নারীবিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগমের জন্মলগ্ন থেকেই সম্পাদনার সাথে জড়িত। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই ‘সওগাত’ সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিনের প্রচেষ্টায় বেগম আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম চার মাস এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়া এন হোসেন। নূরজাহান বেগম এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ৪ মাস পর বিএ পাসের পর থেকে তিনি পুরোপুরি বেগমের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তারপর থেকে নানা ঝড়-ঝাপটা, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু যার নেতৃত্বে বেগম আজ বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত হয়ে উঠতে পেরেছে সেই নূরজাহান বেগম আর নেই। গত ২৩ মে ২০১৬ তারিখে ৮১ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। পিতা-‘সওগাত’ সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন, মাতা-ফাতেমা বেগম-গৃহিনী। সেই ১৯৪৭ সাল যখন ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে, সেই দিনে মহিলাদের জন্য পত্রিকা বের করা কত দুরূহ তা এর প্রতিষ্ঠাতা ‘সওগাত’ সম্পাদক নাছির উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই সময় মহিলাদের বিশেষ করে মুসলিম মহিলাদের লেখাতো দূরের কথা, তারা ঘরের বাইর হতেও পারতেন না। যখন মহিলাদের কোনো লেখা বাইরের কাগজে বের হলে সে পরিবারকে একঘরে করে রাখা হতো। সেই অবস্থায় মহিলাদের লেখা নিয়ে সাহিত্য পত্রিকা সে যে কত দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল তা নূরজাহান বেগম ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলেন। তবে আনন্দের কথা, সে সময় তরুণ সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর, আবুল ফজল মেয়েদের ঘরের বাইরে আসার ব্যাপারে অনেক লেখালেখির পরও যখন মেয়েদের কোনো লেখা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তরুণ সাহিত্যিকরা নিজেদের স্ত্রীর ছবি এবং নিজেরাই লেখা তৈরি করে ছবিসহ পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম নিজে একটি কবিতা লিখে তাঁর স্ত্রীর ছবি দিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে ছিলেন। অন্য সাহিত্যিকরা তাদের স্ত্রীদের নামে লেখা বানিয়ে ছবিসহ পত্রিকায় দিতেন, এভাবেই বেগম এগিয়ে চলে। এরই মধ্যে কিছু কিছু লেখিকা যেমন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া এন হোসেন, আশাপূর্ণা দেবী, অনুরূপা দেবী এগিয়ে এসেছেন। আজ সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে নারীরা পদচারণা করছেন দীপ্ত পদক্ষেপে সে পথটির রচনার মূলে বেগম সম্পাদিকা নূরজাহান বেগমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে পথ তৈরি করেছেন তিনি। দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে নূরজাহান বেগম সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। এবং বেগমের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশনা শুরু করেন। ঢাকায় এসে পাকিস্তান আমলে ৫০-এর দশকেও যখন মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ খুব কম ছিল, ঘরের আঙিনা পেরিয়ে মুসলমান মেয়েদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা, তখন বেগম পত্রিকা ছিল মেয়েদের বদ্ধঘরের খোলা জানালার মতো। এভাবে তিনি মেয়েদের জন্য এবং আমাদের পুরো সমাজে ঘটিয়ে ছিলেন এক জাগরণ। মেয়েরা উন্মুখ হয়ে থাকতো বেগম পত্রিকার জন্য। তিনি মিটিং-মিছিল করেননি। কিন্তু বেগমের মধ্য দিয়েই সমাজে, জনমানসে, চিন্তার জগতে একটা বিশাল বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন। বেগম ছিল এক নীরব বিপ্লব। নারী শিক্ষার পক্ষে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার, দৃঢ়চিত্ত ও অবিচল। বেগমের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তিনি সে কথা শুনিয়ে গেছেন।
নূরজাহান বেগম শুধু পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন তা নয়। তিনি এবং বেগম বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি বেগমকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন ‘বেগম ক্লাব’। নারিন্দায় ৩৩, শরৎ গুপ্ত রোডে বেগমের অফিসে বেগমের লেখিকা ও কর্মীদের নিয়মিত আড্ডা বসত। সেখানে সাহিত্য পাঠ, আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। এতে সাহিত্যিক ও লেখিকারা যেমন উৎসাহিত হতেন তেমনি যে শিল্পিরা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তারাও অনুপ্রাণিত হতেন। নতুন লেখক ও শিল্পীদের কাছে এ ছিল বিরাট পাওনা। নূরজাহান বেগমের আরো একটা অবদান হলো বেগম ক্লাবের মাধ্যমে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন। ক্লাবের সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল, সাধারণ সম্পাদিকা বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের নেতৃত্বে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসক আইয়্যুব খানের সঙ্গে দেখা করে এ আইনের সংশোধনী আনার জন্য একটা স্মারকলিপি প্রদান করেন। ৯০টি সংগঠন এক সভায় মিলিত হয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের জন্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধা উপেক্ষা করে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন অধ্যাদেশ জারি হয়। