মাহে রমজানের মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য
হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা,
পবিত্র মাহে রমজানে নাযিল হয়েছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কালাম পবিত্র আল কোরআন। মাসের সেরা রমজান। কালামের সেরা কোরআন। সকল মাসের সেরা মাস রমজান। সকল রাতের সেরা রাত লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। সকল আসমানী গ্রন্থের সেরা গ্রন্থ আল কোরআন। আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সকল নবী-রাসূলের মধ্যে সেরা নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শ্রেষ্ঠ মাসে শ্রেষ্ঠ রাতে শ্রেষ্ঠ নবীর উপর নাযিল হয়েছে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন। আল্লাহ যত বড় তাঁর কালাম ততো বড়। আল্লাহ তাআলা যত মহান তাঁর কালাম ততো মহান। আল্লাহ তাআলা যত পবিত্র তাঁর কালাম কোরআনও ততো পবিত্র। আল্লাহ তাআলা যেমন অনাদী, অনন্ত, অসীম তাঁর কালাম আল-কোরআনও তেমনি অনাদী, অনন্ত, অসীম।
আল্লাহ তাআলার উপরে কেউ নেই। আল্লাহ তাআলার সমান কেউ নেই। তাঁর মতো কিছু নেই। ঠিক তাঁর কালাম আল-কোরআনের উপর কোনো কালাম নেই। কোরআনের সমতুল্য কোনো কালাম নেই।
আল্লাহ তাআলা বে-মেছাল বে-নযীর কারো সাথে তাঁর তুলনা-উপমা হয় না। আল্লাহ তাআলার কালামও বে-মেছাল, বে-নযীর। অন্য কারো কথা বা কালামের সাথে তাঁর তুলনা-উপমা হয় না। আল্লাহ তাআলার কালাম আল-কোরআন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। জীবনে একবার পড়ে নিলে হয় না, বার বার পড়তে হয়। কোরআন পুরান হয় না। প্রতিবার তাকে নতুন মনে হয়। কোরআন পড়ার স্বাদ কখনো কমে না। প্রতি পাঠেই তার নতুন স্বাদ নতুন মজা আসতে থাকে। কোরআন পাঠের আকর্ষণ দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে শুধু বাড়তেই থাকে। কখনও তা আর হ্রাস পায় না। কোরআন শেষ করে রাখা যায় না। শুরু করে রাখতে হয়। তাই কোরআন পাঠকরা দিন দিন কোরআনের আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়। কোরআনের পাগল হয়ে যায়। এর পর তাদের দিনও কাটে কোরআন নিয়ে। রাতও কাটে কোরআন নিয়ে। তাদের শয়নে-স্বপনে থাকে শুধু কোরআন আর কোরআন। কোরআনেই তারা আল্লাহকে খুঁজে পান, আল্লাহকে দেখতে পান। কোরআনে তারা রোজার স্বাদ পান। তাই তো দেখি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনের মতো করে হাতে গড়া শিষ্য সাহাবায়ে কিরামের মুবারক জামাতের প্রত্যেক সদস্য কোরআন প্রেমিক, কোরআন পাগল। তারা সপ্তাহে কম পক্ষে এক খতম পড়তেন। রমজান এলে এর পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যেত। তাঁদের শিষ্যদেরও একই অবস্থা। তাই ইমাম আবূ হানীফা রহ. সম্পর্কে জানা যায়, পবিত্র মাহে রমজানে প্রতি দিন এক খতম, রাতে এক খতম আর তারাবীতে এক খতম মোট ৬১ খতম হতো তাঁর। ইমাম শাফেয়ী রহ. সম্পর্কেও ৬১ খতম পড়ার রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ রহ. রমজান মাসে প্রতি তিন দিনে এক খতম পড়তেন। হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর এ মাসে দুই রাকাতে এক খতম পড়তেন।
