Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঘোষিত বাজেট মানুষের ভোগান্তি বাড়বে

প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হারুন-আর-রশিদ
এবারের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুধু সাধারণ মানুষকে দিতে হবে ৬৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার বাড়তি কর (ট্যাক্স)। এ বাজেটের কারণে মানুষের ব্যয় বাড়বে, আয় কমবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২ জুন ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির সুসংবাদ দিয়ে বাজেট ঘোষণা করেছেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও সুসংবাদ দিয়ে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বছরের শেষ প্রান্তিক মার্চ এপ্রিল ও মে ২০১৬ রাজস্ব আয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি অনাদায়ী রয়ে গেছে। এ কারণে গত অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট আরো বেড়ে গেছে।
নতুন বাজেটে ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থই আসবে জনগণের কাছ থেকে। বাকিটা ঋণ। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯ শতাংশ ও বৈদেশিক অনুদান ১ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হলো, জনগণকে যে ৭২ শতাংশ কর দিতে হবে, এর বিনিময়ে জনগণকে সরকার কী সুবিধা দেবে। এর উত্তর হলো, জনগণের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে। সরকারের সেবা খাতগুলো থেকে জনগণ সেবা পায় না। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বিগত সাত বছরে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। জনগণ যখন উপকার পায় না তখন কর বাবদ এই বাড়তি টাকা তারা কেন দেবে। জনগণই বলছে আমাদের জন্য এ বাজেট নয়। এটা হলো গরিব মারার বাজেট।
আমরা অতীতেও দেখেছি, উন্নয়ন বাজেট পুরোটা ব্যয় করা যায় না। অনুন্নয়ন বাজেটও ঠিক থাকে না। বর্তমান বাজেটে অনুদান (এক দশমিক ৬ শতাংশ) ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই ঘাটতি ঋণ করে মেটাবেন। এবার বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। এই অর্থের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা এবং বাকি ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে। অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বলেছেন, অর্থায়নের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের দিকে আমরা কিছুটা ঝুঁকে পড়েছি।
‘ব্যক্তি কর’ আগের মতোই আছে অর্থাৎ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধির কারণে সাধারণ ভোক্তাদের ওপরও চাপ বাড়বে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কারণে মানুষের নিত্য দিনের খরচ আরো বেড়ে যাবে।
বর্তমান বাজেটে লাখ লাখ বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বাজেটে নেই। বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৫-১৬) মাথাপিছু কর দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৮৭ টাকা। কিন্তু এবার দিতে হবে ১৫ হাজার ১৭২ টাকা। প্রতিজনে চার হাজার ৮৫ টাকা এবার বাজেটে বাড়ানো হলো। আগেই বলেছি এ বাজেট মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষকে আরো ভোগাবে। উদাহরণস্বরূপ ৭ বছর আগে দেশি আলুর দাম ছিল কেজিপ্রতি ৬ টাকা। এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা। শিক্ষা খাতে এবারের বাজেটে কমিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগে বরাদ্দ ছিল দুই দশমিক ৬ শতাংশ এখন বরাদ্দ মাত্র এক দশমিক ৯ শতাংশ।
এবারের বাজেটে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। মুঠোফোনে কথা বললে খরচ বাড়বে। রপ্তানিকারকদের মাথায় হাত। ইউনেস্কো বলেছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে জিডিপির ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাতে সারা বিশ্বের মধ্যেই বাংলাদেশের সর্বনি¤েœ অবস্থান। বাজেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি আয় হলেই আপনাকে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার কর দিতে হবে। এবারের বাজেটে নগরীর যানজট নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। অথচ যানজটের কারণে রাজধানীতে প্রতিবছর বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। একই কারণে প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
একটি রাষ্ট্রের বাজেটকে কার্যকর বাজেট তখনই বলা যাবে যখন মূল্যস্ফীতির সূচক কমবে এবং বিনিয়োগ সূচক বাড়বে। দুটি সূচকই এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাজেট পর্যালোচনায় আমরা দেখেছি রিজার্ভ বৃদ্ধি বিনিয়োগ মন্দারই ইঙ্গিত। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণীত মুদ্রানীতি সঠিকভাবে কাজ করছে না।