দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন কিছু কালের জন্য। মৃত্যুই তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রায়ই মানুষ কারো না কারো মুত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। তা সত্তে¡ও সে তার উপর ন্যস্ত বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উদসীন থাকে। কিন্তু যখন মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য থাবা তাকে কাবু করে ফেলে, তখন সে অন্তিম মুহূর্তে অস্থিত অবস্থায় অনুসন্ধান করে সারা জীবনের দায়িত্ব অবহেলার ক্ষতিপূরণ আদায় করার কোন উপায় আছে কিনা। ইসলামী আইনে সেই মুহূর্তে ক্ষতিপূরণ করার একটি মাত্র পথ আছে, তা হলো ওসিয়্যাত। ওসিয়্যাতের মাধ্যমে বিত্তশালী জীবনের অন্তিম মুহূর্তে যেমন গরীবের উপকার করতে পারে তেমনি অনেক সময় এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সামাজিক কাজও সম্পন্ন করা যায়। সে জন্য ইসলামী শরীয়তে ওসিয়্যাতের আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ওসিয়্যাতের শাব্দিক অর্থ : ওসিয়্যাত আরবী শব্দ যার অর্থ উপদেশ, পরামর্শ, সুপারিশ, আদেশ, উইল। “ড. মুহাম্মদ ফজলু রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ২০০৩, পৃ: ৮২৯।” ‘অ উরপঃরড়হধৎু ড়ভ গড়ফবৎহ ডৎরঃঃবহ অৎধনরপ’এ ওসিয়্যাতের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে, উরৎবপঃরড়হ, ওহংঃৎঁপঃরড়হ, উরংঢ়ড়ংরঃরড়হ, ওহলঁহপঃরড়হ, ঙৎফবৎ, ডরষষ, জবয়ঁবংঃ. ‘‘ঐধহং ডবযৎ, অ উরপঃরড়হধৎু ড়ভ গড়ফবৎহ ডরৎঃঃবহ অৎধনরপ, ঘবুিড়ৎশ: ঝড়ঢ়শবহ খধহমঁধমব ঝবৎারপবং, ওহপ., ১৯৭৬, চ. ১০৭৫’’.
সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ-এ ওসিয়্যাতের অর্থ করা হয়েছে, ভার অর্পণ, নির্দেশ। পারিভাষিক শব্দ হিসাবে শেষ ইচ্ছা, ইচ্ছাপত্র বা ইচ্ছাপত্র যোগে প্রদত্ত সম্পত্তি। “আ.ফ.ম. আবদুল হক ফরিদা ও অন্যান্য সম্পাদিত, সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০১, খ.১,পৃ: ২৫২।”
‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে রয়েছে, ওসিয়্যাত শব্দের অর্থ উপদেশ, মিলানো অর্থাৎ কোন জিনিস অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছানো। “গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯৫, খ.১,পৃ: ৭২৩।” ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ গ্রন্থে রয়েছে, ওসিয়্যাত শব্দের অর্থ কোন কাজের অঙ্গীকার গ্রহণ করা, নির্দেশ প্রদান করা। “মাওলানা উবায়দুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ফাতাওয়া ও মাসাইল, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০১, খ.৬, পৃ: ৪৭৯।”
ওসিয়্যাতের পারিভাষিক অর্থ : ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ওসিয়্যাত বলা হয়, “কাউকে বিনিময়বিহীন কোন কিছুর মালিক বানানো, যা ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর কার্যকর হবে। “প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৭৯।” ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি বা এর আয় তার মৃত্যুর পর হতে চিরকালের জন্য অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য অপর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুক‚লে কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই হস্তান্তর করাকে ওসিয়্যাত বলে। “গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত, পৃ: ৭২৩।” ‘ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থে রয়েছে, কোন বস্তু কিংবা তার মুনাফা সম্পর্কে বলে দেয়া অথবা লিখে দেয়া যে, আমার মৃত্যুর পর এটা অমুকের হবে। ইসলামী অনুশাসনে এরূপ অনুরোধকে ওসিয়্যাত বলা হয়। “মাওলানা হিফজুর রহমান, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অনুবাধ: মাওলানা আবদুল আউয়াল, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০০, পৃ: ২৯৮।”
