Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাহে রমজানের মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য

অধ্যক্ষ ড. মুফতী মুহাম্মদ কাফীলুদ্দীন সরকার | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা, উত্তাপতা ইত্যাদি। লিসানুল আরব আভিধান গ্রন্থে এসেছে যে, ‘রমজান’ হচ্ছে কঠিন পিপাসার কারণে পেটের মধ্যে অনুভূত জ¦ালা বা যন্ত্রণা। কারো কারো মতে, রমজান হলো এমন একটি ইবাদত, যা মানুষের কৃত পাপগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে খরতাপে জমিন যেমন চৌচির হয় এবং বৈশাখের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হলে যেমন তাতে তরতাজা শষ্য-শ্যামলিমায় পূর্ণ সবুজ ফসলের সমারোহ চাষির মন প্রফুল্ল করে, তেমনি দীর্ঘ এগারটি মাস পরে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনায় মানবদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কু-রিপুগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং রোজার প্রভাবে মানবের ভেতর-বাহির কালিমামুক্ত হয়ে রোজাদার ব্যক্তি একজন সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়; তখন তার অবস্থান নিষ্পাপ-মাসুম ফেরেশতাদের উপরে চলে যায়। এ কারণেই তো মানব জাতির মর্যাদা ফেরেশতাদরও বহু উপরে।

মুসলিম বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস শা’বানে রোজা আদায় করার বিধান ঘোষিত হয়। মাহে রমজান নানাবিধ কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় একে ‘সাইয়্যেদুস শুহুর’ তথা মাসসমূহের সরদার বলা হয়। এ মাসের নাম পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এ মাসটি পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের নিকট অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসের প্রধান ইবাদত হলো ‘সিয়াম সাধনা’ বা দিনভর রোজা পালন করা, যা একই সূরার ১৮৩ নম্বর আয়াত দ্বারা ফরজ করা হয়েছে। ‘সিয়াম’ শব্দটির অর্থ হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মিলন থেকে বিরত থাকা। যেহেতু মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে একান্তে মিলিত হবার মহাসাধনায় একাকার হওয়ার অবস্থা বিদ্যমান থাকায় পানাহার এবং দৈহিক চাহিদা মেটানোর পথকে পরিহার করা প্রয়োজন বিধায় এবং আল্লাহর পরম প্রেমে মত্ত থাকার কারণে দুনিয়াবী প্রেম ও চাহিদাকে বর্জন করে এ ইবাদতটি রোজাদারকে সার্থক অবস্থানে নিয়ে যায়।

সিয়াম সাধনাকে কেউ কেউ উপবাস বলেছেন। প্রতিটি ধর্মে উপবাস আছে, তবে রমজান মাসে একজন সাবালক ঈমানদার ব্যক্তির উপবাস-রোজা আর অন্যান্য ধর্মের উপবাস এক নয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের উপবাস শুরু হয় মধ্যরাতের পূর্ব থেকে। খ্রিস্টান ধর্মে উপবাস শুরু হয় রাত্র ১০টার পর থেকে। এই ধরনের উপবাস একটানা পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে তবে, কেউ যদি এই উপবাসে ক্ষুধায় কাতর বা দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে তার জন্য খাদ্যগ্রহণে বাধা নেই। তাদের এই উপবাসের উদ্দেশ্য হলো, প্রভুর রাগ বা গোস্বাকে দমন করা, কিন্তু ইসলাম ধর্মে রোজা শুরু হয় সুবহি সাদিক তথা রাতের শেষাংশে, শেষ হয় সূর্যাস্তে। রোজা হবে পুরো একটি দিনে। এতে রাতের মুহূর্ত অংশেও প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এই পুরোটি দিনে খাদ্য-পানীয়, স্বামী-স্ত্রী সম্ভোগের আনন্দ থেকে বিরত থাকার নামই হচ্ছে সিয়াম সাধনা। কোনো ইবাদতে আনন্দ বা প্রফুল্লতা আসা অন্যায় নয়, কিন্তু যে আনন্দে মানুষের মনযোগ নষ্ট হয় এবং উদ্দেশ্য সাধন বিঘিœত হয় এমন আনন্দ এবং প্রফুল্লতা থেকে বিরত রাখতে এবং আনুগত্যের চরম পর্যায়ে উন্নীত হতে পানাহার এবং স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থকার বিধান একান্তই জরুরি। কেননা, খাবারে বিলাসিতা এবং স্বামী-স্ত্রীর আনন্দে লিপ্ত হওয়া সাধনায় সিদ্ধি অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে, রোজাদার সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালনে বা উপবাসে ক্ষুধায় কাতর হলেও অন্যান্য ধর্মের মতো উপবাসের মধ্যভাগে কোনভাবে খাদ্যপানীয় গ্রহণের কোনরূপ সুযোগ নেই। কেননা, খাদ্যে রিপুর সজীবতা বিদ্যমান রয়েছে, যা লক্ষ্য অর্জনের অন্তরায়। রোজার মাহত্ম্য তাৎপর্য এখানেই। তাছাড়া ইসলামের দৃষ্টিতে সিয়াম সাধনায় উদ্দেশ্য প্রভুর রাগ বা গোস্বা দমন করা নয়, বরং সিয়াম সাধনায় একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করে নিজের অপরাধসমূহ এবং কু-রিপুসমূহকে পুড়িয়ে ফেলে নিষ্পাপ ফেরেশতাদের চেয়েও তাকওয়ার সর্বোস্তরে আরোহণ করা এবং আরো পবিত্রতর জীবনলাভে নিজেকে ধন্য করা। সিয়াম সাধনার এই ইবাদতটিতে মানুষের মানবীয় গুণগুলো বিকশিত হয়। তার ভেতরে গুনাহের আবরণে বা কালিমায় আচ্ছাদিত অনুভূতির স্পর্শকাতর স্থানগুলো আবরণমুক্ত হয়ে যায়। খোলা চোখের ন্যায় সে পরের দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি অনুধাবন করা শুরু করে। এই সিয়াম সাধানায় আত্মনিয়োগের ফলে সে তার সর্বপ্রকার অপরাধ দিবালেকের ন্যায় দেখতে পায় এবং সেগুলো থেকে মুক্তিলাভের অন্তরায়গুলোর অপনোদন ঘটিয়ে নিজেকে অভিযোগমুক্ত করে ফেলে।

