Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইউপি নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদী

প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
একটা কৌতুক বলে আমার কলাম শুরু করি। ঘটনাটি কথিত। বর্তমান ঢাকা মহানগরের দক্ষিণ অংশে, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী অতি ঘনবসতিপূর্ণ অংশটি পুরনো ঢাকা। পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বিদ্যমান কৌতুকপ্রিয়তা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং প্রশংসনীয়। ঐ পুরানো ঢাকায় বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। একটি গুলি লেগে একজন ব্যক্তি তাৎক্ষণিক নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিটির শরীরের কোন্ জায়গায় গুলিটি লেগেছিল এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ একটিমাত্র গুলিতেই তার প্রাণ গিয়েছে। গুলিটি লেগেছিল বাম চোখের নিচে, নাকের বাম পাশে এবং গুলি মুখের ভেতরে ঢুকে কণ্ঠনালি ভেদ করে পেছনের দিক দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। গুলি যে স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছে সেই স্থান দিয়ে রক্তপাত হয়ে মানুষটির শরীরের বুক এবং নিচের অংশ ভিজে গেছে। নিহত ব্যক্তির পুরনো ঢাকার প্রতিবেশী শোক প্রকাশ করতে এসে বললো, পুরনো ঢাকার কথ্য ভাষায় যা বললো তার বাংলা এরকম দাঁড়ায়; “ও মারা গিয়েছে এটা খুবই দুঃখজনক। ও খুব ভালো মানুষ ছিল। তবে সৌভাগ্যের কথা হলো যে ওর চোখ রক্ষা পেয়েছে।” কৌতুকটি বলার পেছনে কারণ হলো ২৭ মে ২০১৬ তারিখে পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচন শেষ হওয়ার পর, ২৮ মে তারিখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় যে মন্তব্য করেছিলেন সেখানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। কথাটি ছিল অনেকটা এরকম, “ভোটের দিন ভোট কেন্দ্র দখল বা অবৈধ সিল মারার ঘটনা কমে গেছে যদিও গোলযোগ বা সন্ত্রাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।” প্রধান নির্বাচন কমিশন মহোদয়ের কথাবার্তা, গত প্রায় তিন মাস যাবত, অনুসরণ বা পর্যালোচনা করলে, যে কোনো সমঝদার ব্যক্তি বলবেন, নির্বাচন কমিশন কি আদৌ কোনো শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চেয়েছিলেন? নির্বাচনের দিন ছাড়াও, গত দুই মাসে, অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিক নিয়ে বেশ কিছু আলাপ-আলোচনা হয়েছে। পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন আঙ্গিকের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং মূল্যায়নমূলক কলাম প্রকাশিত হয়েছে। অতএব আমি মনে করি, ২০১৬ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো ইউপি নির্বাচন। এবারের ছয় দফায় অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচন, আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব রাখতে বাধ্য। কী নিয়মে বা কেন? এই প্রসঙ্গে বহু বলা-বলি হচ্ছে ও লেখালেখি হচ্ছে। এই কলামটিও একটি সংক্ষিপ্ত আংশিক উদ্যোগ।    
প্রথমে আলোচনা করি দলীয় মার্কা ব্যবহার এবং তার প্রভাব সম্পর্কে। ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মার্কার ব্যবহার এইবার ছিল প্রথম। অতীতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীগণ, সমর্থিত হতেন। এবার দলীয় মার্কা ব্যবহারের কারণে রাজনীতির মাঠে এবং সমাজে বহু প্রকারের ও বহু আঙ্গিকের প্রভাব পড়েছে। সেগুলো ইতোমধ্যেই আলোচিত হয়েছে, আলোচিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আলোচিত হবে। বাংলাদেশের সমাজ বা জনগণ বিভিন্ন পরিচয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীরভাবে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে হালকাভাবে হলেও, বিভাজিত। রাজনৈতিক এবং কিছুটা সাংস্কৃতিক প্রধান বিভাজনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো বর্তমান শাসক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানার চিন্তাবিদগণ। সেই প্রধান বিভাজনটি হলো এইরূপ: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। এই সূচকে বা শিরোনামের বিভাজনটি এবার বিস্তৃত হয়েছে। এইবারের