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মেয়েরা আজ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ পদসহ নানা পদে, নানা পেশায় মেয়েরা দায়িত্ব পালন করছেন। তা সত্ত্বেও মেয়েদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রতিক্রিয়াশীল মহল তৎপর। এই মুহূর্তে দরকার ছিল নূরজাহান বেগমের মতো নারী নেতৃত্বের। তিনি আজ আর নেই। তার পথ ধরে এ পথে আজকের সাহসী মেয়েরা সব বাধাকে চূর্ণ করেই এগিয়ে যাবে এ আশা সকলের। নারীরা অতীতের তুলনায় বর্তমানে অনেক কিছুই পেয়েছে। সংবিধানে সমঅধিকার পেয়েছে। কিন্তু দেশের নারী উন্নয়ন নীতি ও অন্যান্য পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সম্পত্তি বিষয়ক, নাগরিকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইনের বৈষম্যের কারণে নারীর মানবাধিকার প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। নূরজাহান বেগম প্রাগ্যসর চিন্তার আধুনিক ব্যক্তি। তিনি জানেন গ্রাম-বাংলার নারীসমাজ শহুরের সমাজের এগিয়ে যাওয়া পথের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। প্রয়োজন রাষ্ট্রের শিক্ষা নীতির, অর্থনীতির ও নারী নীতির সুষ্ঠু সামগ্রিক বাস্তবায়ন। সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য দূর করতে না পারলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। পরিবারে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। পরিবারে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নারীর সমমর্যাদা। পুত্র-কন্যার বিভেদ দূর করতে হবে। তবে বেগমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন ঘটবে। তবে নারী অগ্রগতির মূলে আজকে অনেকে পাশ্চাত্য শিক্ষা মনে করলেও নূরজাহান বেগম কিন্তু নারীবাদী চিন্তা-চেতনায় পাশ্চাত্যকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। দেশের নারীর এগিয়ে চলার পথে স্বাদেশিক-সামাজিক অগ্রসরতা তার একান্ত কাম্য ছিল। সেই দৃঢ়তা নিয়ে তিনি বেগমের প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছিলেন।
যুগ বদলায়। যুগের চাহিদাও বদলায়। পাঠকের চাহিদাও বদলায়। সেই যুগের চাহিদার সঙ্গে বেগমকে মনে হতে পারে সেকেলে। কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে সেকেলে মনে হওয়ায় বেগম আজও খোলা জানালার মতো নতুন যুগের হাওয়া বিতরণ করছে। নূরজাহান বেগম আজ আর ধরাধামে নেই। কিন্তু তার উত্তরসূরি যাদের জন্যে তিনি এতদিন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন সেই মহিলারা নিশ্চয় কেউ কর্ণধার হয়ে বেগমের হাল ধরবে। নূরজাহান বেগমের আরাধ্য স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবেন।
বেগমের দীর্ঘদিনের পথচলার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে নূরজাহান বেগম নিজেই বলেছেন, ‘আজকে যেমন মহিলা সাংবাদিকরা বুক ফুলিয়ে সাংবাদিকতা করছেন, সেকালে সেকথা ভাবাছিল অকল্পনীয়। কেননা, তখন মেয়েদের কোনো সুযোগই ছিল না। তবে আমার বাবা অত্যন্ত উদারপন্থী এবং সেজন্য আমি বাবার সাথে কাজ করতে পারতাম।’ পিতার উৎসাহে সমাজকর্মে হাতে খড়ির মধ্য দিয়ে তরুণী নূরজাহান বেগমের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে রথ আর থামেনি। তিনি মুসলিম অরফানেজ উইমেন্স হোমের সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মহিলা শাখা, নারীদের সংগঠিত করে সমাজকর্মী, সংগঠক, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যাঙ্গনে ব্রতী করে তোলার কাজটি তিনি করেছেন নিষ্ঠার সাথে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন মেয়েদের অনেক প্রতিভা আছে, কিন্তু তা বিকাশের সুযোগ পায়না। নূরজাহান বেগম সেই কাজটি করেছেন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সফল হতে পারেননি। যেমন নারী-পুরুষের শ্রমের মর্যাদা অতীতেও যেমন সমহারে ছিল না এখনও এত নারী অধিকারের দিনেও তারা সমধিকার পায়নি। সংখ্যার দিক থেকে দেশের নারী-পুরুষের অবস্থান প্রায় সমান। মিডিয়ার আজকের এই অগ্রগতির দিনেও কোনো জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন মেয়েদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পাতা নেই। যদিও পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরাই মুখ্য নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করছেন। নারীরা কেবলমাত্র সেখানে সদস্য থাকতে পারেন। এমনি আরো অনেক সেক্টরে এ অবস্থা বিরাজমান। নূরজাহান বেগম বড় আপসোস নিয়ে ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব যারা নিয়েছেন তারা কি পারবেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে? বেগমকে কেন্দ্র করে নূরজাহান বেগম নারী জাগরণের যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার শতভাগ সফলতার পথ না দেখলেও অনেক পথ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুর জ্জামান ২০০৬ সালে নির্বাচিত বেগম ১৯৪৭-২০০০ বইটির ভূমিকায় বলেছেন, ‘বেগম’ দেখা যাচ্ছে, খ- ইতিহাসের প্রকা- আকর। ৫০ বছর বা তার কিছু বেশি কাল ধরে বাংলাদেশের নারী সমাজে যে ধীর অগ্রগতি হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধারণ করে রেখেছে এই পত্রিকা।’ এই স্বীকৃতি যথার্থই নূরজাহান বেগমের প্রাপ্য। ‘বেগম’ কেবল পত্রিকা নয়, সমাজ বিনির্মাণের প্রতিষ্ঠান রূপেই স্বীকৃত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।