দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
‘ইসলাম’ অর্থ শান্তি, ইসলাম অর্থ এক আল্লায় আত্ম সমর্পন। ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ উৎসব। আল্লাহ্তে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশিত পথে যে অনুষ্ঠানাদি করা হয়-তাই-ঈদ। পৃথিবীর অন্যসব জাতির আনন্দ উৎসবের সাথে মুসলমানদের রয়েছে বিরাট পার্থক্য। মুসলমানদের ঈদের সাথে ইসলামের চিরন্তন শাশ্বত আদর্শিক ভাবধারার একটা বিরাট সম্পর্ক রয়েছে।
ইসলামের প্রত্যেকটি আনন্দ উৎসব ইতিহাস ভিত্তিক। সুদুর অতীতে ঘটে যাওয়া এক একজন নবী ও রাসূলদের আত্মত্যাগ ও আদর্শকে স্মরণ করেই এ সমস্ত উৎসব। এ ধরনের একটা উৎসব হলো ‘ঈদুল আয্হা বা কোরবানীর ঈদ’। যা নবী, হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর বিষয়। নবী ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্তি হলেন তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য কোরবানী করার। তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, তার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় হলো তার একমাত্র পুত্র সন্তান। তাই তিনি নিজ হাতে নিজ প্রাণাধিক একমাত্র পুত্র হযরত ইসমাঈলকে কোরবানী করেন। যদিও এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা। তাই চোখ খুলে দেখেন যে ছেলের স্থানে পশু দুম্বা কোরবানী হয়ে গেছে।
সাধক হযরত শাহ্ সূফী মীর মাস্উদ হেলাল র্(ঃ) বলতেন, “যারা সন্তানের পিতা মাতা তারা উপলব্দি করতে পারবে নিজ হাতে নিজ প্রানাধিক একমাত্র সন্তান কোরবানী করা কত বড় ত্যাগের দরকার। মা’হাজেরার ভূমিকাও এখানে কম নয়। হযরত ইবরাহীম তার স্ত্রী হাজেরাকে মরুভুমিতে বনবাসে রেখে এলেন তিন মাসের শিশু ইসমাঈল সহ। দীর্ঘ ছয় বছর পর একদিন দেখতে গেলেন তার ছেলেকে। এতটা বছর মা বড় কষ্টে লালন করেছেন সন্তানকে। সে সন্তানকে মা তুলে দিলেন তার স্বামীর হাতে, কোরবানীর জন্য আল্লাহর ইচ্ছায় রাজী হয়ে। এই কোরবানী করে যে সাওয়াব তারা পেয়েছিলেন ঠিক ততটা পরিমান সাওয়াবে ভূষিত করে থাকেন আল্লাহ আখেরী নবীর উম্মতকে পশু কোরবানীর বিনিময়ে রাসূল (সাঃ) এর সম্মানে।”
বেহেস্তি জেওরে মাওলানা থানবী ও বলেছেন যে, নিজের নামে কোরবানী দেয়া অপেক্ষা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর পবিত্র সহধর্মীনি এবং বড়পীর ও নিজ পীর মুর্শিদের পক্ষ থেকে কোরবানী দাও। এতে অনেক বেশী ফায়দা আছে। রাসূল (সাঃ) তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে কোরবানী করেছেন বলে বর্ণনায় জানা যায়। তাই তাঁর প্রিয় উম্মত হিসাবে আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় রাসূলের নামে কোরবানী দেয়া। কোরবানীর উদ্দেশ্য কেবল পশু কোরবানী, নয়, নিজের ভিতর যে পশু প্রবৃত্তি থাকে তাকে কোরবানী করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ঈদুল আযহা, কোরবানী ও হজ্ব এ সবই নবী ইব্রাহীম এর বিষয়। কা’বা ঘর প্রথমে হযরত আদম (আঃ) নির্মাণ করেন। নূহ নবীর সময়ের প্লাবনে এটা ভেঙ্গে যায় এবং মাটি চাপা পড়ে যায়। বহু বছর পরে হযরত ইবরাহীম ও তার ছেলে হযরত ইসমাঈল এটাকে পুনঃনির্মাণ করেন এবং দোয়া চান; “হে, আল্লাহ! তুমি আমার বংশধরদের মধ্য হতে তাদের জন্য এমন একজন মহাসম্মানিত রাসূল প্রেরণ করুন যিনি আপনার বানী সমূহ তাদের পাঠ করে শুনাবে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে। আর তাদের সংশোধন ও পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।” (আল কোরআন) তাঁর এ দোয়ার ফলে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহ তাঁর বংশে পাঠান এবং তাঁকে ইবরাহীম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মিল্লাতের অনুসরণ করতে বলা হয়। যেমন ঃ এখন আমি তোমার প্রতি ওহী প্রেরণ করলাম যে, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের দ্ব¡ীনের (ধর্মাদর্শ) অনুসরণ কর।” (রুকু ১৬-১২৩ আয়াত-সুরাঃ নাহল) রাসূল (সাঃ) মদীনায় আসার পর ১৬ বা ১৭ মাস বায়তুল-মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন। আল্লাহ বলেন, “এবং তোমরা যেদিকে মুখ ফেরাতে সে কিব্লাহ আমরা করে দিইনি।” (২ঃ১৪৩)
এটা ছিল রাসূল (সাঃ) এর ইচ্ছা। মোহাম্মদ ইব্নে আখনাছ বর্ণনা করেন, বনী সালামা গোত্রে উম্মে মীর নাম্মী এক মহিলা ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তার কুশল জিজ্ঞাসা করার জন্যে তার গৃহে যান। মহিলা তাঁর সামনে খাবার রাখেন। আহারের পর যোহর নামাযের সময় হলে রাসূল (সাঃ) বনী সালামার মসজিদে নামায পড়তে গেলেন। দু’রাকআত আদায় করার পর ওহীর মাধ্যমে কেবলা বায়তুল মোকদ্দাস থেকে মসজিদে হারামের দিকে পরিবর্তন করে দেয়া হলো। রাসূল (সাঃ) নামাযের অবস্থায়ই ঘুরে কা’বা গৃহের দিকে মুখ করে নিলেন এবং শেষ দু’রাকআত কা’বার দিকে মুখ করে আদায় করলেন। এ কারনেই এ মসজিদকে মসজিদে কেবলাতাইন বা দু’কেবলার মসজিদ বলা হয়। কারণ কা’বা শরীফের দিকে কিবলা পরিবর্তনের ইচ্ছা বহু আগ থেকেই রাসূল (সাঃ) পোষণ করে আসছিলেন। আল্লাহ বলেন; “আমি, আপনাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, আমি, আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদে হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর।” (সূরাঃ বাকারাঃ ১৪৫ আয়াত)
সময়টা ২য় হিজরী, রজব মাসের, মাঝামাঝি সোমবার। এতে বিরক্ত হয়ে ইহুদীরা মুসলমানদের কিবলা পরিবর্তনের বিষয়ে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করতে থাকে। ইহুদীদের কেবলা ছিল জেরুজালেম। আল্লাহ স্বয়ং ঐ সকল প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে দিকেই মুখ ফিরাও; সে দিকই আল্লাহর”। (সূরাঃ বাকারাহ-১১৫)