হযরত আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ অন্য মাসে ছয়দিনে এক খতম পড়তেন। আর এ মাসে প্রতি দু’দিনে এক খতম পড়তেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম যুহরী রহ. রমজান এলে দরসে হাদীস থেকে উধাও হয়ে যেতেন। হাদীস অন্বেষণকারী ছাত্রদের থেকে গায়েব হয়ে যেতেন। সব ছেড়ে কোরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহ. রমজান মাসে অন্য সব নফল ইবাদত-বন্দিগী রেখে শুধু কুরআন তিলাওয়াত করতেন। হযরত ইমাম মালেক রহ.ও পবিত্র মাহে রমজানে দরসে হাদীস ছেড়ে দিয়ে শুধু কোরআন তিলাওয়াত করতেন।
ইমাম যুহরী রহ. বলতেন, রমজান তো শুধু কোরআন তেলাওয়াত, মেহমানের আপ্যায়ন আর গরীব-দুঃখীদের দানের জন্য আল্লাহ দিয়েছেন। তাই ইবনে ওমর রাদি. কোনো মেহমান ছাড়া ইফতার করতেন না। হযরত হাম্মাদ বিন সুলাইমান রহ. পবিত্র রমজান মাসে প্রতি বেলায় পাঁচশত রোজাদারের মেহমানদারী করতেন। আর ঈদের দিন সবাইকে একশ দেরহাম করে হাদিয়া দিতেন। হযরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. অন্যসব নফল আমল বন্ধ রেখে শুধু কোরআন পড়তেন। হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানভী রহ. নিজেই তারাবীহ পড়াতেন এবং দিনভর কোরআন তিলাওয়াতই সবচে’ বেশি করতেন। হযরত মাদানী রহ. এর রমজান মাসে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল না। সারা রাত কিয়ামুল্লাইল করে কাটাতেন। প্রতি রমজানে হযরত জিবরীল আ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে পূর্ণ কোরআন একবার দাওর করতেন। অর্থাৎ হযরত জিবরীল আ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাতেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীলকে শুনাতেন। মৃত্যুর আগের বছর পুরো মাসে দু’বার দাওর করেছেন।
পবিত্র মাহে রমজানের অনেক ফযিলত অনেক দাম। একে সত্তর। নফলে ফরজসহ আরো অনেক ফাযায়েলের প্রতিশ্রুতি আছে এ মাসে। কিন্তু এসব দাম ও মানের পেছনে যে কোরআনেরই সব কৃতিত্ব আর সব অবদান। কোরআনের ছোঁয়ায় কিন্তু রমজান ধন্য, মান্য ও অগ্রগণ্য। লাইলাতুল কদরের এতো মান এতো মর্যাদা এসবের পেছনেও কাজ করছে কোরআনের ছোঁয়া ও স্পর্শ। এ রাতে কোরআন এসেছে তাই তো এ রাত এতো দামী ও মান্য।
আফসোস! আমরা রমজানের পাগল, রোযার পাগল, তারাবির পাগল, তাহাজ্জুদের পাগল, লাইলাতুল কদরের পাগল। যে কোরআনের বদৌলতে এগুলোর মর্যাদা সে কোরআনের ব্যাপারেই আমরা উদাসীন। পারি না আমরা কোরআন পড়তে। কেউ পারলেও সহীশুদ্ধ হয় না। আবার কারো সহী হলেও কিছু বুঝে না। রমজান আসে চলে যায়। শবে কদর আসে চলে যায়। ঈদ আসে, চলে যায়। কিন্তু মহামূল্যবান কোরআন কিন্তু আমাদের কাছে সব সময় আছে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কোরআন ছাড়া রমজান যেন সঙ্গী ছাড়া বাসর ঘর। কোরআন যারা পড়তে জানে না তারা রমজানের কি মজা পাবে? কি স্বাদ পাবে?
কোরআনের জন্যই রমজান, এ মাসের দিন রোযার জন্য আর রাত হলো শুধু কোরআনের জন্য। তারাবীহ কোরআনের জন্য তাহাজ্জুদ কোরআনের জন্য। এ মাস কোরআন শোনা ও শোনানোর জন্য। তাই আমরা নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করি,
১. আমি কি কোরআন পড়তে পারি?
২. পারলে আমার পড়া কি সহী-শুদ্ধ হয়?
৩. সারা জীবনে আমার কয়টি খতম করা হয়েছে?
৪. কোরআনের মাস রমজান মাস। এ মাসে কি আমার একটি খতমও হয়েছে? হলে কয়টি হয়েছে?
এসব প্রশ্নের যে উত্তর হয় তার আলোকে নিজেকে গড়ার শপথ নিন। এ বারের রমজানে আপনি কোরআন শেখার শপথ নিন। কোরআন বুঝার শপথ নিন। কোরআন মাফিক আমল করার শপথ নিন। কোরআনের দাওয়াত দেয়ার শপথ নিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।