দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রমযানুল মুবারকে তাঁর দানের হাত আরও প্রসারিত হতো। [বুখারী, হাদীস:৬, ১৮৬৪] ৫. সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইফতারের সময় রোযাদার যখন দুআ করে, তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ তার দুআ কবূল হয়। [ ইবনে মাজা, হাদীস: ১৭৫৩] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রমযানে রোযাদারের দুআ কুবূল হয়। [আহমাদ, হাদীস: ৮০৪৩; তিরমিযী, হাদীস:৩৫৯৮; ইবনে মাজা, হাদীস:১৭৫২] বর্ণিত হাদীসগুলোর আলোকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, রমাযান মাসের দুআগুলো অবশ্যই কবূল হয়। তাই মাহে রমযানে অধিকহারে দুআ ও ইস্তিগফার করা উচিত। ৬. তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলতের কথা কম-বেশি সকলেরই জানা। রমযানে যেহেতু সাহরীতে উঠাই হয়, তাই একটু আগে উঠে কয়েক রাকআত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এর দ্বারা সারা বছর তাহাজ্জুদ আদায়ের অভ্যাসও গড়ে উঠতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সকলের যতœবান হওয়া উচিত। ৭. কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ [সূরা কদর] সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতে মশগুল থাকবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। [বুখারী, হাদীস:২০১৪] বিভিন্ন হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমণিত হয় যে, লাইলাতুল কদর পুরো রমাযানের যে কোনো রাতেই হতে পারে। তবে রমাযানের শেষ দশকে হওয়ার সম্ভবনাই প্রবল। তাই লাইলাতুল কদরের অপার ফযীলত লাভের নিমিত্তে পুরো রমযান একে তালাশ করতে থাকা উচিত। না পারলে অন্তত শেষ দশকে কোমর বেঁধে লাগবে এর অনুসন্ধানে। ৮. শবে কদর প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ ও উত্তম উপায় হলো, রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা। কারণ ইতিকাফকারী সর্বদাই আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল ও ইবাদত-বন্দিগীতেই মাশগুল থাকেন। কাজেই তাঁর শবে কদর প্রাপ্তির বিষয়টি প্রায় নিশ্চত। এড়াও ইতিকাফের রয়েছে অনেক ফযীলত। যা আন্দায করা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল দ্বারা। তিনি মদীনায় আগমনের পর অন্য অনেক আমল মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দিলেও মৃত্য পর্যন্ত ইতিকাফের আমল কোনো সময় ছাড়েন নি। এরপর তার পূণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতিকাফ করেছেন। [বুখারী: হাদীস, ২০২৬; মুসলিম: হাদীস, ১১৭২] সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্ব প্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকী লাভ করে সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সেই পরিমাণ নেকী লাভ করে। [ইবনে মাজা: ১৭৮১] অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতিকাফকারী প্রতিদিন একটি করে হজে¦র সওয়াব পায়। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮২] ৯. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো সর্বদা গুনাহ মুক্ত থাকা। বিশেষ করে রমযানে এ ব্যাপারে বেশী যতœবান হওয়া উচিত। কারণ গুনাহ রোযার রুহকে নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া রমযানে আমলের ফযীলত ও প্রতিদান যেমন বেশি, গুনাহের ক্ষতি ও ভয়াবহতাও তেমন বেশি। ১০. এক বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি রমযান মাসে একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি রমযান মাসে একটি ফরয আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায় করল। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৩/৩০৫-৩০৬] তাই এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা যায় সহজেই। কাজেই রমযানে অলস ও অনর্থক কাজে সময় ব্যয় না করে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত করা উচিত। এভাবে পুরো রমযান মাস কাটানো গেলে আমাদের রমযান হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত রমযান। লাভ করা যাবে মাহে রমযান সংক্রান্ত বর্ণিত সকল ফাযায়েল। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
রমযানের মাসাঈল
নিয়ত
১.রমযানের প্রতিটি রোযার জন্য আলাদা আলাদা নিয়ত করা ফরয।
২.মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরী নয়। মনে মনে নিয়ত করলেই যথেষ্ট। তবে মুখে উচ্চরণ করে নিয়ত করা উত্তম।
