পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘ইংরেজ খেদাও’ আন্দোলন জোরদারে উপমহাদেশের ঊর্দুভাষী কবি মাওলানা হাসরত মোহানির লেখা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) স্লোগান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি ১৯২৫ সালে কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির কনভেনশনে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এই স্লোগান তোলেন। ইংরেজরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হন।
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান জন্মের ৬১ বছর পর ১৯৮৬ সালে উপমহাদেশের আরেক প্রখ্যাত আলেম ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক ইনকিলাব। এই পত্রিকা এ দেশের তৌহিদী জনতাকে নতুন আলোর দিশা দেখায়। ইনকিলাব একদিকে মুসলমান পাঠকদের ধর্মীয় চেতনাকে শানিত করেছে; অন্যদিকে ইসলাম বিদ্বেষীদের আস্ফালনের লাগাম ধরে টেনে।
ইংরেজি শিক্ষার অধিক প্রয়োজনীয়তার এই যুগে ইসলামী মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গণমাধ্যম পরিচালনা যখন দূরূহ; তখন ইনকিলাব দেখিয়ে দিয়েছে নিয়ত সহিহ থাকলে সব কিছুই সম্ভব। খবর প্রকাশে কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থন বা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি বিদ্বেষ নয়; প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে। দেশের মানুষ যা বিশ্বাস করে তার সঙ্গে থেকে গণমাধ্যম হিসেবে ইনকিলাব সব মত ও পথের পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯৮৬ সালের ৪ জুন জন্ম নেয়া দৈনিক ইনকিলাব ৩৩ বছর পেরিয়ে আজ ৩৪ বছরে পদার্পণ করল। সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের নিষ্ঠায় ইনকিলাব দেশের সংবাদপত্র শিল্পে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন সময় প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজস্ব গতি পথে অবিচল থেকে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এখন দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পাঠকের হৃদয়ের কণ্ঠস্বর।
জন্মলগ্ন থেকেই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি, সার্বভৌমত্ব, স্বকীয়তা যা কিছু দেশবাসীর জন্য মঙ্গলজনক সে পথে থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছে। এদেশের ৯২ ভাগ মুসলমান তথা তৌহিদী জনতার ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিতি পেলেও ইনকিলাব সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের পক্ষে থেকেছে অবিচল, খবর প্রচারে থেকেছে নিরপেক্ষ।
ভারতের শাসকদের হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে সে দেশের মুসলিমদের ওপর নির্যাতন, ফিলিস্তিনী জনতার ওপর ইসরাইলিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদী হয়ে জনমত গঠন করেছে; তেমনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীর উপর জুলুম-নির্যাতনে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে অবতীর্ণ হয়েছে এই পত্রিকা।
দেশের হাজারো মিডিয়ার ভিড়ে দৈনিক ইনকিলাব শুধু একটি গণমাধ্যম নয়; আরো অন্যকিছু। ইনকিলাব হলো একটি চেতনার নাম; যে চেতনা পাঠকদের মানবিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঐতিহাসিক শুভক্ষণে ইনকিলাবের সকল পাঠক, সমালোচক, কর্মরত সাংবাদিক-লেখক-বিজ্ঞাপনদাতা-শুভানুধ্যায়ী সকলকেই অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
ইসলামের দীপ্ত শিখায় উদ্ভাসিত ইনকিলাবের দীর্ঘ এই চলার পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ইনকিলাবকে বাঁকে বাঁকে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা যেমন হয়েছে; তেমনি মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতার চেষ্টাও কম হয়নি। ইনকিলাব থেমে থাকেনি, সব বাধা অতিক্রম করে আপোষহীনভাবেই এগিয়ে চলেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
সম্রাজ্যবাদী শক্তির অস্ত্রবাজির বিরুদ্ধবাদ এবং শাসকদের গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকান্ড-দুর্নীতি-নীতি-নৈতিকতার খবর প্রকাশ করলেই সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর জুলুমের খবর প্রচার করায় মিয়ানমারের স্বৈরশাসক চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্ববাসীকে তা দেখিয়ে দিলো। আবার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে শাসকদের অস্ত্র হিসেবে বিজ্ঞাপন তো রয়েছেই। এর মধ্যে দেশের কর্পোরেট হাউজগুলো যখন নতুন নতুন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে সেটাকে ব্যবসার ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে; গণমাধ্যমকে ‘প্রচার মাধ্যমে’ রূপান্তর ঘটিয়েছে এবং কর্মরত সাংবাদিকদের মোটা অর্থ দিয়ে টানার চেষ্টা করেছে; তখন ইনকিলাব পথ হারায়নি।
ইনকিলাব ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার ঢাল নয়; দেশের স্বকীয়তা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ঢাল হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করছে। নানান সীমাবদ্ধতা, আর্থসামাজিক টানাপেড়েন, সংবাদপত্র শিল্পে অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দোলাচলে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে ইনকিলাব। ‘শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে’ স্লোগান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল তিন লক্ষ্য ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার’ প্রতিষ্ঠায় লড়াই অব্যাহত রেখেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ আর গণমানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, যা পাঠকদের কাছে ইনকিলাবকে করে তুলেছে আরো আকর্ষণীয়।