ওসিয়্যাতকারীকে ফিক্হ শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘মূসী’ ওসিয়্যাতকৃত বস্তুকে ‘মূসা বিহি’ এবং যার অনুক‚লে ওসিয়্যাত করা হয়, তাকে ‘মূসা লাহু’ এবং ওসিয়্যাতকারী ওসিয়্যাতকৃত সম্পত্তি পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি হিসাবে যাকে নিযুক্ত করে তাকে ‘ওসী’ বলে। “গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত, পৃ: ৭২৩।”
ওসিয়্যাতের শর্তাবলী : ইসলামী শরীয়তে কার্যকর করার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। ওসিয়্যাত সংক্রান্ত শর্তাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি বিনিময়বিহীন দান করার অধিকার হতে হবে। সুতরাং শিশু বা উন্মাদের ওসিয়্যাত কার্যকর হবে না। শিশু বা উন্মাদের ওসিয়্যাত কার্যকর না হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি এই যে, ওসিয়্যাত হচ্ছে স্বেচ্ছাদান আর শিশু স্বেচ্ছাদানের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া শিশুর বক্তব্য অবশ্য সাব্যস্তকারী নয়। অথচ তার ওসিয়্যাতের সিদ্ধান্ত দানের অর্থ হলো তার বক্তব্যকে অবশ্য সাব্যস্তকারী বলে সিদ্ধান্ত দেয়া। “বুরহান উদ্দীন আলী ইব্ন আবু বকর আল মারগীনানী, আল হিদায়া, অনুবাদ: মাওলানা আবু তাহের মেছবাহ ও মাওলানা ইসাহক ফরিদী, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০১, খ.৪, পৃ: ৫২০।”
যেহেতু মানুষের মৃত্যুর পর ওসিয়্যাত কার্যকর করার পূর্বে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, এজন্য ওসিয়্যাতকৃত বস্তু ঋণগ্রস্ত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কেননা দুটি প্রয়োজনের মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে ঋণের বিষয়টি ওসিয়্যাতের চেয়ে অগ্রবর্তী হবে। ঋণ পরিশোধ করা হলো ফরজ আর ওসিয়্যাত হলো স্বেচ্ছাদান, আর সব সময় পর্যায়ক্রমে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারাই কাজ শুরু করা হয়। “প্রাগুক্ত, পৃ:৫১৯,৫২০।” কাজেই ঋণগ্রস্ত সম্পদের ওসিয়্যাত সিদ্ধ নয়।
যার জন্য ওসিয়্যাত করা হবে সে ওসিয়্যাতের সময় জীবিত থাকতে হবে। চাই সে প্রকৃত পক্ষে জীবিত হোক অথবা জীবিতের হুকুমে হোক। সুতরাং মাতৃগর্ভের যে সন্তান এখনো রূহ প্রাপ্ত হয়নি, তার জন্য ওসিয়্যাত করা যাবে। “মাওলানা উবায়দুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ফাতাওয়া ও মাসাইল, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৭৯।” এ ক্ষেত্রে ওসিয়্যাতের সময় মাতৃগর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব প্রতীয়মান হতে হবে এবং ওসিয়্যাত সম্পাদনের ছয় মাসের মধ্যে ভূমিষ্ট হতে হবে। এই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার অনুক‚লে কৃত ওসিয়্যাত কার্যকর হবে না। “গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত, পৃ: ৭৩৬।”
যার জন্য ওসিয়্যাত করা হবে, ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর সময় সে তার ওয়ারিস হতে পারবে না। অবশ্য এ শর্তটি তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন ওসিয়্যাতকারীর অন্য কোন ওয়ারিস বিদ্যমান থাকে। অন্য কোন ওয়ারিস না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওয়ারিস হলেও তার জন্য ওসিয়্যাত করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেকের অধিকার যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন, সুতরাং ওয়ারিসগণের জন্য কোন ওসিয়্যাত নেই।” “ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-ওসায়া, অনুচ্ছেদ: মা জালা লা ওসিয়্যাতা লি-ওয়াররাছ, কায়রো: দারুল হাদীস, তা.বি.,খ. ৪, পৃ: ৪৩৩, হাদীস নং ২১২০; হাদীসটির সনদ সহীহ, মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং- ২১০২০।” ওয়ারিস বিশেষের অনুক‚লে ওসিয়্যাত করা হলে অপরাপর ওয়ারিসের স্বার্থহানী ঘটতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ ও সম্পর্কচ্ছেদ ঘটবে। অথচ উভয়টিই হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, “ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।” “আল-কুরআন।”
