বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. এম এ সবুর : শিক্ষাই জাতির প্রাণশক্তি। শিক্ষার মাধ্যমে জাতিসত্তার বিকাশ হয়। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি সুসংহত। আর জাতীয় উন্নয়নে ও সংস্কৃতির বিকাশে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা পাশবিক শক্তির বিনাশ করে মানবিক শক্তির বিকাশ ঘটায়। এ ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং সামষ্টিক চেতনার জাগরণ হয়। এজন্য শিক্ষাকে জাতীয় জাগরণ আর উন্নয়নের মূল ভিত্তি বলা যায়। দেশের জনশক্তিকে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিমেয়। আর এসব গুণাবলী মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, নৈতিকভিত্তিক, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষাকে সর্বাদিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং জাতীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়।
বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন ঊফঁপধঃরড়হ ঋড়ৎ অষষ (ঊঋঅ)-এর সুপারিশ এবং ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক দেশকে শিক্ষাখাতে নিজ দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ অথবা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এমনকি আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত কেনিয়া জাতীয় বাজেটের ৩১% এবং সেনেগাল ৪০% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখে। গত কয়েক বছর ধরে কিউবা জিডিপির ৯% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ আমাদের বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ। শিক্ষা খাতে জিডিপির বরাদ্দের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৬১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। চলতি বাজেটে (২০১৫-১৬) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলে গোটা শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয়েছে মাত্র ৩১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের মাত্র ১১ শতাংশ এবং তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অপ্রতুল। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে। অবশ্য প্রতি বছরেই আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ হিসেবের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি লুকিয়ে আছে। যা সাধারণ মানুষ এমনকি অনেক শিক্ষিত লোককেও ধোকা দিতে পারে। কারণ জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যখাতকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে ভাগ-বণ্টনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ, বৃত্তি-উপবৃত্তি ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়। আর প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষার মানোন্নয়নমূলক খাতসমূহ উপেক্ষিতই থেকে যায়। যাতে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
এমতাবস্থায় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠনও বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি) আয়োজিত এক সেমিনারে আগামী বাজেটে শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৪% অর্থ বরাদ্দের দাবি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জন-বাজেট-সংসদ’ আয়োজিত এক প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় আলোচকগণ জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে। ইতোপূর্বে ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স এসোসিয়েশন (ড্যাঙ্গট) অনুরূপ দাবি জানিয়েছে। এছাড়া অনেক শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগী বিভিন্ন সভা-সেমিনার-প্রবন্ধে জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।
সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। আর মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, যুগোপযোগী শিক্ষা ইত্যাদি। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষক গড়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতার চার দশক পরে বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। তবে প্রণীত জাতীয় এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। আর এসবের জন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় প্রণীত শিক্ষানীতির সুফল ভোগ থেকে জাতি বঞ্চিত থাকবে। অথচ এ বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে উপেক্ষিতই থাকছে।
শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দের কারণে শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা সম্ভব হয় না। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করছে। আর শিক্ষাবাণিজ্যের কারণেই দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাক্ষেত্রের সকল পর্যায়ে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এতে দেশের গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বিত্তশালী কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা টাকার জোরে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছেন। ফলে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য বাড়ছে এবং দেশ ভয়াবহ মেধা সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে।
শিক্ষা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে অবশ্যই শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অধিকন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে যথার্থ পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। কিন্তু জাতীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার অজুহাতে গবেষণা ও প্রশিক্ষণসহ শিক্ষা খাতের জরুরি চাহিদাতে অনেক কম বরাদ্দ দেওয়া হয় আমাদের জাতীয় বাজেটে। যা শিক্ষার মান উন্নয়নে নেতিবাচক ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া শিক্ষাখাতে প্রয়োজনের তুলনায় কম বরাদ্দের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম থাকে। অধিকন্তু সরকারি অনুদান বহির্ভূত (নন-এমপিও) অনেক শিক্ষক বছরের পর বছর বেতন-ভাতা ছাড়াই শিক্ষকতা করছেন। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া, উৎসব ভাতার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত রয়েছেন। ফলে অনেক সময় শিক্ষকগণ বেতন-ভাতার দাবিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে ছাত্রবেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং শিক্ষা উপকরণের দাম কমানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করেন। এতে শিক্ষাব্যবস্থায় দারুণ বিঘœ ঘটে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা গতিশীল করতে সরকার শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারে। অন্যদিকে শিক্ষা উপকরণের দাম কমানোর জন্য সরকার ভর্তুকি দিতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগে সরাসরি কোনো লাভ আসে না। তাই অনেকেই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পক্ষে থাকেন না। তারা শিক্ষাখাতকে অনুৎপাদনশীল মনে করেন। এজন্য তারা অন্যান্য খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে থাকেন। কিন্তু শিক্ষার উৎপাদন সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি। জাতীয় জীবনে এর প্রভাব ও সুফল অবশ্যম্ভাবী। দেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বৈদেশিক নীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবকিছুই শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ উন্নত প্রযুক্তি, মেধাবী ব্যবসায়ী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন কূটনীতিক, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবীদ, জনদরদী সমাজসেবক তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রয়োজন অপরিহার্য। যথাযোগ্য ও উপযুক্ত জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কেবল মানসম্পন্ন শিক্ষাই পারে দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে। এসব বিবেচনায় শিক্ষাখাত বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেতে পারে। অধিকন্তু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। তবে শুধু সরকার নয় বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সমাজসেবী ও মানবহিতৈষীদেরকেও শিক্ষাখাতে অনুদান প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর শিক্ষাখাতের অনুদান যেন বাণিজ্যভিত্তিক না হয় তা সরকারকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
লেখক : আহবায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গ্ট)
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।