ইউপি নির্বাচনে সমগ্র দেশবাসীকে নিশ্চিতভাবে তিনটি ভাগে পরিচিত করা হয়েছে। প্রথম ভাগ হলো আওয়ামী সমর্থক তথা নৌকার সমর্থক; দ্বিতীয় ভাগ হলো জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাকারী শক্তি তথা ধানের শীষের নেতৃত্বে আওয়ামী-বিরোধীগণ। তৃতীয় ভাগ হলো যারা এই ভাগাভাগিতে নিজেদেরকে চিহ্নিত করতে চান না তথা প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ গোষ্ঠী, মনের ভেতরে দুর্বলতা যে রাজনৈতিক দলের প্রতিই থাকুক না কেন। এবারের ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে, দেশের তৃণমূলে গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে সর্বত্রই আওয়ামী সমর্থকগণ নিজেদের সবল উপস্থিতি প্রকাশ এবং প্রচার করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে নৌকা, রাজনৈতিক জোয়ারের পানিতে ¯্রােতের অনুকূলে ভাসছে; নৌকার পালে অনুকূলীয় রাজনৈতিক হাওয়া। পাঠক, অনুগ্রহপূর্বক খেয়াল করবেন যে, আমি মনে করি যে, এই দৃশ্যটা আপাত দৃষ্টিতে দর্শনীয় এবং এর তাৎপর্য গভীর। কারণ, নৌকা রূপক অর্থে তার নদী পথ দখল করতে গিয়ে যাদেরকে যাদেরকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তারা এখন নিরব দর্শক, তারা এখন চোখের জল ফেলছে, তারা এখন অভিশাপ দিচ্ছে। ভবিষ্যতে তারা কী করতে পারে সেটাই গুরত্বপূর্ণ।  
এবার সার্বিকভাবে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে এবং মিডিয়ার প্রশংসায়, আমি কিছু প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করবো। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, আমার নিজের মনের ভেতর মত গঠনের সময়, একাধিক উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। একটি উপাত্ত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমমনা রাজনৈতিক কর্মীগণের অভিজ্ঞতা ও মতামত। আরেকটি উপাত্ত হচ্ছে মুদ্রণ-মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ ও মূল্যায়নমূলক রচনা। তৃতীয় উপাত্ত হচ্ছে টিভিতে প্রচারিত সংবাদ এবং মূল্যায়নমূলক বক্তব্যগুলো। এই তিনটি উপাত্তের মধ্যে শেষের দুইটি তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন যাবত লক্ষ করছি যে, টেলিভিশনগুলোর কর্তৃপক্ষ আলোচনার জন্য ব্যক্তিগণকে ডাকতে গিয়ে, রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেন না। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ইচ্ছাতেও হতে পারে অথবা নিজেদের ইচ্ছার বাইরে উচ্চতর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতেও হতে পারে। এই ভারসাম্যহীনতা যে কারণেই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, আলোচকগণের বক্তব্য শুনতে গিয়ে আমরা সব সময় সরকার পক্ষীয় বক্তব্যের প্রাধান্য পাই। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মালিকের রাজনৈতিক দুর্বলতা বাংলাদেশের কোন্ রাজনৈতিক দলের প্রতি ছিল বা আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অন্তত চার নিয়মে করা যায়। একটি নিয়ম হলো গোপনে গোপনে, গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট আমলাতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ থেকে, মিডিয়ার প্রতি সতর্ক বার্তা বা নির্দেশনামূলক বার্তা জারি করা; যেমন বলা যে, এটা ছাপিও না, এটা প্রকাশ করো না, ঐ নিউজটা বেশি দেখাও, ঐ লোককে আলোচনায় ডাকিও না, ঐ লোককে ডাকো, ঐ নিউজটা দুইদিন পরে ছাপাও ইত্যাদি ইত্যাদি। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্য একটি পন্থা হলো, আইন করা। আইনের মধ্যে বর্ণিত থাকে, কী লেখলে বা প্রচার করলে মিডিয়ার বিপদ; অতএব মিডিয়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে বা নিজেদেরকে নিরাপদ রেখে আচরণ করে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের তৃতীয় পন্থা হলো, আইনের কঠোর প্রয়োগ অর্থাৎ আইনের সু-ব্যবহার অথবা আইনের অপব্যবহার করে মিডিয়ার জীবন ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করা, যেমন কিনা গত সাড়ে সাত বছরে তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপরে প্রয়োগ হয়েছে ও একটি দৈনিক পত্রিকার উপরে প্রয়োগ হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায়, একুশে