এখন প্রিন্ট পত্রিকার সঙ্গে প্রতিদিন অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করা হচ্ছে। এক ঝাক তরুণ-প্রবীণ সংবাদকর্মী কাজ করছেন। অনলাইনেও পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সব গোলার্ধের দেশেই পাঠকদের কাছে ইনকিলাব সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে।
ইনকিলাব দলমত নির্বিশেষে সব পাঠকের পত্রিকা। সম্পাদকীয় নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থেকেই খবরকে খবর হিসেবে প্রচার করছে। ডে ইভেন্টের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মতামত, বিশ্লেষণ, শিক্ষাঙ্গন, সমাজ জীবন, নাটক-সিনেমা-সঙ্গীত, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, ইসলামী দুনিয়া, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির খবরাখবর তুলে ধরেছে সব শ্রেণীর পাঠকের জন্য। খবর প্রকাশে এই বৈচিত্র্য প্রবীণ-নবীন সব শ্রেণীর পাঠকের মধ্যে রচনা করেছে সেতুবন্ধন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে চিন্তা-চেতনায়, কর্মে পরিবর্তিত বিশ্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা কিছু সত্য, সুন্দর, ভালো, মহৎ, জনকল্যাণকর এবং দেশ-জনগণের পক্ষে সেগুলো তুলে ধরছে। ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে আপস না করেই খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীর অধিকার, মত ও পথকে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামী চেতনা লালন করলেও বিপরীতমুখী বাম রাজনীতির চিন্তা-চেতনা ও মতামত গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করছে।
বিগত শতকের আশির দশকে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ছিল সঙ্কটময় মুহূর্ত। মুসলমানের দেশে মাদরাসা শিক্ষা কার্যত এতিমের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। প্রগতিশীলতার নামে দেশে বল্গাহীন ঘোড়ার মতো মিডিয়া জগতে দাপিয়ে বেড়াত ইসলামবিদ্বেষী চেতনা। একদিকে ইসলামবিদ্বেষ; মাদরাসা শিক্ষা ও আলেম-ওলামাদের কোণঠাসা করে রাখা; অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতির নামে দেশকে বিজাতীয় সংস্কৃতিচর্চার উর্বর ভূমিতে পরিণত করা হয়। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার নামে উলঙ্গ নৃত্যের তালে দেশের আলেম-ওলামা-মাদরাসা শিক্ষা, পীর-মশায়েখ-দাড়ি-টুপিকে তুচ্ছজ্ঞান করাই ছিল কিছু শিক্ষিত ব্যক্তির নিত্যচর্চা। দেশের মিডিয়াগুলো সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়।
সেই প্রতিকুল সময়ে জন্ম নেয়া দৈনিক ইনকিলাব সত্যনিষ্ঠ খবরের পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইসলামী আকিদায় সমাজ বিনির্মাণে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। তখন দেশের অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকার ‘সম্পাদকীয় নীতি’ ছিল আকাশ সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা উৎসাহিত করা।
কলকাতার হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে দেশের আলেম সমাজের সম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা যখন দূরূহ, দিশাহীন আলেম সমাজ নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ; তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের-‘বলাকা’ কবিতার ‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, ওরে আমার কাঁচা/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’-এর মতোই ইনকিলাব ঘুমন্ত আলেম সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তোলে। দিশা ফিরে পায় আলেম সমাজ।
দেশের সংবাদপত্র জগতে ইনকিলাব খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইল সৃষ্টি করেছে। খবরের পেছনের খবর অনুসন্ধান করে বের করেছে। অনেক জাতীয় ইস্যুর আগাম ফোরকাস্ট করেছে। ইনকিলাবের কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা পর্যায়ের ব্যুরো অফিস, আঞ্চলিক অফিস, জেলা-উপজেলা অফিসে কর্মরত সাংবাদিক-সংবাদকর্মী সকলেই এ জন্য রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর্থিক সঙ্কট ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কখনো দমে যাননি কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারীরা।
তিন যুগ আগেও দেশের ইসলামী স্কলার ও আলেম-ওলামার কথা বলা এবং মত প্রকাশের মিডিয়া (প্লাটফর্ম) ছিল না। ইনকিলাবের জন্ম শুধু সেই অভাব পূরণই করেনি; সাথে দেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষা এখন ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। হাজারো গণমাধ্যমের ভিড়ে ইসলামী মূল্যবোধ তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ইনকিলাব পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করেছে।
এখন সাধারণ মানুষ তো বটেই; দেশের তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরাও ইসলামী চেতনায় নিজেদের গড়ে তুলতে প্রয়াস পাচ্ছেন।
এই ডিজিটাল যুগে বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীলতার নামে যখন উলঙ্গ নৃত্য; তখন শুক্রবার দেশের মসজিদে মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড়। উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা রমজানে একে অপরকে রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেন। রমজান মাসে তারাবি নামাজে মসজিদের জায়গা না হওয়ায় মুসল্লিদের রাস্তায় বসে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। মাদরাসার শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম সম্মানজনক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখছেন। আলেম-ওলামা এখন সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছেন। ৩৩ বছর চলার পর ৩৪ বছরে পদার্পণের এই দিনে এসব দেখে বলা যায়, ‘ইনকিলাব সফল হয়েছে’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।