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “কোন একজন নারী বা পুরুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঘাট বছর আমল করল। অতঃপর যখন মৃত্যু উপস্থিত হলো তখন তারা ওসিয়্যাতের ক্ষেত্রে অন্যের অনিষ্ট করলো। তাহলে উভয়ের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যাবে। “ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-ওসায়া, অনুচ্ছেদ: আয-যিরার ফিল ওসিয়্যা, প্রাগুক্ত, খ.৪, পৃ: ৪৩১, হাদীস নং- ২১১৭;
হাদীসটির সনদ যঈফ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২১১৭।” তবে অন্যান্য ওয়ারিস যদি অনুমোদন করে তাহলে ওসিয়্যাত করা যাবে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের অধিকারের কারণে। সুতরাং তাদের অনুমোদন প্রদানের কারণে তা জায়িয হবে। “বুরহান উদ্দীন আলী ইবন আবুবকর আল মারগীনানী, আল হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫১৭।” ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর পর ওসিয়্যাতকৃত বস্তুটি অপরের মালিকানায় দেয়ার উপযুক্ত হতে হবে। চাই তা কোন সম্পদ হোক অথবা সম্পদ থেকে উপকৃত হওয়া যায় এমন কোন কিছু হোক তা তৎকালে বিদ্যামান থাকুক বা না থাকুক। “মাওলানা উবায়দুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ফাতাওয়া ও মাসাইল, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৭৯,৪৮০।” মূসা বিহি বা ওসিয়্যাতকৃত সম্পদ অবশ্যই মূল্যবান সম্পন্ন জিনিস হতে হবে। যেমন কোন মুসলমানের জন্য মদ, শুকর ইত্যাদি মূল্যবান সম্পন্ন জিনিস নয়। সুতরাং এগুলোর ওসিয়্যাত বৈধ নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই, তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করো না। “আল-কুরআন।”
৬. কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম ব্যক্তির অনুক‚লে এবং কোন অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তির অনুক‚লে ওসিয়্যাত করতে পারে। প্রথমটির ব্যাপারে কুরআনে এসেছে, “দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না, আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।” “আল-কুরআন ২:২৬৭।” আর দ্বিতীয়টি যুক্তি এই যে, যিম্মাচুক্তির মাধ্যমে মুআমালাতের লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের সমান হয়ে পড়েছে। এ কারণেই জীবদ্দশায় উভয়পক্ষ হতে স্বেচ্ছাদান বৈধ রয়েছে। সুতরাং মৃত্যুর পরও তাই হবে।
৭. যদি কোন ব্যক্তি একাধিক ওসিয়্যাত করে তাহলে দেখতে হবে যে, ওসিয়্যাতসমূহের সমষ্টি এক তৃতীয়াংশ হয়, তাহলে তা ওসিয়্যাতকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। তবে কোন অবস্থাতেই এক তৃতীয়ংশের বেশি সম্পদের ওসিয়্যাত করা যাবে না। হাদীসে এসেছে- “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলো, আমি কি আমার পুরো সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, না। তারপর আবার বলল, অর্ধেক সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, না। তারপর আবার বললো, আমি কি এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ। এক তৃতীয়াংশই অনেক।” (চলবে)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।