দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ বশির উল্লাহ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তাফসীরে নঈমী ২য় খ-ে রমজানুল মুবারক এর কয়েকটি ফজিলত এর আলোচনা পাওয়া যায়। (এক) কা’বা-ই-মু’ আযযাম মুসলমানদেরকে তার নিকট ডেকে প্রদান করে, কিন্তু এটা এসে রহমত বন্টন করে। এ বিষয়টি এমনি যেন সেটা (কা’বা) একটা কুপ, আর এটা (রমজান শরীফ) হচ্ছে সমুদ্র। অথবা ওটা (অর্থাৎ কা’বা) হচ্ছে সমুদ্র তার এটা (রমজান) হচ্ছে বৃষ্টি। (দুই) প্রতিটি মাসে বিশেষ বিশেষ কিছু দিন-তারিখ রয়েছে। আর তারিখগুলোর মধ্যেও বিশেষ সময়ে ইবাদত-বন্দেগী সম্পন্ন করা হয়। যেমন-ঈদুল আযহার একটি (বিশেষ) তারিখ হজ্জ, মুহররমের দশম দিন উত্তম, কিন্তু রমজান মাসে প্রতিদিনে ও প্রতিটি মুহূর্তে ইবাদত হয়। রোজা ইবাদত, ইফতার ইবাদত, ইফতারের পর তারাবীর জন্য অপেক্ষা করা ইবাদত, তারাবীহ পড়ে সাহারীর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে শয়ন করা ইবাদত, তারপর সাহরী খাওয়াও ইবাদত। মোট কথা, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ জাল্লা শানহুর শান ও মহা বদান্যতাই নজরে পরে। (তিন) রমজানুল মুবারক একটা ‘ভাট্টি’ ভাট্টি যেমন অপরিস্কার লোহাকে পরিষ্কার এবং পরিষ্কার লোহাকে মেশিনের যন্ত্রাংশে পরিণত করে দামী করে দেয়, আর স্বর্ণকে অলংকারে পরিণত করে ব্যবহারের উপযুক্ত করে দেয়, তেমনিভাবে রমজান মাস গুনাহগারদের পবিত্র করে এবং নেককার লোকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়। (চার) রমজানে নফলের সাওয়াব ফরযের সমান এবং ফরযের সাওয়াব সত্তরগুণ বেশি পাওয়া যায়। (পাঁচ) অনেক ওলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি রমজানে মৃত্যুবরণ করে তাকে কবরে প্রশ্ন করা হয় না। (ছয়) এ মাসেই রয়েছে পবিত্র শব-ই-কদর বা লাইলাতুল কদর। যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সাত) রমজান মাসে ইবলিসকে বন্দি করা হয়, দোযখের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয় এবং সেটার দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এ কারণে, এসব দিনে সৎকর্ম অধিক ও গুনাহ হ্রাস প্রাপ্ত হয়। যে সব লোক গুনাহ করেও নেয়, তারা ‘নফসে আম্মারা’ কিংবা ‘নিজেদের সাথী শয়তান’ (সঙ্গে অবস্থানকারী শয়তান) পথ ভ্রষ্ট করার কারণে করে থাকে। (আট) রমজানে পানাহারে হিসাব হয়না।
(নয়) কিয়ামত দিবসে রমজান ও কুরআন রোজাদারদের জন্য সুপারিশ করবে। রমজান বলবে, “ওহে আমার মুনিব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত রেখেছিলাম।” আর পবিত্র কুরআন আরজ করবে, “ওহে মহান রব! আমি তাকে তিলাওয়াত ও তারাবীর মাধ্যমে ঘুমাতে দেইনি। (দশ) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম রমজানুল মুবারকে প্রত্যেক কয়েদীকে মুক্ত করে দিতেন এবং প্রত্যেক ভিখারীকে দান করতেন। মহামহিম প্রতিপালকও রমজান মাসে দোযখীদেরকে মুক্তি দেন। সুতরাং রমজানে নেক কাজ করা এবং পাপাচারাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। (এগার) কুরআন করীমে শুধু ‘রমজান’ মাসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেটাই ফযীলত সমূহই বর্ণিত হয়েছে। অন্য কোনো মাসের না সুস্পষ্ট ভাবে নাম আছে, না ফযীলত। মাসগুলোর মধ্যে কুরআন শরীফে শুধু রমজান মাসের নাম নেয়া হয়েছে, নারীদের মধ্যে শুধু বিবি মরিয়ম রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু এর নাম এসেছে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শুধু হযরতে সায়্যিদুনা যায়দ ইবনে হারিস রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু এর নাম নেয়া হয়েছে, যার কারণে ওই তিন জনের মাহাত্ব জানা গেলো। (বার) রমজান মাসের ইফতার ও সাহরীর সময় দু’আ কবুল হয়, অর্থাৎ ইফতারের সময় ও সাহারী খেয়ে। এ মর্যাদা অন্য কোনো মাসে নেই। (তের) রমজানে পাঁচটি ইবাদত বিশেষভাবে সম্পন্ন হয়। (১) রোজা (২) তারাবীহ (৩) তিলাওয়াতে কুরআন (৪) ইতিকাফ এবং (৫) লাইলাতুল কদর। সুতরাং যে কেউ সত্য হৃদয়ে এ পাঁচটি ইবাদত করবে সে ওই পাঁচটি পুরস্কারের উপযুক্ত হবে। (তাফসীরে নঈমী, ২য় খন্ড, ২০৮ পৃষ্ঠা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ফরমান হচ্ছে, নিশ্চয় জান্নাতকে বছরের শুরু থেকে আগামী বছর পর্যন্ত রমজানুল মুবারকের জন্য সাজানো হয়। আরো ইরশাদ করেন, রমজান মাসে প্রথম দিন জান্নাতের গাছগুলোর নিচ থেকে আয়ত-লোচনা হুরদের উপর বাতাস প্রবাহিত হয়, আর তারা আরয করে, হে পরওয়ারদিগার! আপনার বান্দাদের মধ্যে এমন সব বান্দাদেরকে আমাদের স্বামী কর, যাদের দেখে আমাদের চক্ষুগুলো জুড়ায়, আর তারাও যখন আমাদের দেখে তখন তাদের চক্ষু জুড়ায়। (শুয়াবুল ঈমান, ৩য় খ-, ৩১২ পৃষ্ঠা, হাদিস নং ৩৬৩৩)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ফরমান, রমজান শরীফের প্রতিটি রাতে আসমানে সুবহে সাদিক পর্যন্ত একজন আহবানকারী এ বলে আহ্বান করে, হে কল্যাণকামী! আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যের দিকে অগ্রসর হও এবং পরিপূর্ণ কর! অর্থাৎ আনন্দিত হয়ে যাও! ওহে অসৎকর্মপরায়ন! অসৎকর্ম থেকে বিরত হও এবং শিক্ষা গ্রহণ করো। কেউ মাগফিরাত চাওয়ার আছো কি ? তার দরখাস্ত পূরণ করা হবে। কেউ তওবাকারী আছো কি? তার তওবা কবুল করা হবে। কেউ প্রার্থণাকারী আছো কি? তার দু’আ কবুল করা হবে। কোনো কিছুর জন্য প্রার্থনা করারও কেউ আছো কি? তার প্রার্থনা পূরণ করা হবে। আল্লাহ্ তা’আলা রমজানুল মুবারকের প্রতিটি রাতে ইফতারের সময় ষাট হাজার গুনাহগারকে দোযখ থেকে মুক্তি দান করেন। আর ঈদের দিন সমগ্র মাসের সমসংখ্যক গুনাহগারকে ক্ষমা করা হয়। (দুররে মনসুর, ১ম খ-, ১৪৬ পৃষ্ঠা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরাশাদ ফরমান, যে ব্যক্তি মক্কা মুকাররামায় রমজান মাস পেলো, রোজা রাখলো এবং রাতে যথা সম্ভব জেগে জেগে ইবাদত করলো, আল্লাহ তার জন্য অন্য জায়গায় এক লক্ষ রমজানের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। আর প্রতিদিন একটা গোলাম মুক্ত করার সাওয়াব, প্রতি রাতে একটা গোলাম আযাদ করার সাওয়াব, প্রতিদিন জিহাদে ঘোড়- সাওয়ার দেয়ার সাওয়াব এবং প্রতিটি দিনে ও রাতে নেকি লিপিবদ্ধ করবেন। (ইবনে মাজাহ, ৩য় খ-, ৫২৩ পৃষ্ঠা, ৩১১৭ নং হাদিস) হযরত ইব্রাহিম নাখই (রহ.) বলেন, রমজান মাসে একদিন রোজা রাখা (অন্য মাসের) এক হাজার রোযা রাখার চেয়ে উত্তম। রমজান মাসে একবার তাসবীহ পাঠ করা (অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ’ বলা) ওই মাস ব্যতীত অন্য মাসে এক হাজার বার তাসবীহ পাঠ করার চেয়ে উত্তম। রমজান মাসে এক রাকাত নামাজ পড়া, অন্য মাসের এক হাজার রাকাত অপেক্ষা উত্তম। (আদ দুররুল মানছুর, ১/৪৫৪)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।