একদিন সম্রাট আবরাহা কর্তৃক কা’বা ঘর ভাঙ্গার পরিকল্পনা আল্লাহ বানচাল করে দেন। আল্লাহ তার ঘর রক্ষার ওয়াদা ঠিকই রেখেছিলেন। তখন প্রয়োজনও ছিল। রাসূল, বলেছেন, “কেয়ামত ঘনিয়ে এলে এবং পৃথিবীর ধ্বংস ও বিলুপ্তি নিকটবর্তী হলে দস্যু প্রকৃতির এক হাবসী নিগ্রো যার পায়ের গোছা অপেক্ষাকৃত সরু হবে সে কা’বা বিধস্ত করবে।” (বুখারী) এখানে কিন্তু বলা হয় নাই যে মদীনা ধ্বংস হবে। তবে চিন্তার বিষয় হাবসী নিগ্রো এখানে বিষয়টি যুগোপযোগী চিন্তার ক্ষেত্রে কি হবে। তখন আল্লাহ নিশ্চয়ই তার ঘর রক্ষা করবেন না, এর প্রয়োজন ও নিশ্চয় আছে। এখন প্রশ্ন আসে তখন আমাদের কেবলা কোনটা হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ঈমান মদীনার দিকে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করবে যেমন সাপ নিজ গর্তের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।” এটা কি ইঙ্গিত বহন করে ভবিষ্যৎ সময়ই বলে দিবে। এ হাদীসের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় আলেম ফজলুর রহমান মুন্সী বলেছেন যে, সাপ যেখানেই থাক না কেন ঘুরে ফিরে আপন গর্তেই ফিরে আসে। অনুরুপভাবে ঈমান এবং বিশ্বাস বিশ্বময় বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের সময় আপন ঠিকানা মদীনাতেই আশ্রয় নেবে।” (দ্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ২০-০৫-০৪)
চিন্তাশীলদের চিন্তার খোরাক কোরআন ও হাদীস। আল্লাহ নিজেও তার সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন। হযরত সোলায়মান ও হযরত ইব্রাহীম নবী কর্তৃক নির্মিত মসজিদ যদি কেবলা হতে পারে, তবে কেন নবী শ্রেষ্ঠ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যিনি আমাদের নবী তাঁর নির্মিত মসজিদ কি কেবলা হতে পারে না? বা কেন এতদিন হলো না? যেখানে রাসূলের ইচ্ছাতে কেবলা পরিবর্তন হয়ে গেল। রাসূল (সাঃ) এর জন্ম মক্কা হওয়া সত্বেও কেন মক্কা ছেড়ে চিরদিনের জন্য মদীনায় রয়ে গেলেন? কেন আমাদের দৈনন্দিন ফরজ এবাদত গুলোর মধ্যে আমাদের নবীর নিজস্ব বিষয় নেই? প্রচলিত দুই ঈদ দুই নবীর বিষয়, কেন আমাদের নবীর ঈদ ঈদে মিলাদুন্নবী সেভাবে সাড়া জাগিয়ে আসে না? কেন রাসূল তাঁর পবিত্র জীবনে মক্কায় কোন মসজিদ নির্মান করেন নাই?
ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও অনুশাসন পালনে নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান ও চিন্তা প্রয়োগ করতে হবে। ধর্মের প্রতিটি কথাও কাজের অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণ করতে গেলে বর্তমানে আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখিন হবো। হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে ওমর (রাঃ) বলেছেন, “রাসূল (সাঃ) নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ওমরাহ এবং আরও সব নেকীর কথা গুলো উল্লেখ করে বলেছেন, মানুষ এসব কিছু করে ঠিকই কিন্তু কেয়ামতের দিন নিজের বুদ্ধি জ্ঞান অনুযায়ী সে-এসবের বদলা পাবে।” (মিশাকাত শরীফ)
আল্লাহ বলেন, “রহমানের বান্দা হচ্ছে তারা যাদেরকে তাদের প্রতিপালকের আয়াত স্মরণ করে দিলে তারা অন্ধ ও কানার মতো তার উপর লুটিয়ে পড়ে না, বরং তারা বুদ্ধিজ্ঞান ব্যবহার করে।”
