Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে

বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বচ্ছল ও উচ্চ আয়ের মানুষকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বাজেটে প্রান্তিক মানুষের জন্য রয়েছে প্রান্তিক সুবিধা। তবে বাজেটে মধ্যবিত্তের খুব বেশি সুবিধা হবে না। ধনীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে।
গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনায় এমননি জানায় সংস্থাটি। অনুষ্ঠানে সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট উম্মে শেফা রেজবানা, মোস্তফা আমির সাব্বিহ, সারাহ সাবিন খানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে খাতওয়ারি বরাদ্দের দিক থেকে বাজেট ভারসাম্যহীন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে ধনীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এটা অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে। বিকাশমান মধ্যবিত্তরাই হলো চালিকা শক্তি। তাদের চিন্তা, চেতনা, উপার্জন, বুদ্ধিমত্তা এগুলোই হলো চালিকাশক্তি। সেই চালিকাশক্তিকে যদি সেভাবে পরিমাপ না করেন, তাহলে ইশতেহার চেতনা সম্পূর্ণ বিফল। এটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ, ভোটের ভিত্তি পরিপন্থি, এটাই দুশ্চিন্তার বিষয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে ড. দেবপ্রিয়’র কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাজেটে বেশি সুফল কারা পাবে? জবাবে তিনি বলেন, এটা স্বচ্ছ যে বাজেট উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুযোগ দিচ্ছে। অল্প আয়ের মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে একধরনের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এটা থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ব্যয় মোট জিডিপি অনুপাতে বৃদ্ধি না পাওয়ার বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারে না ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারে না, তাদের জন্য আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? গণপরিবহন-সংকটে যারা, তাদের জন্য গণপরিবহন তৈরি হচ্ছে কি না, তাদের শিশুরা সে রকম মানে উচ্চ শিক্ষা পাচ্ছে কি না, এটিই বড় বিষয়।
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরা এবং সেগুলোর সমাধানের কোনও আভাস বাজেটে নেই উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে বাজেটে আলোচনা আছে, কিন্ত কর্মপরিকল্পনা নেই। ব্যাংকিং খাতের সমস্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে সিপিডির এ ফেলো বলেন, ব্যাংক খাত থেকে যারা সুবিধা নিয়েছেন, তারা ব্যাংকিং কমিশন হোক চান না। কমিশন হলে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। তথ্য উপাত্তের সমস্যা আছে, সেগুলো প্রকাশিত হবে, জবাবদিহীতা বাড়বে। যারা এ খাত থেকে অন্যায্য সুবিধাগুলো নিয়েছেন, তারা এ পরিবর্তনগুলো আনতে দিতে চান না। তিনি জানান, সরকারি টাকায় অবকাঠামো নির্মাণ করে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার প্রতিফলন তিনি এ বাজেটে দেখছেন না। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীতে পৌঁছে দেওয়ার যে অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, তা পূরণের স্পষ্ট কোনো রূপরেখা বা কর্মসূচি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটে রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন দেবপ্রিয়।
প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, তাতে ৭, ৮, ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কষ্টকর হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, যেই সমাজে বৈষ্যম বৃদ্ধি পায়, সেই সমাজ আজ হোক কাল হোক টেকে না, আগাতে পারে না। সেই সমাজগুলোতে প্রবৃদ্ধির হারে পতন ঘটে। যে ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্যম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ৭, ৮, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কষ্টকর হবে। এটা ঐতিহাসিকভাবে অর্থনৈতিক তত্বে সত্য। ‘বাংলাদেশ তো সৃষ্টি হলো বৈষ্যমের কারণে। দেশটা তো টিকলোই না বৈষ্যমের কারণে। আপনারা বুঝতে পারছেন কোন জায়গাতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হয়েছে বৈষ্যমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তো ওই বৈষম্য যদি দেশের ভিতরে বাড়তে থাকে তাহলে আগামীদিনে আমি কেমন করে ওই জায়গাতে (সমৃদ্ধ বাংলাদেশ) পৌছাবো। তিনি বলেন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পৌছানের সঙ্গে জাতীয় আকাঙ্খার ঐক্যমত্ব আছে। এটার ভিতরে কোন দ্বিমত নেই।