রোজা দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টির পাশাপাশি গুনাহের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। সিয়াম সাধানার কারণে একজন রোজাদার বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়। সে তখন রোজার মতো ইবাদতটির বহুবিধ উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম হয়। সে তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে যে, রোজা তথা মাহে রমজান কেবল উপবাসের নামে একটি ইবাদতকে সাথে নিয়ে আসেনি, বরং অসংখ্য উদ্দেশ্যে নিয়ে এই মাসটির আগমন ঘটেছে, যার ইবাদতগুলো রাত্র-দিন চব্বিশ ঘণ্টা ধারাবহিকভাবে সাজানো। সিয়াম সাধনায় মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রীয় যেমন সতেজ হয়, তেমনি সে মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হয়; সে মানুষের অমানবীয় ও অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট সহজেই অনুভব করতে সক্ষম হয়। এ মাসটি কুরআনের মাস। এ মাসটি মহান ইবাদতের মাস। এ মাসটি মানবতা প্রদর্শনের মাস। এ মাসটি সুশীল সমাজ গঠনের মাস এবং এ মাসটি হালাল রুজি উপার্জনের শপথ গ্রহণের মাস। এ কারণে একজন রোজাদার ব্যক্তির মাহে রমজানে অসংখ্য বিষয়ের অনুশীলন করতে হয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে সে জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়ে থাকে। সিয়াম সাধানার মতো এমন একটি ইবাদতের মধ্যমে রোজাদার ব্যক্তির আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে। সে আদর্শবান ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং সে আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি নিতান্তই মানবিক এবং সামাজিক হয়।

মাহে রমজানের মানবিক (যঁসধহরঃু) তাৎপর্য

মাহে রমজানের সিয়াম সাধনায় রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে কেবল আল্লাহভীতিই সৃষ্টি হয় না, বরং তার মধ্যে মানবিক গুণগুলোও বিকশিত হয়। রোজার সফলতা কেবল উপবাসেই নয়, বরং এর সফলতা হলো, রোজাদারের মধ্যে মানবিক গুণগুলো তেজদীপ্ত করে তোলা। মানুষ সৃষ্টির সেরা বটে, কিন্তু অনেক সময় অমানবিক হয়ে যায়। সে এ জমিনে আল্লাহর খলিফা-প্রতিনিধি হওয়া সত্তে¡ও সৃষ্টির প্রতি তার কী কী কর্তব্য রয়েছে তা পালনে সে উদাসীন হয়ে যায়। মানবিকতা হলো, আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালবাসা, তার জন্য দরদী হওয়া, তার সুখে-দুঃখে সুখী এবং দুঃখী হওয়া এবং মানবজীবন থেকে দুর্দশা লাঘবে সাধ্যমত চেষ্টা করা। পরদুঃখে কাতর, কোমল হৃদয় এবং দয়ালু হওয়া। মানবতা নিয়ে কারো পাশে অবস্থান করা। মানবিক বা মানবিকতার বিপরীত শব্দ হলো, পাশবিক বা পাশবিকতা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, একজন ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় কাতরাচ্ছে, তাকে চিকিৎসার জন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া একটি মানবিক বিষয়। এখানে মানবতা অর্থ হলো মানবের কল্যাণে এগিয়ে আসা। করোনা রোগে মৃতব্যক্তি; যার দাফনে বা শেষকৃত্য করতে কেউ নেই, তার শেষকৃত্যে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার নাম হলো মানবতা। পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষকে মানবিক এবং একান্তই মানবদরদী বানায়। সে কেবল মানবের জন্যই মানবিক হয় না, বরং সৃষ্টির সেবায় সে তার মনুষত্ব ও মানবতা প্রদর্শন করে। তার দ্বারা একটি পিঁপড়াও কষ্ট পায় না।

