Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সিরাজ হত্যা ইতিহাসের পেছনে ইতিহাস

ফা হি ম ফি রো জ | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

নবাব সিরাজকে নিয়ে যারা ইতিহাস গ্রন্থাদি প্রেসমুক্ত করেছেন- এগুলো সবই ব্রিটিশ পোষ্য চাকর-বাকর কর্তৃক রচিত। পলাশী ষড়যন্ত্রে ব্রিটিশদের দুধে ধোয়া রাখার জন্য ব্রিটিশদের নির্দেশেই তাদের অতি অনুগত মুসলিম নফরদের কর্তৃক এসব অন্ধকারময় ইতিহাস লেখা হয়। এর মধ্যে গোলাম হোসেন তবতায়ী (সিরাজের আত্মীয়), গোলাম হোসেন সলীম অন্যতম। ‘মোজাফফরনামা’সহ সামান্য কিছু পুস্তক পলাশীর পরই, ইংরেজ শাসনের পূর্বে সৃষ্টি। এগুলোও সিরাজ নিন্দায় এককাট্টা। এদের মধ্যে জানা যায়, একজন লেখক ছিলেন পলাশীর বিয়োগান্ত, ঘটনার পর ইতিহাস লিখলেও সিরাজের অধ্যায়টি তিনি এড়িয়ে যান। ধারণা করা হয়, তাকে সঠিক ইতিহাস লিখতে বাধাগ্রস্ত করা হয় বা মর্মবেদনায় সিরাজ অধ্যায়ে তিনি হাত দেননি। ফলে প্রায় তিনশো বছর ধরে সিরাজ নিন্দায় একই সুরের বইগুলো আমাদের গিলতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের পেছনের ইতিহাস আছে এবং তার গতিপথ প্রথমটির মতো নয়। সত্যের আলোয় তার পথ-পরিক্রমা। এসব সত্যাশ্রায়ী বইগুলো নানাভাবে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে (ক) অন্ধকারে চুপিসারে কেন সিরাজ মাতা আমেনাকে হত্যা করা হবে? তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করলেও ব্রিটিশদের বাধা দেয়ার কেউ ছিল নাÑ এতটাই ছিল তাদের শক্তিরথের বিস্তার। আমেনা ঢাকার পানিতে ডুবে মরলে বহুদূর মুর্শিদাবাদে তার লাশ নেয়া সম্ভব ছিল না। পচে দুর্গন্ধ হয়ে যেত। আমেনার মৃত্যু বহু পরে, ঢাকায় মারা গেলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের ভাতা পেতেন কিভাবে? তুখোর ফারসি পÐিত আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘নবাব সিরাজ’ গ্রন্থে মুর্শিদাবাদের পুরনো কাগজ ঘেঁটে এতথ্য পেয়েছেন। যাকারিয়ার তথ্যে কোনোভাবেই আমেনাকে ধলেশ্বরীতে হত্যার প্রকৃত সত্য নেই। (খ) মীরন বজ্রাঘাতে নিহত হন। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক তথ্য। তাকে তাঁবুর মধ্যে ঝড়-বাদলের ভেতর হত্যা করা হয়। বজ্রাঘাতে নিহত হলে তার কপালে, তরবারিতে, পেটে কিছু ক্ষতচিহ্ন থাকবে কেন? অনুমান এগুলো গুলির দাগ। বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলে এ ধরনের চিহ্ন থাকবে না। গোলাম হোসেন তবতায়ী এসব মিথ্যার মেলবন্ধনে ‘সিয়রে মুতাক্ষিরীণ’ ঢাউস গ্রন্থটি রচনা করেন।

(গ) সিরাজকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয় পশ্চিম তীরে, মীর জাফর, কয়েকজন ব্রিটিশ কূটনৈতিক এবং দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সামনে। লর্ড ক্লাইভ তখন সামান্য দূরে। সিরাজকে দ্রæত এরেস্ট করা এবং এ বিষয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারিখসহ উল্লেখ করেছেন সম্প্রতি এদেশের আরেক পÐিত সলীমুল্লাহ খান। তিনি তার অনুসন্ধানী গবেষণায় সিরাজের এরেস্ট এবং মৃত্যুর বিষয়ে তারিখসহ ক্লাইভ এবং মীরজাফরের চিঠিগুলো উত্থাপন করেছেন ‘সত্য সাদ্দাম হোসেন’ এবং ‘সিরাজ উদ দৌলা’ মিনি গ্রন্থে। যা এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য ইতিহাসের উত্তম দাওয়াই।