টিভি চ্যানেলের মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। আমারদেশ নামক জনপ্রিয় পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য চতুর্থ পন্থা হচ্ছে মিডিয়ার মালিকানা নির্দিষ্ট করা। বর্তমান সরকার দেখে শুনে, সুনিশ্চিত আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিগণকে বারো-তেরোটি টিভি চ্যানেলের মালিকানা দিয়েছেন গত পাঁচ-সাত বছরে। প্রকাশ্য স্বাক্ষী নয়, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই চ্যানেলগুলোর মালিকানা ও চ্যানেলগুলোর অব্যাহত জীবন নির্ভর করে আওয়ামী লীগের চিন্তা চেতনাকে প্রসার করার ওপর। আমি এই দীর্ঘ অনুচ্ছেদটিতে মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করলাম এজন্য যে, এতকিছুর পরও, বাংলাদেশের মুদ্রণ বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচন নিয়ে যেরূপভাবে খবর প্রচার করেছে, তার জন্য আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু যারা পত্রিকায় কলাম লিখেছেন বা টেলিভিশন টকশোতে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদী, দূরদর্শীপূর্ণ ও কৌশলগত প্রস্তুতির অংশ হচ্ছে এবারের ইউপি নির্বাচন। কেন, সেই আলোচনাটি এই অনুচ্ছেদে করছি। আমরা এই কলামে ইউপি নির্বাচনের মূল্যায়ন করছিলাম। শুরুতেই দলীয় মার্কায় নির্বাচন করার দু’একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আলাপ করেছি। এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার কথা বলবো। যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ভারতীয় রাজনৈতিক ও সরকারি প্রভাবের গন্ধযুক্ত নির্বাচন, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক শক্তিকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটির কারণে বর্তমান রাজনেতিক সরকার পৃথিবীর বহু দেশের নিকট অপ্রিয়ভাবে উপস্থাপিত, সেহেতু বর্তমান রাজনৈতিক সরকার এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে বিভিন্ন প্রকারের উদ্যোগ নিচ্ছেন; কিছু উদ্যোগ প্রকাশ্য এবং প্রচলিত ধারার, অপরপক্ষে কিছু উদ্যোগ অপ্রকাশ্য এবং অপ্রচলিত ধারার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে, কূটনৈতিক সৌজন্যের সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকেই বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান আছে, নতুন করে একটি পার্লামেন্ট নির্বাচন দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনে, বর্তমান সরকারের প্রতি অব্যাহত আহ্বান আছে, নিরপেক্ষ নির্মোহ পরিস্থিতি ও পরিবেশে, নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রণে বা নিরপেক্ষ পরিচালনায়, সর্বাধিক সংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে, আরেকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান যেন করা হয়। বর্তমান রাজনৈতিক সরকার দেশের এবং বিদেশের এইরূপ আহ্বানগুলোকে মোকাবিলা করেই তাদের অস্তিত্বরক্ষামূলক কার্যক্রম বজায় রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেই যাচ্ছেন। প্রশ্ন হতে পারে কীসের প্রস্তুতি? উত্তর হলো, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে যেন যুগপৎ তিনটি উদ্দেশ্য সফল হয়। প্রথম উদ্দেশ্য হলো, সর্বাধিক সংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশীদার করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকগণ থেকে এই সার্টিফিকেট আদায় করা যে, পার্লামেন্ট নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী জোট যেন শুধু জয়লাভ করে না বরং কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি পায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই তিনটি উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচন একটি প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ ছিল। সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শতকরা প্রায় নব্বই শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে নিজেদের প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নব্বই শতাংশের মধ্যে আমি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীগণকেও শামিল করছি। কারণ বিদ্রোহী