দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মাহে রমযানের আজমত, মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাস আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্টতম সময়। মুমিনের পাথেয় অর্জনের ভরা মৌসুম। ইবাদত বন্দেগীর বসন্তকাল। এ মাসের একটি বৈশিষ্ট হলো, কুরআন মাজীদ, তাওরাত, যাবুর, ই্িঞ্জল ও হযরত ইবরাহীম আ. এর সহীফাসহ সকল প্রকার আসমানী কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। [তবরানী] এ মাসে পূর্ণ কুরআন লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর কুরআন মাজীদের সর্ব প্রথম ওহীও এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। রমযানের অন্য কোনো ফযীলত বর্ণিত না হলেও এই একটি ফযীলতই তার মর্যাদা ও মহত্ত¡ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। মাহে রমযানের মর্যাদা ও মহত্তে¡র কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘রমযান মাস হলো সেই মাস, যাতে নাযিল হয়েছে কুরআন, যা মানুষের হেদায়াত ও সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। কাজেই তোমাদের যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোযা রাখে। [বাকারা:১৮৫] এক বর্ণনায় সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যখন রমযানুল মুবারকের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট ও কুমন্ত্রনাদাতা শয়তান ও জিনদের শিকল পড়িয়ে আবদ্ধ করা হয় এবং বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ। ফলে পুরো মাস কোনো দরজাই খোলা হয় না। আর খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো। ফলে পুরো মাস কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে- হে কল্যাণের প্রত্যাশী! সামনে অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের অন্বেষী! থেমে যাও। আর পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেন এ মাসের প্রতি রাতে। [তিরমিযী:১/৪৭; ইবনে মাজা:১১৮-১৮৯] সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ মাসে রয়েছে এমন একটি রাত, [শবে কদর] যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যাকে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হলো, তাকে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হলো। [আহমাদ, হাদীস: ৭১৮৪; নাসায়ী: ১/২৩০] এ ছাড়াও রমযানের আরও অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। সে যাই হোক, মাহে রমযানের এ সকল ফাযায়েল পেতে চাইলে নিম্ন বর্ণিত নিয়মে পুরো রমযান মাস কাটানো উচিত। ১. পুরো মাস রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। এটি এ মাসের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। তাই প্রতিটি মুসলমান পুরো মাস রোযা রাখবে। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ (বাকারা:১৮৩) সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখ, তখন থেকে তোমরা রোযা রাখ। আর যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখ, তখন থেকে রোযা বন্ধ কর। যদি আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে ত্রিশ দিন রোযা রাখ। (বুখারী: হাদীস, ১৯০৯; মুসলিম: হাদীস, ১০৮০) উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, রমযান মাসের রোযা ফরয ও ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিধান। শরয়ী ওযর ব্যতীত তা না রাখার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রোযাদারের জন্য রয়েছে অফুরন্ত ও অবারিত নেআমত ও পুরুষ্কারের ওয়াদাও। সাহাবী আবু হুরায়রার রা. বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী, হাদীস: ১৮৬৩; মুসান্নাফে আবী শায়বা, হাদীস:৮৯৬৯) সাহাবী হযরত আবু উমামা রা.বর্ণনা করেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন ‘তুমি রোযা রাখ। কারণ রোযার সমকক্ষ কোনো কিছুই নেই। আমি দ্বিতীয় বার তাঁর নিকট এসে একই কথা বললে, তিনি বললেন, রোযা রাখ।’( মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২২১৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীস:২৫৩০) রোযার এ সকল ফাযায়েল তখনই পাওয়া যাবে, যখন রোযার আদবগুলোর প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রেখে রোযা রাখা হবে। কারণ আদব বিহীন রোযা হয় প্রাণহীন। আর প্রাণহীন দেহের কোনোই মূল্য নেই। [রোযার আদবগুলো হলো, * সাহরী ও ইফতারে হারাম খাবার পরিহার করা। * অপাত্রে দৃষ্টিপাত তথা নাজায়িয বস্তু বা বিষয় দেখা থেকে বিরত থাকা। * যবানের যথাযথ হেফাযত করা। অর্থাৎ মিথ্যা, গিবত-শেকায়াত, চোগলখোরী, অশালীন কথাবার্তা ইত্যাদি থেকে স্বীয় জিহ্বাকে হেফাযত করা। * কানকে সর্ব প্রকার অন্যায় ও পাপের কথা শ্রবণ থেকে বিরত রাখা। * অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও যেমন হাত-পা ইত্যাদিকে সর্ব প্রকার গুনাহ ও অন্যায় কাজ-কর্ম থেকে হেফাযত করা। * যথা সম্ভব পানাহারে সংযমী হওয়া। * রোযা অবস্থায় অল্লাহর মহত্ত¡ ও বড়ত্বের কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। * সর্বদা এই ভয়ে কম্পিত থাকা যে, আমার রোযা আল্লাহর দরবারে কবূল হয় কি না? * রোযা কবূলের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করা। * দুনিয়ার সকল বস্তু থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকা।] ২. প্রতি রাতে তারাবীহের নামায আদায় করা। এটি রমযানের রাতের বিশেষ আমল। এ মাসের অবারিত খাইর-বরকত, রহমত-মাগফিরাত লাভের ও ঘোষিত প্রতিদান প্রাপ্তির জন্য তারাবীহের প্রভাব অপরিসীম। এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ,‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর ফরয করেছেন রমযান মসের রোযা আর আমি সুন্নাত করেছি তারাবীর নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে এবং তারাবীহর নামায আদায় করবে, সে ঐ দিনের মত পবিত্র হয়ে যাবে, যেদিন সে মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’( সুনানে নাসাঈ: ১/২৩৯; মুসান্নাফে আবী শায়বা: ৫/২২৯-২৩০; বুখারী:১/২২৫) ৩. হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরাঈল আ. রমযানুল মুবারকের প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করতেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে কুরআন মাজীদ শুনাতেন। [বুখারী, হাদীস:৬, ১৮৬৪] তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা। পূর্ববর্তী বুযুর্গদের জীবনী ঘাটলে পাওয়া যায় যে, তাঁরা নিজেরা এবং পরিবারের সদস্যগণ প্রতি রমযানে বহুবার কুরআন মাজীদ খতম করতেন। ৪. দান-খাইরাত সর্বাবস্থাতেই অনেক বড় আমল। রমযানুল মুবারকে তার গুরুত্ব ও মর্তবা আরও বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।