বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হানাফী ও হাম্বলী মাজহাবের অধিকাংশ মাশায়েখের মতে, তারাবিতে কোরআন মাজীদ খতম করা সুন্নাহ। ‘হানাফীদের মতে, কওমের লোকজনের অলসতার অজুহাতে তারাবিতে কোরআন খতম করা ছেড়ে দেয়া যাবে না; বরং প্রত্যেক রাকাতে দশ আয়াত পরিমাণ করে তিলাওয়াত করে বিশ রাকাতে পুরো মাসে খতম পুরো করা হবে।’
‘আর ওমর রা. এর যুগে তিনি রা. ক্বারী সাহেবানদেরকে ত্রিশ আয়াত করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে তখন তিন খতম পরিমাণ তিলাওয়াত হতো। সেই হিসাবে হানাফীদের মতে, তিন খতম করা মুস্তাহাব। (ফতহুলকাদীর : ১/৪৬৯, হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন : ২/৪৬)।
ইমাম কালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘ওমর রা. যা নির্দেশ দিয়েছিলের সেটা ছিল অধিক ফজিলত লাভ করার বিবেচনায়। তবে বর্তমান সময়ে ইমামের উচিত কওমের মুসল্লিদের অবস্থা বিবেচনা করে সেই পরিমাণ তিলাওয়াত করা, যাতে করা মুসল্লিরা তারাবির প্রতি বিরক্তি বোধ না করে। কেননা জামায়াতে মুসল্লির সংখ্যা বেশি হওয়া লম্বা কিরায়াত থেকে উত্তম।’
তবে হাম্বলীদের মতে, মুসল্লিরা বিরক্তি বোধ করলে এক খতমের বেশি না পড়া উচিত। (আল-ফুরু’আ লি ইবনিল মুফলিহ : ২/৩৭৫)। এমনকি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহর মতে, তারাবিতে কোরআন খতম করার পর সূরায়ে নাস পড়ার পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে সম্মিলিত দোয়া করাও মুস্তাহাব। এর পেছনে দলিল হলো রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে খতমে কোরআনের পর পরিবারের লোকজনকে জমা করে দোয়া করা সম্পর্কীয় যেসব রেওয়ায়েত রয়েছে সেগুলো। এক রেওয়ায়েতে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘খতমে কোরআনের সময় রহমত বর্ষিত হয়।’ ইমাম আহমাদের এই মতটা ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত আল মুগনী কিতাবের প্রথম খÐের ১৫৭-১৫৮ পৃষ্ঠাদ্বয়ে উল্লেখ করেছেন।
মালেকীদের মতে, জরুরি মনে না করলে এবং ভালো ক্বারী থাকলে মুসল্লিদের পুরো কোরআন শুনানো মুস্তাহাব। তাদেরই অন্য মতে, খতম করা সুন্নাহ। তবে খতম না করলেও কোনো সমস্যা নেই। এটাকে রেওয়াজ বানিয়ে ফেলা ও ক্বারী অন্য জায়গা থেকে আনা সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মাওয়াহিবুল জলীল : ২/৭১, আলমুখতাছার: ৩৯, হাশিয়াতুল আদাবী আলাদ্দারদীর : ১/৪৬২)।
শাফেয়ীদের মতেও তারাবিতে পুরো কোরআন খতম করা মুস্তাহাব। শাফেয়ী মাজহাবের অন্যতম ফকিহ ইবনে সালাহর মতে তারাবিতে কোরআন খতম করা ওমর রা.-এর যুগ ও পরবর্তী সালাফদের আমল। (ফাতওয়ায়ে ইবনে সালাহ : ২৪৯)। ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তারাবিতে কোরআন তিলাওয়াত করা মুসলিম উম্মাহর ইজমার ভিত্তিতে মুস্তাহাব।’ তিনি বলেন, ‘বরং তারাবির অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো কোরআন তিলাওয়াত, যাতে মুসলিম উম্মাহ কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পায়।’ (মাজমূ’আউল ফাতওয়া : ২৩/ ১২২)।
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ ‘মুআত্তা’র মধ্যে আ. রহমান আল-আ’রাজ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, ‘আমরা রামাদানে তারাবি থেকে ফিরে এসে সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার ভয়ে খাদেমকে তাড়াতাড়ি খানা পরিবেশনের নির্দেশ দিতাম।’
তিনিই (ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ) সায়িব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেন, ‘ওমর রা. উবাই বিন কা’আব ও তামীমে দারী রা.কে লোকজন নিয়ে জামায়াতে তারাবি পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর এই ক্বারীদ্বয় দুইশত আয়াত করে পড়তেন, এমনকি লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো বলে আমরা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতাম, আর আমরা সুবহে সাদিকের সামান্য পূর্বে তারাবি থেকে ফিরে যেতাম।’
কাজী আবু য়া’আলা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘পুরো মাসে তারাবিতে এক খতম কোরআন তিলাওয়াত করা উত্তম, যাতে লোকজন পুরো কোরআন শুনার সওয়াব অর্জন করতে পারে। লোকজনের কষ্ট হলে এক খতমের বেশি তিলাওয়াত করা ঠিক নয়। মুসল্লিদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত নেয়াই উত্তম।’
ইবনু আবদির বার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তারাবিতে তিলাওয়াতের নিয়ম হলো বড় আয়াত হলে দশ আয়াত, আর ছোট আয়াত হলে দশেরও অধিক আয়াত পড়া। আর সূরাগুলো মুসহাফের তরতিব অনুসারে পড়া।’ (আলমাউসূআতুল হাররাহ)। এই সংক্রান্ত দলিল হলো, প্রতি রমজানে রাসূল সা. কর্তৃক জিব্রাইল আ.-এর সাথে কোরআনের এক খতম দাওর করা এবং ওফাতের আগের বছর দুই খতম দাওর করা সম্পর্কিত বুখারীর হাদিস ও ওমর রা. যুগ ও পরবর্তী সালাফদের আমল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।