প্রার্থীগণ, আওয়ামী লীগের নীতি বা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য বা আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি; তারা বিদ্রোহ করেছিলেন প্রার্থী মনোনয়নে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার পৃথিবীর নিকট উপস্থাপন করছে, নিরবে বা সাইলেন্টলি, একটি বক্তব্য। বক্তব্যটি হলো অনেকটা এরকম, “বিশ্ববাসী দেখো, সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের দলের সমর্থন কত গভীর এবং বিস্তৃত।” বাস্তবতা হলো, যে নিয়মেই হোক না কেন, আসলেই পদ্ধতিগতভাবে বা আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করলো। একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মানে একটি ইউনিয়নের নেতা। ইউনিয়নের উন্নয়ন কর্মকা-ের হোতা ও পরিচালক। অতএব এই তথাকথিত গভীর ও বিস্তৃত সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে, বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। আগামী নির্বাচনে যেন ভোটারগণ আওয়ামী লীগের অনুকূলে ভোট দেয় তার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ও সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ভবিষ্যতে, অনেক সহজ হয়ে গেল।
এবারের ইউপি নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি আতংকজক পর্যায়ে গিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ইউপি নির্বাচনটি ছিল টাকার খেলা। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী খরচ এবার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য, আগ্রহীগণ টাকা খরচ করেছেন এইরূপ অভিযোগ বিস্তর। মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্বাচনে জেতার জন্য প্রার্থীগণ টাকা খরচ করেছেন জোয়ারের পানির মতো। কানে আসছে অনেক কথা যে, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী এক কোটি টাকা ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী দেড় কোটি ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী অর্ধকোটি ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার অজুহাতে এত লক্ষ টাকা পেয়েছেন ইত্যাদি। মানুষের মতে এটা টাকার খেলা ছিল। টাকা কাদের কাছে ছিল? ইংরেজি পরিভাষায়: এসেনশিয়ালী, উইথ দি আওয়ামী লীগারস। বাংলায়, আওয়ামী লীগারগণের কাছেই টাকা আছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ছোট, মধ্যম, বড় এবং মেগা (অর্থাৎ বড়গুলোর মধ্যেও বড়) সর্বপ্রকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবসা আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিগণই পেয়েছেন। অতএব, যে টাকা কামাই করা হয়েছে, এবার তার কিছুটা ব্যয় হয়েছে। টাকার এইরূপ ব্যবহার ও অপব্যবহারের প্রভাব সমাজের উপরে দারুণ নেতিবাচক হতে বাধ্য। টাকা খরচ করলে সবকিছু করা যায়, সবকিছু পাওয়া যায়, সবকিছু চাপা দেওয়া যায়, সবকিছু ম্যানেজ করা যায়, সবকিছু কেনা যায় এই ধারণা সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইউপি নির্বাচনে যতো খরচ হলো তার থেকে বহুগুণ বেশি খরচ জনগণ কল্পনা করবে, উপজেলা নির্বাচনের সময় বা সংসদ নির্বাচনের সময়।  
হতাহতের খবর এবং মিডিয়ার মূল্যায়ন : ইউপি নির্বাচনের কারণে অনেককেই জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। গত চার বছর যাবত চলমান যে প্রক্রিয়া (অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া); সে প্রক্রিয়া আরও জোরদার হলো এবং আরও বেগবান হলো। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে, মোটামুটি একটা ধারণা এরকম। আমি কোনো পত্রিকার নাম উল্লেখ করছি না; ছয়টি ধাপে মিলে প্রাণহানীর সংখ্যা ১২০ এর অধিক; ১২১ অথবা ১৩০ অথবা ১৩২ এইরূপ একটি সংখ্যা। আহত, হাজারের অধিক। ৫ জুন তারিখের কয়েকটি প্রধান পত্রিকার শিরোনাম উল্লেখ করছি, পত্রিকার নাম উল্লেখ না করেই। (১) “শেষ হলো প্রাণঘাতী নির্বাচন”, (২) “প্রাণঘাতী ইউপি নির্বাচন শেষ”, (৩) “শেষ হলো রক্তঝরা নির্বাচন”, (৪) “মাঠে ককটেল কেন্দ্রের ভেতরে লাশ”, (৫) “শেষ ধাপেও সংঘাত সহিংসতা”, (৬) “অনিয়মে চ্যাম্পিয়ন ইসি”, (৭) সরেজমিন মুরাদনগর: “ব্যালট কেড়ে নিয়ে সিল মারাই ছিল তাদের কাজ”, (৮) নারায়ণগঞ্জের বন্দর: “জাল ভোটে বাধা দেওয়ায় এজেন্ট বিতাড়িত”, (৯) “সরেজমিন চট্টগ্রামের ৫ উপজেলা: আজকাল ভোট এমনই, ভোটার লাগে না!” (১০) “ছোঁ মেরে কেড়ে নেওয়া হলো ব্যালট পেপার”। ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত একটি সুপরিচিত পত্রিকার ৬ জুন প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ বিশ্লেষণমূলক রচনা ছিল; ঐ রচনার শিরোনাম ছিল, “জীবনের দাম কম প্রমাণের পণ করেছিল ইসি।” শিরোনামগুলো থেকেই বোঝা যায়, ঢাকা মহানগরের প্রধান পত্রিকাগুলো ইউপি নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে কী নিয়মে মূল্যায়ন করেছেন। টেলিভিশন টকশোতে যতই জোর গলায় সরকারের প্রশংসা করা হোক না কেন, পত্রিকার এরূপ শিরোনামগুলো, অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তথা এখনও লেখা হয়নি এমন ইতিহাসের জন্য খুব শক্তিশালী উপাত্ত হয়ে থাকলো। পত্রিকাগুলোর মতে, ছয় ধাপের নির্বাচনে, অন্ততপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক সংঘর্ষ হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য প্রার্থীর সমর্থকগণের মধ্যে। বাকি সংঘর্ষ হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং অন্যদের মধ্যে। প্রচুর সংখ্যক ঘরবাড়ি জ্বালানো-পোড়ানো হয়েছে। ৪ জুন অনুষ্ঠিত শেষ ধাপের নির্বাচনের পর, প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় যা বলেছেন সেটাও বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে “এইবার সবচেয়ে ভালো ভোট হয়েছে”। একই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে অন্য আরেকটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে, “ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ হয়েছে: সিইসি”। অপরপক্ষে দ্বিতীয় পত্রিকাটি তাদের নিজেদের মূল্যায়নে প্রথম পৃষ্ঠায় যে শিরোনাম করেছে সেটি ছিল এরকম “অনিয়মে চ্যাম্পিয়ন ইসি।” এতগুলো নেতিবাচক খবরের মধ্যে দু’একটি ইতিবাচক খবরও আছে। যেমন বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের জন্য বা সংঘর্ষের জন্য ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে; বিজিবি টহল দল অনেকগুলো কেন্দ্রকে দখলের হাত থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু এই ধরনের ইতিবাচক সংবাদগুলো সংখ্যা এতো কম যে, আমরা সেগুলোর উপর ভিত্তি করে, নিজেদের মনের ভেতরে কোনেরূপ ইতিবাচক সার্বিক মতামত গঠন করতে পারছি না। কারণ ইতিবাচক ঘটনাগুলোর সংখ্যা নেতিবাচকের তুলনায় খুবই কম এবং উল্লেখ করার মতো না। তবে চূড়ান্ত বিচারের ভার বা মূল্যায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগণ তথা পাঠকের হাতে।
উপসংহারে আমার বক্তব্য নিম্নরূপ। তিন মাসের অধিককাল ধরে যে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সমাজে দীর্ঘমেয়াদী এবং অবিশ্বাস্যভাবে নেতিবাচক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। সরকার কর্তৃক বা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বা উভয়ের যোগসাজশে এই ভেঙে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। সহিংসতাকে একটি স্বাভাবিক কাজ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নামক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষতা অথবা আন্তরিকতার অভাব জনসমক্ষে উদ্ভাসিত হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের আগামী দিনের ইচ্ছা প্রসঙ্গে, আগামী দিনের কর্মপদ্ধতি প্রসঙ্গে ধারণা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্মকা-গুলোকে মোকাবিলা করতে হলে বা নিউট্রালাইজ করতে হলে, কী করণীয়, সেটা বারবার আমাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি যদি সাধু হই, তিনি যদি সাধু হন, আপনি যদি সাধু হন, তাহলে সাবধান। বাংলায় বলে, “সাধু সাবধান”। উল্লেখ্য, এই কলামটিতে আংশিক মূল্যায়ন করেছি। যত না লিখেছি, তার থেকে বহুগুণ বেশি লেখার বাইরে থেকে গিয়েছে।
য় লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
িি.িমবহবৎধষরনৎধযরস.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউপি নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদী
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