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি খুব নি¤œমানের এবং তা দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সরকার ব্যয়ের যে প্রাক্কলন করে, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই বাস্তবায়িত হয়। আর বাংলাদেশে বাস্তবায়নের হার ৮১ শতাংশ (সূত্র: সিপিডি-সংবাদ সম্মেলন, ৩ জুন ২০১৬)। শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার কোনো পদক্ষেপের কথা বাজেটে উল্লেখ নেই। এই খাত থেকেই ২০১০ সালে ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। আমরা মনে করি, ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত দেওয়ার একটি অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন ছিল বাজেটে। ষাট ঊর্ধ্ব মানুষের জন্য সরকার সিনিয়র সিটিজেন শব্দদ্বয় ব্যবহার করে মাসিক ৫০০ টাকার ভাতা প্রদানে সন্তুষ্ট থাকতে বলেছে। তাহলে প্রবীণ মানুষরা কি এদেশে উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। তারা অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি ধার্য করা সব ধরনের কর প্রদান করেছে। কিন্তু এখন তাদের দেখভালের ব্যবস্থাটি সরকারের অবশ্যই করা উচিত ছিল। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, যাতায়াতের সেবা এই দুটো খাতে বরাদ্দ রাখা উচিত ছিল। ভারতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রেল ভাড়া কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, জীবন বীমা এবং চিকিৎসা খাতেও ব্যয়ভার বহন করছে ভারত সরকার।
দেশে চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম খাতের কোনো সুসংবাদ নেই। সরকার ভারতীয় টিভি চ্যানেল যেভাবে উন্মুক্ত রেখেছে, অথচ তার বিপরীতে ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না। বিনোদনের নামে প্রচুর টাকা আয় করে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ভারত। ভারতীয় লেখক-শিল্পী এদের দিয়ে বিজ্ঞাপন খাতেও প্রচুর টাকা আয় করে নিচ্ছে। ট্রানজিট খাতেও কম মূসক দিয়ে (১৯০ টাকা) প্রচুর টাকার সুবিধা ভারত সরকার নিয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে বাজেটে কোনো বক্তব্য নেই। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সমতার বিষয়েও কিছু উল্লেখ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১০০ টাকার পণ্য ভারত বাংলাদেশে রপ্তানি করলে বাংলাদেশ থেকে নেয় মাত্র ১০ টাকার পণ্য সামগ্রী। এখানেও বাংলাদেশ সরকার বাণিজ্যে (ব্যালেন্স ট্রেড) সমতা আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যবসায়িক চেম্বার ও সমিতির কর্মকর্তারা বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে রাজস্ব আদায়। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মুখ থুবড়ে পড়বে আবাসন খাত। উৎসে কর কমানোর দাবি করেছে বিজিএমইএ। ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারেÑ বলেছেন সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি বিজিএমইএ। বর্তমান বাজেটে করদাতার বিনিয়োগ সুবিধা কমল। করের টাকায় আবারও ব্যাংকের মূলধন সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ। বাজেট বাস্তবায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বাজেট নিয়ে ৩ জুন ২০১৬ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে এসব কথা বলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
একজন মানুষকে চাকরির শুরুতে যে ভাবনাগুলো তাড়া করে বেড়ায় তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। একজন চাকরিজীবীর স্বপ্ন হলোÑ বাড়ি বানানোর স্বপ্ন, বিয়ে করার স্বপ্ন, গাড়ি কেনার স্বপ্ন, সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর স্বপ্ন। সততা বজায় রেখে এই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। সুতরাং বর্তমান বাজেট তার জন্য কোনো উপকার সাধন করবে এমনটি ভাবা যায় না। বাজেটের বাস্তবায়ন করতে চাইলে ভাবতে হবেÑভর্তুকি কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে যৌক্তিককরণ, রাজস্ব আদায় শতভাগ, ঘাটতি অর্থায়ন মোকাবিলা এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দিকে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে।
কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে খুব বেশি রাজস্ব পেয়েছে তাও বলা যাবে না। এরপরও কেন যে এই সুযোগ বছরের পর বছর দেয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। সরকারের ব্যাংক ঋণ হতে পারে প্রবৃদ্ধির বড় বাধা। এতে ব্যাংকের তারল্যে চাপ পড়বে। ফলে সুদের হার বেড়ে যাবে। শিল্প খাতকেও ব্যাহত করবে এবং প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস করবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সংসদে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। আয় দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। বাজেটের ক্রমাগত আকার বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টি আছে। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়ানোর জোরদার ভূমিকা পালন করা হয়নি। বহু প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শুরুই হয় না। বছর শেষে বাজেট কাটছাঁট করতে হয়। বর্তমান বাজেটে যে তা আবার হবে না সেই নিশ্চয়তা কি অর্থমন্ত্রী দিতে পারবেন। বিগত বছরে যেখানে কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ ধরেও অর্ধেকের বেশি অর্জন করা সম্ভব হয়নি, সেখানে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আলাদিনের চেরাগ ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রী ১০টি বড় প্রকল্পের আলাদা বরাদ্দ দিয়ে এগুলোকে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবেন। উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামনিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঘোষিত বাজেট মানুষের ভোগান্তি বাড়বে
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