হাদীস শরীফে এসেছে, একজন ব্যক্তি একটি কুকুরের পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করায় আল্লাহপাক তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে তাকে জান্নাতী ঘোষণা করেছেন। রাস্তায়-পথে যারা ক্ষুধায় কাতর তাদের ক্ষুধার যাতনা উপলব্ধি করে দু’মুঠো খাবার নিয়ে তাদের সামনে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে আর মানবতা কী আছে? মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘ঐ ব্যক্তির নামাজ নেই, যে পেটপুরে রাত্রে ঘুমোচ্ছে, অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে আছে।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপর্যয়, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত, দুস্থ-অনাথ, বুভুক্ষ, নিরন্ন, অনাহারী, বিবস্ত্র, চিকিৎসাহীন, আহাজারীকরা মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের খোঁজ নেয়া এবং দুঃখ মোচনের ব্যবস্থা করার মানবিক শিক্ষা দেয় মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা। এ ক্ষেত্রে মাহে রমজানের তাৎপর্য অপরিসীম। ৩১ লক্ষ বর্গমাইলের শাসক খলিফা ওমর (রা.) রাতের বেলায় গরিব-দুঃখীদের খোঁজে বের হতেন। গভীর রজনীতে পানির পাতিল উনানে বসিয়ে দিয়ে অনাহারী শিশু সন্তানদের মা এই বলে প্রবোধ দিচ্ছিলেন, বাছা! একটু ধৈর্য ধরো, খাবার তৈরি হচ্ছে! হযরত ওমর তা দেখে একান্তই মানবিক হয়ে তিনি নিজের কাঁধে আটা এবং গুড় বহন করে মায়ের নিকট খাবার পৌঁছে দেন, এর নামই হচ্ছে মানবিকতা। আসন্নপ্রসবা মায়ের জন্য গভীর রজনীতে খাবার পৌঁছিয়ে দিয়ে হযরত ওমর (রা.) তার দুঃখ ঘুচান। জেরুসালেম গমনের পথে ভৃত্যের কষ্ট উপলব্ধি করে তিনি উট থেকে নেমে নিজের আসনে ভৃত্যকে বসিয়ে দিয়ে উটের লাগাম ধরে পথ হাঁটলেন। এগুলোই হচ্ছে মানবিকতা। মাহে রমজানের রোজা রোজাদারকে জীবনের জন্য এমনই মানবিক বানায়। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনে, তার ভাষা-পরিভাষা এবং ব্যবহারে পরিবর্তন আনে।

মাহে রমজানের সিয়াম সাধনায়রত রোজাদার পুরোটো দিন পানাহার বন্ধ রাখে। ফলে তার এই সময়কার ক্ষুধার জ্বালা অপরের ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করার সুযোগ করে দেয়। আর এই কারণে রোজাদার ব্যক্তি গরিব-দুঃখীদের প্রতি দরদী হয়ে থাকে। এটি মাহে রমজানের বদৌলতে একটি উজ্জ্বল মানবিকতা। তাছাড়া মহানবী (সা.) মাহে রমজানকে শাহরুল মুআসাত তথা সহানভূতি ও সহমর্মিতার মাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোজাদার মুসলিমগণ এ মাসে একান্তই মানবিক হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের সাথে নিয়ে ইফতার করে অথবা তাদেরকে ইফতার সামগ্রী কিনে দেয়। যাকাত, ফিতরা এবং সাধারণ দান-অনুদান নিয়েও বিত্তবানরা দুঃখীদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গিত করে।

