বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আহমেদ জামিল
গত ২ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পেশ করেন। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ এবং শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই বাজেটকে উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তবায়নযোগ্য বলে সমালোচনা করেছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, এই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। লক্ষণীয় দিক হলো, এই বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,৪০,৬০৫ কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাত থেকে আয় আসছে ২,৪৮,২৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বাজেট একটি ঘাটতি বাজেট। আর আশঙ্কার দিক হলো, এবারের বাজেটে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা মিলছে না। যে কারণে ৩ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম করা হয়েছিল ‘আকাক্সক্ষা বিপুল, সামর্থ্য কম’। এদিকে গবেষণা সংস্থা সিপিডি এই বাজেটের নেতিবাচক মূল্যায়ন করেছে।
গত ৩ জুন সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সরকারের আয়কে ধনুক, ব্যয়কে তীর এবং বাজেটের লক্ষ্যগুলোকে নিশানার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘আপনার যদি একটা লক্ষ্য থাকে, আর সেই লক্ষ্য যদি আপনি অর্জন করতে চান, তাহলে আপনার তীর চালাতে হবে এবং তার জন্য একটা ধনুক থাকতে হবে। আমরা ধনুক তীরে সেই শক্তি দেখতে পাচ্ছি না। এই তীর ধনুক দিয়ে লক্ষ্য ভেদ করা যাবে বলে মনে হয় না।’ সত্যি বলতে কি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি ও শিল্প সেক্টরের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। কৃষি সেক্টরে ধানের আবাদে দেশে এখন চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। বিদেশ থেকে চাল আমদানি এবং ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে এ বছর কৃষকরা বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন শুধু কমার আশঙ্কাই নয়, বরং সেই সাথে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে ভবিষ্যতে মারাত্মক খাদ্য সংকটও সৃষ্টি করতে পারে। আর এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলা শিল্প সেক্টর। সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে ব্যবসা করার খরচ। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে স্থবিরতার কারণে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাড়ছে বেকারত্ব। বর্ধিত বেকার সমস্যা সমাজ জীবনে সৃষ্টি করছে এক ধরনের নৈরাজ্য ও হতাশা।
তাই ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। গত ৩ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে ডিসিসিআই সভাপতি হোসেন খালেদ বলেছেন, “এ বছরের বাজেটকে আমার কাছে গতানুগতিক মনে হয়েছে। নতুন শিল্পে বিনিয়োগের জন্য বাজেটে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করে একটি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের স্থানীয় অনেক শিল্প রয়েছে, সেখানে তৈরি পোশাক খাতের মতো অথবা তার বেশি হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু অন্য কোনো শিল্পকে প্রণোদনার জন্য বিবেচনা করা হয়নি। সরকারের শিল্পনীতিতে যেভাবে বিভিন্ন শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, বাজেটে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাইনি।”
শুরুতেই একটা কথা বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা মিলছে না। বিশ্বব্যাংকের সাথে শেখ হাসিনার সরকারের শীতল সম্পর্কের কারণে এটি ঘটেছে বলে মনে করেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। এর আগে প্রতিবছরের বাজেটে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেত। বিগত ৯০ দশকের শেষ দিক থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে এই ঋণ দিয়ে আসছে। এই ঋণের সুদের হার খুবই কম। মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে তারা এ ঋণ প্রদান করে থাকে। পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০ বছরের গ্রেস তা আরো সহনীয় করেছে গ্রহীতাদের জন্য। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে নতুন বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মন্দাবস্থার বিরূপ প্রভাব আমাদের সম্ভাবনাময় আবাসন খাতেও পড়েছে। তবে সবচেয়ে ভীতির কারণ হলো শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অচলাবস্থা। প্রতিবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও বাস্তবে এ টাকা কোনো সেক্টরে বিনিয়োগ না হয়ে দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেক গর্ব করে থাকে। তবে এ নিয়ে গর্ব করার বাস্তব কোনো কারণ নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সচল থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ এত জমত না। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হতো না। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, সাত বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি এবং এর বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের জন্য পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা নিয়ে বসে থাকলেও বিনিয়োগকারীরা খুবই কম সংখ্যক ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিচ্ছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে জিডিবির প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও কমেছে ব্যক্তি বিনিয়োগের হার। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “জমির প্রাপ্যতা সংকট, পরিবহন খাতে দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাÑএ তিনটি কারণে বিয়োগ হচ্ছে না।”
দেশে দুই বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৬ লাখ। প্রতিবছর বেকার হচ্ছে ১ কোটি ৬ লাখ মানুষ। বিবিএস-এর শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৫ রিপোর্ট অনুযায়ী বেকারের সংখ্যা এখন দেড় দশকের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি। বেকারত্বের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। এই বিশাল কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীকে বেকার অবস্থায় রেখে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের ঢাকঢোল পেটানোকে জাতির সাথে তামাশা ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে মাথাপিছু আয় হতে হবে ৪,১২৫ ডলার। বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১,৩১৪ ডলার। বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পেলেও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
সুতরাং বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বলা চলে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা কার্যত অসম্ভব ব্যাপার। তাই এই প্রেক্ষাপটে বলা চলে যে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আশাবাদ জাগাতে পারেনি। যে কারণে পরোক্ষভাবে এই বাজেট ব্যাংকের অর্থ লুটেরা এবং মুদ্রা পাচারকারীদের উৎসাহিত করেছে। দেশে যখন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মন্দাবস্থা বিরাজ করে এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায় তখন সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে নেমে আসে নানা অস্থিরতা ও নৈরাজ্য। আজকের বাংলাদেশ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।