কা’বা ঘর একটা কালো কাপড় দ্বারা আবৃত থাকে, এটাই এর গিলাফ। যা তৈরী করতে ২৪০ জন শ্রমিকের এক বছর সময় লাগে। খরচ হয় ১৭ মিলিয়ন সউদী রিয়াল। বর্তমান সউদী ওহাবী মতাবলম্বী বাদশারা মক্কার কা’বাঘর ও এর গিলাপ এর জন্য যা খরচ করে তার চেয়ে অনেক কম খরচ করে মদীনার মসজিদে নববী ও রাসূল (সাঃ) এর রওজা শরীফ ও তার গিলাপ এর জন্য। কিন্তু কেন? এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
হজ্বের অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ হাজ্বরে আসওয়াদকে বা কালো পাথরকে সম্মান করে চুম্বন করা হয়। সহীহ বুখারী, মুসলিম ও আবুদাউদ শরীফে আছে যে, হযরত ওমর (রাঃ) কালো পাথরটির কাছে আসলেন ও এটাকে চুম্বন করে বললেন, “আমি নিশ্চিত জানি যে, তুমি একটা পাথর মাত্র। তুমি কোন ক্ষতিও কর না এবং উপকারও কর না। আমি যদি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনই তোমাকে চুম্বন করতাম না।”
দুঃখজনক হলো ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসী সৌদি বাদশারা রাসূল (সাঃ) এর রওজা শরীফ ছুয়ে সালাম বা চুম্বন করতে দেয় না, রওজার দিকে মুখ করে দরুদ ও সালাম পাঠ করতে দেয় না। বলে বিদয়াত, বিদয়াত। জ্ঞানও বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে হবে কোনটা বেশী সম্মানিত ও মর্যাদাবান। কালো পাথর না রাসূল (সাঃ) এর রওজাশরীফ যেখানে তিনি অবস্থান করছেন। মকামে ইবরাহীম ও একটা পাথর। হযরত ইবরাহীম ঐ পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কা’বা ঘর নির্মাণ করেন। পাথরটি ইবরাহীম নবীর পায়ের ছাপ ধারন করেছিল। এই মকামে ইবরাহীমকে সেজদার স্থান করা হয়েছে। এই মর্মে একটা বর্ণনা পাওয়া যায় যে, একবার প্রিয় নবীজীকে মক্কার কাফেররা কা’বা শরীফ প্রাঙ্গনে এই বলে চ্যালেঞ্জ করে বসে আমাদের পূর্র পুরুষ ইবরাহীম নবী ছিলেন। তাঁর মুজেযা পাথরের উপর পদচিহ্ন এখনও কা’বা শরীফের সামনে সুরক্ষিত আছে। আপনি ও এমন একটা মু’জেযা দেখান। কাফেরদের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় রাসূল (সাঃ) পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যান। ফলে কম করে সাতটি পাথরের উপর পবিত্র পদচিহ্ন অংকিত হয়ে যায়। প্রশ্ন আসে মকামে ইবরাহীম যদি সেজদার স্থান হতে পারে-তবে মকামে মোহাম্মদ (সাঃ) কেন হতে পারে না? এসবগুলো চিন্তা ও গবেষণার সময় এসেছে। কারণ আজ বিশ্ব মুসলমানের পিঠ বিধর্মীর মার খেতে খেতে দেয়ালে ঠেকে গেছে। বিশ্ব অপেক্ষা করছে আর একটা বিশ্বযুদ্ধের। সম্ভবতঃ যা হবে খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের।
অতীতের নবীদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈশিষ্টের প্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু শ্রেষ্ঠনবীর স্বকীয়তা ও বৈশিষ্টের প্রকাশ কোথায়? কোন নবী যদি নিজ দ্বীন বা তরিকা প্রচার না করে অন্য নবীর দ্বীন বা তরিকা প্রচার করেন বা করতে বলা হয় তাহলে কি সে নবীর স্বকীয়তা ও বৈশিষ্টের পরিপূর্ণ প্রকাশ সম্ভব?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।