সত্যের শক্তি অপরিসীম। তাকে চেপে রাখা যায় না। ক্লাইভের ভোগবিলাস-অন্ধকার জীবনচিত্র আজও বের হয়ে আসছে। ক্লাইভের বংশ নিম্নশ্রেণীর। দেখতে দিলেন অসুন্দর, উচ্ছৃঙ্খল। কিশোর বয়সে নিজ দেশে ছিলেন বর্শা টানা যুবক, বেকার। পলাশী লুটের পর একবার কাউকে লিখেছিলেনÑ ‘যত টাকাই লাগুক আমার দুইশ শাটের কাপড় দরকার’। পলাশীর ঘটনার পর ব্রিটেনে তার পরিচিতি ছিল খুবই লজ্জাকর, হাস্যকর। তিনি নীচু বংশের সন্তান হয়ে নবাবগিরি দেখাতেন ইংল্যান্ডে। এ নিয়ে লোকজন হাসাহাসি করতেন। রুমে রুমে কাপড় স্তূপ করে রাখতেন। অনুমান করা হয়, একবার যে কাপড় পরিধান করতেন, দ্বিতীয়বার নতুন আর একটি পড়তেন। এসব গুছিয়ে রাখার সময়ও মানসিকতা তার ছিল না। নবাবী সম্পদ লুটের কি উত্তাপরে বাবা! বেতন দিতেন স্বদেশী চাকরদের অনেক বেশি। তাই তার দেশের চাকরদের চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অন্যখানে কাজ করলে তারা বেশি অর্থ দাবি করতেন। এভাবেই ব্রিটিশ চাকরদের চরিত্র সে সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মেকলের বইতে ক্লাইভ বিষয়ে বহু অজানা তথ্য রয়েছে।

সিরাজের প্রকৃত মৃত্যু নিয়েও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গবেষক কালীপদ দাশ একবার আমাকে বলেছিলেনÑ ‘বন্দিঘরের কুলঙ্গী দিয়ে মাথায় গুলি করে ব্রিটিশরা নবাবকে হত্যা করে।’ শতবর্ষ পুরনো অবিনশ্বর রাম চক্রবর্তীর লেখা ‘বেজগাঁ ইতিহাস’ বইটি এখন মার্কেট শূন্য। তার নাতির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক। এটি ২৫-৩০ বছর আগে, যারা পাঠ করেছেন, তারা জানিয়েছেন, ব্যতিক্রমী বই। সিরাজকে ভাগীরথীর পূর্ব তীরের নদীর পাড়ে, গাছে ঝুলিয়ে, শিরা পরীক্ষা করে হত্যা করা হয়। লুক স্কাফটনের নির্দেশে এ হত্যাকাÐ হয়েছিল। এটি ছিল সম্ভবত ৩রা জুলাইয়ের পরের দিনের ঘটনা। এটি সিরাজের দ্বিতীয় মৃত্যু।

যুদ্ধের সময় রাজবল্লভ ভয়ে পলাশী ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদে আসেন। পরের দিন পশ্চিম তীরে সিরাজ প্রাসাদের বারান্দায়, মিলাদের জন্য পাঁচটি ঘোড়ায় করে মিষ্টি আনেন। লোকজন এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেনÑ ‘আমরা বিজয়ী হয়েছি’। যুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি সিরাজের লোক নিহত হয় পলাশীর দেবীগঞ্জ ঘাটে। নামটা কিছু ভুলও হতে পারে। এ ঘাট দিয়ে নবাবী পক্ষ পলায়ন করতে চাইলে ভোজালীÑবল্লম দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। নিহতের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। পলাশীর আরেক ইতিহাসপ্রেমী হাসিবুর রহমান এ ঘাটের একটি ছবিও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন সম্প্রতি। তার পূর্বপুরুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। হাসিবুরের বাড়ি সেই পলাশীতেই। ওখানকার অতিবৃদ্ধদের মতে, তারা পূর্বপুরুষদের কাছে যা শুনেছেন, তা হলোÑ হাজার হাজার নবাব পক্ষীয়দের পেছন দিক দিয়ে হত্যা করা হয়। নদীতে, তীরে হত্যা করা হয়। ভাগীরথী পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ চাকরদের লেখায় এসব অনুপস্থিত।

যতই দিন যাবে ইতিহাসের পেছনে ইতিহাস সৃষ্টি হতে থাকবে। বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য। আমরা সেই প্রকৃত সত্যের দিকেই কাত হয়ে আছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিরাজ হত্যা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