মাহে রমজানের সামাজিক তাৎপর্য
নামাজের মতো একটি ইবাদতে অংশগ্রহণ করার কারণে প্রতিটি মুসলিম সামাজিক হয়। নামাজ মানুষকে যেমন সামাজিক হতে সাহায্য করে, তেমনি মাহে রমজানের পবিত্র সিয়াম সাধনা একজন রোজাদার মুসলিমকে অধিকতর সামাজিক হতে সাহায্য করে। মুসলমানের নিকট তার নিজের জীবন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি পাড়া-প্রতিবেশীর জীবনও তার নিকট তেমন গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে মহানবী (সা.) বলছেন: সে ব্যক্তি মু’মিন নয় যে পেট পুরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী উপোস করে রাত কাটাচ্ছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের সবাইকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করার নামই হচ্ছে সামাজিকতা। সামাজিক বন্ধন সৃষ্টিতে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন: যে রোজাদার ব্যক্তি অপর কোনো রোজাদারকে সাথে নিয়ে ইফতার করল মহান আল্লাহ তার জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির পয়গাম শুনান এবং এই ইফতারীর কারণে রোজাদারের কোনো সওয়াবের ঘাটতি হবে না। পবিত্র মাহে রমজানে ইফতার মাহফিলে আপনজন আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীকে নিয়ে একত্রিত হওয়ার চেয়ে সামাজিক বন্ধন আর কী হতে পারে? গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকিন, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে এমনকি মুসলিম অভাবীদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিলিবণ্টন করে এক বড় ধরনের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করা যায়। এটি সম্ভব কেবল মাহে রমজানে। ইফতারের কিছু পরেই মসজিদে তারাবীহের নামাজ আদায়ের জন্য একত্রি হওয়া এবং দীর্ঘক্ষণ যাবত তারাবীহ, বিতর ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ সত্যিকারে সামাজিক বন্ধনকে আরো মজবুত করে তোলে। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহভীতি লাভের পাশাপাশি মানবিক ও সামাজিক গুণগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন: আল্লাহ সেই পরিবারকে ভালবাসেন যে আল্লাহর পরিবারকে ভালবাসে। আর আল্লাহর পরিবার হলো, আল্লাহর সৃষ্টি সকল মাখলুক।

রোজার সামাজিক প্রভাব হলো: কোনো অবস্থাতেই রোজদার মুসলিমের জন্য শোভনীয় নয় যে, সে কাউকে গালি-গালাজ করবে। যে এমনটা করবে, তার এই রোজার কোনো প্রয়োজনই আল্লাহর নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘সিয়াম সাধনা হলো ঢাল স্বরূপ। রোজা রেখে কেউ যেন কাউকে গালি না দেয়। যদি কেউ রোজাদারকে গালি দেয় তাহলে সে যেন বলে যে, আমি একজন রোজাদার।’ রোজদার বক্তির উপর এমন নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে যে, মাহে রমজানের রোজা একজন মুসলিমকে সুশীল সমাজের একজন মহান সম্মানীয় ব্যক্তিতে পরিণত করে।

মাহে রমজানের অর্থনৈতিক তাৎপর্য
হালাল খাবার আহরণ করা একজন মুসলিমের জন্য ঈমানের পরে অপরিহার্য একটি বিষয়। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা একজন ব্যক্তির মধ্যে যখন আল্লাহভীতি তৈরি করে, তখন সে এতই সতর্ক হয় যে, কোনো অবস্থাতেই সে আর হারাম উপার্জন করতে চায় না। তাছাড়া রোজার মতো একটি ইবাদত রোজাদার ব্যক্তির সাথে থাকার কারণে রোজা তাকে হারাম থেকে বারণ করে, যা অন্যান্য ইবাদতে হয় না। যেমন, বাজারে কেনাকাটার সময় নামাজ উপস্থিত থাকে না, বিধায় সে হারামে পতিত হতে পারে। কিন্তু রোজা এমন একটি গোপন ইবাদত, যা রোজাদারের সাথেই উপস্থিত থাকার কারণে সে ঐ হারাম কাজটি করতে সক্ষম হয় না। সিয়াম সাধনা যেহেতু একজন রোজাদারের মধ্যে গরিব-দুঃখীদের প্রতি সহানভূতির মানসিকতা জাগ্রত করে, তখন সে নির্দিধায় তার উপরে ফরজ যাকাত এবং সাদাকাতুল ফিতর গরিব-দুঃখীদের নিকট বিতরণ করা শুরু করে দেয়। তার অবস্থা এমন হয় যে, তার অর্থের বিনিময়ে আল্লাহর জান্নাত ক্রয়ের জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে। সহীহ বুখারীর হাদীসে এসেছে যে, যখন রমজান মাস আগমন করে তখন মহানবী (সা.) এতই দানশীল হয়ে যেতেন যে, গতিশীল বাতাসও তাঁর সথে পাল্লা দিতে কুলাতে পারতো না। তিনি তীব্রগতিতে তার হাতের অর্থ দ্রুত গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলি-বণ্টন করে দিতেন। কেননা, রমজান মাসে একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমান। অনুরূপভাবে একটি ফরজ আমল অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আমলের সওয়াবের সমান। এ কারণে প্রিয়নবী (সা.) দু’হাতে অর্থ-কড়ি বিলাতেন। এ হলো মাহে রমজানের অর্থনৈতিক তাৎপর্য।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে মাহে রমজানের বদৌলতে একান্তই মানবিক, সামাজিক এবং উদারহস্ত হওয়ার তৌফিক দান করেন।

লেখক: গভর্নর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজান


আরও
আরও পড়ুন