বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. আব্দুল হাই তালুকদার : অবসরে থাকার পরে বিচারপতিদের রায় লেখা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও বিচারাঙ্গনে তুমুল ঝড় উঠেছে। গত ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির এক বছর পূর্তিতে তিনি এক বিবৃতি দেন। ১৯ জানুয়ারি রাতে বিবৃতিটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয় ‘কোন কোন বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক দেরি করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’ বিচারপতি সিনহা অত্যন্ত বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বিচারক দীর্ঘকাল তিনি বিচার কাজের সাথে জড়িত ফলে তার অভিজ্ঞতা প্রচুর। বিচারিক রায়ের ফলাফল, প্রভাব ও কার্যকারিতা দেখেই সম্ভবত তার এই উপলব্ধি। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ইদানীং তার বক্তব্য বিবৃতিতে বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে বেশকিছু উক্তি করেছেন। বিচারক যখন রায় দেন সেক্ষেত্রে তাকে অগ্র-পশ্চাৎ, ভালো-মন্দ, পরিবেশ-পরিস্থিতি, জনমনে ও জনজীবনে এর ফলাফল সবকিছু বিবেচনায় নেন। কোন রায়ের ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরূপ ও তিক্ত ফলদায়ক হতে পারে কিনা বিচারক তাও বিবেচনায় নিতে পারেন। সে কারণে কোন রায় বৃহত্তর কলেবরে কোন অশুভ ও বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে একজন বিচারক তাও বিবেচনায় নেন। তাই বিচারকের রায় জনসম্মক্ষে প্রকাশ করতে হয়। বিচারক যখন অবসরে যান তার শপথ শেষ হয়ে যায়। তিনি তখন একজন সাধারণ নাগরিক হয়ে যান। সাধারণ নাগরিকের যেমন আদালতের কোন বিষয়ে কথা বলার অধিকার থাকেন তেমনি অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারকেরও কোন রায় দেয়া সমীচীন নয় বলে প্রধান বিচারপতি উপরোক্ত বিবৃতিটি দিয়েছেন।
বিচারপতি সিনহা আরও বলেছেন, ‘বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর আর কোন রায় লিখতে দেয়া হবে না। আমরা এক আজব দেশে বাস করি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিচারকরা অবসরে যাবার পর কোন রায় লিখতে পারেন না। আমাদের দেশে অতীতে এ রকম রায় দিলেও এখন থেকে আর এ সুযোগ দেয়া যাবে না। আইন ও সংবিধান রক্ষায় আমাদের সংশোধিত হতে হবে ইত্যাদি।’ জনাব সিনহা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিচার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। মৌলভীবাজারে আইনজীবী সমিতির বার্ষিক নৈশভোজ সভা অনুষ্ঠানে ২১ তারিখে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আমাদের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে আইনজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আরও যতœশীল হতে অনুরোধ করেন। তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, ‘আপনারা হলেন সমাজের বিবেকবান মানুষ। আইন পেশাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করবেন না। আপনাদের দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। বর্তমানে আমরা দেখতে পাই জাতীয় ও স্থানীয়বারের নির্বাচনে সভাপতি ও সেক্রেটারি কে হবেন এটা রাজনীতিবিদরা নির্ধারণ করে দেন। এমনটা হবার কথা নয়’। তিনি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সাথে বিচারাঙ্গনের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে একসাথে কাজ করার উপর গুরুত্ব দেন।
তার বক্তব্য বিচারাঙ্গনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিতবহ। বিচারালয়ে কোন রকম গোপনীয়তা না রেখে প্রকাশ্যে রায় দেয়া বাঞ্চনীয় এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, “কোন বিচারপতি অবসরে গেলে তিনি শপথ থেকে মুক্ত হয়ে যান। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে রায় লেখা ও তাতে স্বাক্ষর করার কোন সুযোগ নাই। তাছাড়া কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুল ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলে স্পষ্ট বলা আছে, যে কোন মামলার রায় প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করতে হবে ও স্বাক্ষর দিতে হবে। কোন বিচারপতি অবসরে গেলে তার পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা বা তাতে স্বাক্ষর করার সুযোগ কোথায়? আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা সঠিক।”
সাম্প্রতিক বছরগুলাতে সবচেয়ে আলোচিত রায় হলো, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ক রায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসর গ্রহণের পর এ রায় লিখেন। তিনি অবসরে যাবার দীর্ঘদিন পর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ বলে রায় লিখেন। এ রায়ের আলোকে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। এ সংশোধনীর পর থেকে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় দেশ থেকে শান্তিশৃঙ্খলা উধাও হয়ে যায়। বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ বললেও আরও দুটো মেয়াদে একই পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে মত দেন। বিরোধী দল বিএনপি প্রথম থেকেই এই পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে মতামত দিলেও সরকার তড়িঘড়ি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অনেক আগেই সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে। আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর থাকে। বিএনপি নেত্রী তথা বিশদলীয় নেত্রীর সাথে চৌদ্দদলীয় জোট বাদে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল থেকে আপত্তি জানানো হয়। সকলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জানায়।
আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আবশ্যকতা, ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার কথা বলে বারবার সরকারকে ব্যবস্থাটি পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও বিরোধী দল থেকে এ বিষয়ে বারবার আহ্বান ও তাগিদ দেয়া হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিবৃতির পর বিরোধী দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্ট বার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় অবৈধ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। এটা ফিরে আসবে।’ ১৯ তারিখে সংবাদ সম্মেলন থেকে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণের নিয়োগপ্রাপ্তির পর সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ গ্রহণপূর্বক তার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। বিচারক হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের যে শপথ বিচারক হিসাবে গ্রহণ করেন অবসরের পর তিনি আর শপথের আওতায় থাকেন না।’ তিনি আরও বলেন অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে বিচারপতি খায়রুল হক যে রায় দেন তার কোন সাংবিধানিক ভিত্তি নাই এবং তা অবৈধ। সরকার ঐ রায়ের সুযোগ নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর দ্বারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে রাজনৈতিক অঙ্গনকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার যে আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করায় তা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়। আজ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অভাবে সংকট, অস্থিরতা, মারামারি, হানাহানি অবলীলায় চলছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না বলে দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সুফল এদেশের মানুষ ১৯৯০ সাল থেকে পর পর কয়েকটি নির্বাচন দেখেছে। এবস নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ ঐ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির উপর অনেকগুলো জরিপ হয়েছে। অধিকাংশ জরিপে মানুষ এই পদ্ধতির পক্ষে রায় দিয়েছে। ঐ সময়কালে বহুল প্রচারিত ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার জরিপে দেশের ৯০% মানুষ পদ্ধতিটি চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল। সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে একগুঁয়েমিভাবে তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রসর হয়। ফলে সংকট, সংঘাত, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে অনুষ্ঠানের প্রবল বিরোধিতা করতে থাকে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক চিকিৎসার টাকা ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের একটা চাকরি পাবার জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে রাজার মত ক্ষমতা দিয়েছেন। ২১ তারিখ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশবাসীর ওপর আওয়ামী লীগের আক্রমণের চরিত্রটা অনেকটাই গণহত্যার মতো। তিনি বাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসা ছাত্র হত্যা ও মাদ্রাসা ছাত্রদের ওপর আক্রমণের প্রসঙ্গ টানেন।
বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করায় মানুষ খুবই হতাশ ও উদ্বিগ্ন। বিরোধী দল বিচারপতি খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করায় রাজনৈতিকভাবে খুবই সংকটে পড়ে। কারণ সরকার সুযোগটির সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকা- সীমিত করে ফেলে। এ সংশোধনীর বিরোধিতা করে সকল রকম রাজনৈতিক কর্মসূচি কঠোর হস্তে দমন করতে থাকে। মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ করতে প্রবলভাবে বাধা দেয়া হয়। রাজনৈতিক কর্মকা-কে সন্ত্রাসী কর্মকা- হিসেবে চিহ্নিত করে তা কঠোর ও নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। দেশে শুরু হয় হত্যা, গুম ও খুনের রাজনীতি। বিরোধী দল দমনে হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়। মামলা, হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন, গুম, খুনে জর্জরিত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা নাস্তানাবুদ হতে থাকে। দেশ পরিণত হয় পুলিশি রাষ্ট্রে। সরকারের পেটুয়া বাহিনী অকাতরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করতে থাকে। দেশে শুরু হয় একদলীয় একপক্ষীয় নির্বাচন। ১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন এক তামাশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। বাকি ১৪৭ আসনে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিরোধী দল এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে মধ্যবর্তী অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবি করতে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করায় সরকার একপক্ষীয় নির্বাচন করার সুযোগ পায়। ফলে গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস হতে থাকে। গণতন্ত্র বিকশিত হবার বদলে সংকুচিত ও নিঃশেষ হতে থাকে। খোদার এক বিশেষ দেশে পরিণত হয় বাংলাদেশ। একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন চলতে থাকে। একটি বিশেষ দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক মাঠে চষে বেড়ালেও বিরোধী দল রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিতাড়িত হয়। ফলে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। গণতন্ত্রের অভাবে দেশে আইনের শাসন বিনষ্ট হয়। সুশাসনের অভাবে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে যায়। দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, নদী দখল, খাল-বিল-জলাধার দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, রাহাজানি, লুণ্ঠন, ধর্ষণ প্রভৃতি কর্মকা-ে দেশ ছেয়ে গেছে। আইনের শাসনের অভাবে, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নাই। বিরোধী দলের কর্মকা- না থাকায় সরকার খুশিমত কাজ করছে। জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা না করে সরকার নিজ স্বার্থ ও খুশিমত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর। বিশ্ববাজারের সাথে তাল মিলায়ে সরকার জনস্বার্থে জিনিসপত্রের দাম না কমিয়ে বাড়িয়ে চলেছে। বিদ্যুতের দাম ৭/৮ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সারা দুনিয়ায় তেলের দাম কমতে কমতে সর্বনি¤œ পর্যায়ে এলেও সরকার তেল গ্যাসের দাম কমানোর বদলে বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। তেলের দাম না কমায় পরিবহন ভাড়া কমছে না।