৩.এভাবে আরবীতে নিয়ত করাও জরুরী নয়। যে কোনো ভাষাতেই নিয়ত করা যায়।
৪.রোযার নিয়ত রাতে করাই উত্তম। তবে কোনো কারণে রাতে নিয়ত করতে না পারলে সূর্য ঢলার আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে। ৫.রমযানে অন্য কোনো রোযার নিয়ত করলেও চলমান রমযানের রোযাই আদায় হবে। অন্য যে রোযার নিয়ত করেছে সেটা আদায় হবে না।
৬. এভাবে নিয়ত করবে- মনে মনে বা মুখে উচ্চারণ করে, আমি আগামী কালের রোযা রাখার নিয়ত করছি।
সাহরী:
১.সাহরী খাওয়া সুন্নাত এবং এর অনেক ফযীলত রয়েছে। তাই ক্ষুধা বা ইচ্ছা না থাকলেও এই ফযীলত লাভের জন্য সামান্য কিছু হলেও পানাহার করা উচিত।
২. সাহরী না খেলেও রোযা হবে। ৩.বিলম্বে সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরুহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়।
ইফতার
১. দেরি না করে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা মুস্তাহাব।
২. খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার শুরু করবে।
৩. ইফতারের সময় দুআ কবূল হয়। তাই এ ব্যাপারে যতœবান হওয়া উচিত।
যে সকল কারণে রোযা ভাঙ্গে না এবং মাকরুহও হয় না
১.চোখে সুরমা বা কোনো ঔষধ দেওয়া।
২. সুগন্ধি লাগানো বা তার ঘ্রাণ নেওয়া।
৩. ভুলে কোনো কিছু পান করা।
৪. ভুলে আহার করা।
৫. ভুলে সহবাস করা।
৬. অনিচ্ছাবশত গলার মধ্যে ধোঁয়া, ধুলাবালি বা মশা-মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করা।
৭. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি চলে গেলে। তবে ইচ্ছাকৃত দিলে সতর্কতা হলো সে রোযা কাযা করে নেওয়া
৮. অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়া বা ইচ্ছাকৃত অল্প বমি করা।
৯. সপ্ন দোষ হওয়া।
১০. মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা।
১১. যে কোনো ধরনের ইনজেকশন, স্যালাইন, টিকা ইত্যাদি নেওয়া। তবে রোযার কষ্ট যেন অনুভব না হয়, সেজন্য শক্তি সঞ্চয়ের ইনজেকশন, স্যালাইন ইত্যাদি নেওয়া মাকরুহ।
১২. দাঁত উঠালে তার রক্ত পেটে না গেলে।
১৩. পাইরিয়া রোগের কারণে যে অল্প অল্প রক্ত সব সময় বের হতে থাকে এবং গলার মধ্যে যায়, তার কারণে।
১৪. সাপ ইত্যাদি বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে।
১৫. পান খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলি করা সত্তেও যদি থুথুতে লাল ভাব থেকে যায়।
১৬.উত্তেজনার সাথে কেবল দৃষ্টিপাতের কারণেই যদি বীর্যপাত হয়ে যায়।
১৭. রোযা অবস্থায় শরীর থেকে ইনজেকশনের সাহয্যে রক্ত বের করলে রোযা ভাঙ্গে না এবং এতে রোযার শক্তি চলে যাওয়ার মতো দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে মাকরুহও হয় না।
যে সকল কারণে রোযা মাকরুহ হয়
১. বিনা প্রয়োজনে কোনো জিনিস চিবানো।
২. তরকারী ইত্যাদির লবন চেখে ফেলে দেওয়া। তবে অনন্যোপায় অবস্থায় জিহŸার অগ্রভাগ দিয়ে চেখে ফেলে দিলে মাকরুহ হবে না।
৩. যে কোনো ধরনের মাজন, কয়লা, গুল, টুথপেষ্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা। এগুলোর সামান্য পরিমাণও গলার মধ্যে চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
৪. গোসল ফরয অবস্থায় সারা দিন অতিবাহিত করা।
৫. শরীর থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরুহ, যার দ্বারা রোযাদার খুব দুর্বল হয়ে যায়। ৬.গীবত করা। ৭. চোগলখুরী করা। ৮. মিথ্যা কথা বলা।
৯. অনর্থক কথা বলা।
১০. গালি-গালাজ করা।
১১. ঝগড়া-ফাসাদ করা।
১২. টিভি-সিনেমা দেখা, গান-বাদ্য শ্রবণ করা।
১৩. যে কোনো কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
১৪. ক্ষুধা বা পিপাসার কারণে অস্থিরতা প্রকাশ করা।
১৫. মুখে অধিক পরিমাণ থুথু জমা করে গিলে ফেলা।
১৬. দাঁতে আটকে থাকা ছোলা বুটের চেয়ে ছোট কোনো বস্তু মুখে থাকা অবস্থায় গিলে ফেলা।
১৭. নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না- এমন ধারণা হওয়া সত্তেও স্ত্রীকে চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা ইত্যাদি।
১৮. রোযা অবস্থায় স্ত্রীর ঠোঁট মুখে নেওয়া।
১৯. নিজের মুখ দিয়ে চিবিয়ে কোনো বস্তু শিশুর মুখে দেওয়া। তবে অনন্যোপায় অবস্থায় এরুপ করলে মাকরুহ হবে না।
২০. ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগালে যদি মুখের ভিতর চলে যাওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে তা মাকরুহ।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।