সিপিডির এই ফেলো বলেন, বাজেটে বলা হয়েছে করদাতার সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করা হবে। কিন্ত কত বছরে, কীভাবে তা হবে এবং তার মাধ্যমে কত টাকা রাজস্ব আসবে-সে বিষয়ে কোনো রূপরেখাও বাজেটে নেই। তিনি বলেন, বাতাসের ভেতরে কিছু আশ্বাসের বাণী হয়ত গেছে। আমরা মনে করি না সে রকম বাস্তবভাবে সেগুলো এসেছে। বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাৎ পাওয়ার কথা বলা হয় সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায়। ফলে বাজেট নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, যদি রাজস্ব বোর্ডের তথ্যগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে অবশ্যই ভালো দেখা যাবে হারগুলো। যদি অর্থ মন্ত্রণালয়েরটা ব্যবহার করেন, তাহলে হার কম দেখা যাবে। ‘মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় বিচক্ষণতার সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরটাই ব্যবহার করেছেন।’
তথ্যের ‘সামঞ্জস্যহীনতার’ উদাহরণ দিতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ট্যাক্সের যে উৎসে কর কাটা হবে, সেটার ¯ø্যাবগুলো কী হবে, সেটা বক্তৃতার ভেতরে আছে ২৫ লাখ টাকা। আর এনবিআর হিসাব দিয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এখানে সমস্যা রয়ে গেছে। তথ্য উপাত্তের নিশ্চয়তা নিরূপণ করেন এবং সামঞ্জস্য বিধান করেন, বাজেটে আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসেন।
বাজেটের আকার বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরিকল্পানা নিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটকে ভিত্তি করে নতুন অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পানা সাজানো হয়। কিন্ত জুন মাসে যখন অর্থবছর শেষ হয়, তখন বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে থাকতে হয়। বাজেটের আকার টাকার অংকে বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে বাড়েনি। লক্ষ্যমাত্রার সাথে বাস্তবায়নের পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি পাঁচ শতাংশের ওপরেই আছে। এবার সেটা বাড়বে কি না রাজস্ব আহরণের ওপর নির্ভর করবে।
জনপ্রশাসনে এবার কেন মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হল, সেই প্রশ্ন তুলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দায় দেনা পরিস্থিতি গুরুতর আকার নিতে পারে বলে আমরা মনে করছি। অনেক প্রকল্প অসমপ্ত রেখে প্রস্তাবিত বাজেটে শত শত নতুন প্রকল্প না ঢোকানোয় অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানান সিপিডির ফেলো। কিন্ত সারচার্জের ক্ষেত্রে সম্পদশালীদের যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে মেলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার নিচে হলে সার চার্জ দিতে হত না। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এখন সেই সীমা বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করার কথা বলেছেন। ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, অঘষোতি আয় ও বেআইনি আয়কে আলাদা করার সময় এসেছে।
সামষ্টিক বাজেট কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী এবার অনেক লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তবমুখী হয়েছেন। ফলে আগের দু-একটি বছরের তুলনায় রাজস্ব ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা কম। তিনি কর-বহির্ভ‚ত আয় বাড়ানোর উদ্যোগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে উন্নয়ন ব্যয় সাত শতাংশ রাখা, শত শত নতুন প্রকল্প না নেওয়াসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানান। পুঁজিবাজারে নেওয়া পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন নেই বলে উল্লেখ করেন। তবে এও বলেন, সুশাসন ছাড়া পুঁজিবাজারের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ভ্যাট আইনে জরুরি সেবা ও পণ্যে ছাড় দেওয়ার বিষয়টিও ঠিকই আছে বলে উল্লেখ করেন।
দেবপ্রিয় বলেন, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া নির্ভর করছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য আমরা কী করতে পারব, তার ওপর। বিকাশমান মধ্যবিত্তই হলো চালিকাশক্তি। চিন্তা-চেতনা, উপার্জন, বুদ্ধিমত্তা-সব ক্ষেত্রে এটি হলো চালিকা শক্তি। সেই চালিকা শক্তিকে যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তা ইশতেহারের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি বলেন, এটা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকির শেষ বছর। অর্থমন্ত্রী তো সপ্তাম পঞ্চবার্ষিকির শেষ বছরের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কোন কথায় বলেন নাই। শেষ বছরটাই মরা জোরে দৌড়াবো উনি বলেন না কেন। উনি নিজে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। কিন্ত আমরা সিপিডি বলছি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সিরিয়াসলিভাবে নেয় এবং এখানে সবরকম জোর দেয়া উচিত, যাতে আমরা লক্ষ্যমাত্রগুলো অর্জন করতে পারি।
গত বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেট চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ দশমিক ২২ ও মূল বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ বড়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআর সংগ্রহ করবে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৬২ দশমিক দুই শতাংশ। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