নির্বাচনী ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয়েছে। দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ নাই। দেশে প্রকৃতপক্ষে কোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে না। চরদখল ও ভূমি দখলের মত নির্বাচনী মাঠ একটি বিশেষ দলের দখলে। ভোটের আগের দিন রাতে বাক্স ভরাট করে রাখা হচ্ছে। বিরোধী দলকে নির্বাচনী মাঠের বাইরে রেখে ফাঁকা ফিল্ডে গোল দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনী কারচুপি, জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতি দেখে দেশের মানুষের সাথে বিদেশী দাতা সংস্থা ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলো স্তম্ভিত, হতবাক ও বিস্মিত হচ্ছে। নির্বাচনী অনিয়ম ও জালিয়াতির তদন্ত না হওয়ায় বিদেশী বন্ধুরা ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। বিদেশে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান একটি প্রকল্প থেকে অর্থ ফেরত নিচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ ফেরত নেয়া সরকার ও দেশের জন্য লজ্জার ব্যাপার। এর আগে বিশ্ব ব্যাংক ও জাইকার সাথে অনেক দাতা সংস্থা অনেক প্রকল্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ব্যাংক লুটপাট ও জালিয়াতি কথা বলা বাহুল্য। শেয়ার বাজার কেলেংকারি দরিদ্র ও সীমিত পুঁজির মানুষকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ৮০০০ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ইতোমধ্যে ২৮০০০ কোটি টাকায় উন্নিত হয়েছে। দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২১ জানুয়ারি ইনকিলাবে লিডনিউজ হয়েছে ‘১০ মেগা প্রকল্প : দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি’। কোন কোন প্রকল্পে ২০০ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। সময় বাড়ানো হচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায় সরকারের ১০টি প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগে স্থবিরতা। ফলে হু হু করে বেকারত্ব বাড়ছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ যুবক শ্রম বাজারে প্রবেশ করলেও বিনিয়োগ অভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, আমলতান্ত্রিক জটিলতা প্রভৃতি কারণে দেশে-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন না।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো জনশক্তি রফতানী খাত। এ খাতে চরম মন্দাবস্থা। সিঙ্গাপুর থেকে জঙ্গি সন্দেহে বাংলাদেশের ২৬ নাগরিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তারা নাকি আলকায়দা, আইএসের মতো সশস্ত্র জিহাদি সংগঠনের সদস্য। স্টেইট টাইমস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে জানায় ‘তাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে জিহাদে অংশ নিতে চেয়েছিল। তবে সিঙ্গাপুরের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল না। সিঙ্গাপুর সরকার তাদের সকলের কাজের অনুমতি বাতিল করে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য ১২ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়। ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করায় সিঙ্গাপুর সরকারের দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো। এসব জঙ্গি সিঙ্গাপুরের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকা- না চালিয়ে বিদেশে কর্মকা- পরিচালনার কথা ভাবছিল। প্রশ্ন হলো বিদেশীরা বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছে। বাংলাদেশ কি জঙ্গিবাদের আখড়া? আমাদের ভয় হয় জনশক্তি রফতানীতে এমনিতেই ধস নেমেছে। শ্রমবাজার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। এসব বাজারে কেবল আশ্বাস পাওয়া গেলেও ফলাফল শূন্য। নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে না। এর উপর জঙ্গি রাষ্ট্রের পরিচিতি পেলে বাংলাদেশের ভাগ্যে কী ঘটবে?
প্রধান বিচারপতির বক্তব্যেই স্পষ্ট খায়রুল হকের রায় ও বর্তমান সরকার অবৈধ : বিএনপি। বিএনপির দাবীর যৌক্তিকতা আছে। বিচারপতি খায়রুল হকের রায় থেকে বর্তমান সমস্যা ও সংকটে দেশ ও জাতি জর্জরিত। গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। গুলশানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, প্রধান বিচারপতি বক্তব্যে শুধু খায়রুল হকের রায়ই নয়, অবৈধ রায়ের ভিত্তিতে গঠিত সরকারও অবৈধ। আমরা মনে করি রাজনৈতিক বিষয়কে বিচারালয়ে টেনে আনা সঠিক নয়। রাজনৈতিক বিষয়কে রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। আদালতের রায়ে সমাধান করতে গিয়ে কতরকম সমস্যা-সংকট ও বিপত্তি ঘটেছে। এতে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে যাতে এদেশের জনগণের জান-মাল বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হচ্ছে ও দেশের সামাগ্রিক উন্নয়ন অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই অনতিবিলম্বে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন জরুরি। গভীর রাজনৈতিক সংকট নিরসন করতে সংলাপ শুরু করুন।
লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।