মাহে রমজানের মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য
হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা,
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত উম্মতে মোহাম্মাদীর উপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ এই আয়াতেকারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে সিয়াম সাধনা বা রোজার দুটি দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এর একটি হলো, বাহ্যিক দিক এবং অপরটি আধ্যাত্মিক দিক। আমরা এই নিবন্ধে রোজার আধ্যাত্মিক দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রয়াস পাবো। আল্লাহপাকই সকল অবস্থায় সহায়তাকারী। মূল বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে আমাদেরকে মিছাল বা উদাহরণের দ্বারস্থ হতে হবে। আমরা মানুষ। আমাদের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান। পা হতে মাথা পর্যন্ত সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই দেখা যায়। কিন্তু বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিজ থেকে কোনো কিছুই করতে বা আঞ্জামদিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে মূল প্রাণশক্তি, প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা শক্তি যুক্ত না হয়। রোজাদারের বাহ্যিকদেহ কাঠামো ও এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর অবস্থাও তাই। প্রাণ শক্তি ও ইচ্ছা শক্তির পরশ ছাড়া বাহ্যিক অঙ্গাবয়ব দ্বারা কিছুই হাসিল করা যায় না। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রোজাদারগণের বাহ্যিক পানাহার পরিত্যাগ করা, কামাচার পরিহার করা, পাপাচার বর্জন করা, মিথ্যার বেসাতী ত্যাগ করার প্রয়াস তখনই সার্থক হবে, যখন এগুলোর সাথে প্রাণশক্তি ও ইচ্ছা শক্তির সমন্বয় সাধিত হবে। মূলত এটাই সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল। আর এই পরিমন্ডলের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ইরশাদ করেছেন: ‘লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’
এই আয়াতাংশে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, তাকওয়া বা পরহেজগারীর শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে রোজা রাখার একটা বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান রয়েছে। কেননা, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বিশেষ এক শক্তি অর্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেটাই হলো তাকওয়া বা পরহেজগারীর মূল ভিত্তি। যেখানে মূল ভিত্তির উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না, সেখানে বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শনের কোনই মূল্য নেই।
আমরা জানি, মানুষের প্রবৃত্তি ছয়টি রিপুর তাড়নায় বিপথগামী হয়ে থাকে। এগুলো ইচ্ছে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলকে এই রিপুগুলো দূষিত ও কলুষিত করে তোলে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রিপুগুলো অবদমিত ও দুর্বল হয়ে যায় এবং অভ্যন্তরের সর্বত্র সৎ ও পরিচ্ছন্নতার আলোক রশ্মির বিকিরণ ঘটে। একই সাথে কলুষমুক্ত পরিবেশ ও পরিমন্ডলের অবতারনা ঘটে, যা তাকওয়া ও পরহেজগারীর দিগন্তকে আরও বিস্তৃত ও প্রশস্ত করে তোলে। মূলত সিয়াম সাধনার মূল সফলতা এর মাঝেই নিহিত রয়েছে।
মানবজীবনের সামগ্রিক উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে ধৈর্য ও সহনশীলতার গুরুত্ব অপরিসীম। ধৈর্যহারা মানুষ কিছুতেই কামিয়াবী হাসিল করতে পারে না। রাসূলে পাক (সা.) স্পষ্টতই বলেছেন: ‘এই মাস ধৈর্য ও সবরের মাস।’ এই মাসে করণীয় রোজা পালনে ধৈর্যের বাঁধনকে অটুট রাখতে হবে। সবর ও ধৈর্য না হলে রোজা পালন করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। রোজার সকল অংশেই সবর, ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংযমী ভাবধারা অব্যাহত রাখা দরকার। লোভ, লালসা সংবরণ না করলে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার, কামাচার, পাপাচার হতে নিজেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ধৈর্যহারা হয়ে গেলে ক্ষুধা ও পিপাসার জ্বালা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই, এক মাসের সিয়াম সাধনা মানুষকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয় এবং ত্যাগী মনোভাব গ্রহণের প্রতি উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণীত করে তোলে। ফলে রোজাদারগণ ক্ষুধা কাতর মানুষের প্রতি সহৃদয়াতা প্রদর্শনে আগ্রহী হয়ে উঠে।
সিয়াম পালনকারীদের ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রোজা পালন করা একান্ত অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে মহানবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ এই হাদীসে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি হলো ঈমান এবং অপরটি হলো ইহতিসাব। ঈমান শব্দ দ্বারা এই তাৎপর্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রোজা পালন করতে হবে এই বিশ্বাস সহকারে যে, রোজা আল্লাহপাকই ফরজ করেছেন। পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে এই রোজা অবশ্যই পালন করতে হবে। এর অন্যথা করা যাবে না। আর ইহতিসাব শব্দযোগে এই তাৎপর্যকে তুলে ধরা হয়েছে যে, রোজা পালন করতে হবে একমাত্র আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি লাভের উদ্দেশ্যে। লোক দেখানো বা সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নয়। এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে রোজা পালন করতে হবে যে, এর দ্বারা আল্লাহপাকের নিকট হতে এক বিশেষ সওয়াব ও বিনিময় ফল লাভ করা যাবে। এরমধ্যে রয়েছে জীবনের গোনাহসমূহ মাফ হয়ে যাওয়া। এটা আল্লাহ পাকের একটি বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি এর দ্বারা সিয়াম সাধনাকারীদের অবশ্যই অনুগৃহীত করবেন।
হাবীবে কিবরিয়া মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: ‘রোজা ঢাল স্বরূপ’। ঢাল বা বর্ম শত্রæর আক্রমণ ও আঘাত প্রতিরোধ করে ও ব্যর্থ করে দেয়। দুনিয়ার জীবনে রোজাদারকেও আল্লাহপাক গোনাহ খাতা ও পাপাচার থেকে বিমুক্ত রাখেন। এই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার কারণেই সে পরকালে জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। এজন্য প্রত্যেক রোজাদারকে সকল প্রকার গোনাহের কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। অশ্লীল কথাবার্তা, বাগাড়াম্বর, হৈ-হুল্লোড় ও শোরগোল পরিহার করতে হবে। একই সাথে আল্লাহপাকের স্মরণে কায়মনে আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং সকল প্রকার জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকবিরোধী কাজ পরিহার করতে হবে। এতে করেই সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল সুশোভিত হয়ে উঠবে এবং রোজাদারদের ব্যক্তিজীবন হতে শুরু করে জাতীয় জীবনের সকল অঙ্গনে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষতার আবহ পরিব্যাপ্ত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।