মাহে রমজানের মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য
হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা,
মানুষকে সৃষ্টি করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে কাজ নিতে চেয়েছেন, তার উপযোগী বিধি-বিধান দিয়েই তিনি প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূলদের। শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ রূপ দান করেন। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘মানুষ ও জিন সম্প্রদায়কে আমি কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি, আর কোনো উদ্দেশ্য নয়’ (সূরা যারিয়াত : ৫৬)। এখানে ইবাদত অর্থ, সর্বাত্মক আনুগত্য ও সার্বক্ষণিক দাসত্ব। ইসলাম মানুষের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নীতি-পদ্ধতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে তার সত্তাগত নিয়ম-নীতির উপর। অর্থাৎ ইসলাম একজন রাজা, প্রজা, পিতা, পুত্র, শ্রমিক, মালিক, শিক্ষিত, মুর্খ, নারী বা পুরুষরূপে না দেখে তাকে দেখে একজন মানুষরূপে। চেষ্টা করে মানুষটিকে সুশীল, সভ্য, ভালো এবং সচেতন বানাতে। এরপর যখন এ মানুষটি ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষিত হবে তখন সে ভালো মানুষ হওয়ার সুবাদে একজন ভালো ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষিত ব্যক্তি হবে। প্রজা হলে ভালো প্রজা। পিতা, পুত্র, ধনী, দরিদ্র, শহুরে, গেঁয়ো, মালিক, শ্রমিক, নারী, পুরুষ; মোটকথা সে সমাজ, পেশা, লিঙ্গ বা মর্যাদার যে স্তরেই অবস্থান করুক না কেনো ‘ভালো মানুষ’ হওয়ার দরুন সে সর্বক্ষেত্রেই ভালো করবে। সর্বোপরি তার উপর ছায়া বিস্তার করবে ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক বা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় নীতি-আদর্শ।
মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে বিশুদ্ধ ও খাঁটি করে তোলার জন্য ইসলাম গুরুত্ব দেয় তার সার্বিক জীবনোপাদানের উপর। সংস্কার করে তার দেহ, আত্মা ও মেধাকে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, বিদ্বেষ, অপচয়, কার্পণ্য, ভীতি, সংশয়, দুঃসাহস, অপরিণামদর্শিতা, অপচিন্তা, দম্ভ, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, পরনিন্দা, ছিদ্রান্বেষণ ইত্যাদি মনন ও আত্মাশ্রয়ী রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা ইসলাম করে। দুনিয়ার আর কোনো ব্যবস্থা বা ধর্ম এসব বিষয়ে এতো সুসামঞ্জস্যশীল, ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা দেয়নি। দিতে পারেও না। কারণ, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন যিনি তিনি ছাড়া আর মানুষের মন, মনন ও আত্মা সম্পর্কে এতো বিশদ আর কে জানে?
মানুষের মন, মনন, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দেহ ও আত্মার সুনিয়ন্ত্রণ এবং সুচারু পরিচালনা সম্ভব কেবল তাকওয়ানির্ভর জীবন সাধনার মাধ্যমে। তাকওয়া অর্থ মানুষ আল্লাহকে ভয় করে খুবই সতর্কতার জীবনযাপন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী ব্যক্তিটিই আল্লাহ পাকের কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মানিত।
হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীসের মর্ম এই, আমি আমার নিজেকে এবং তোমাদের সকলকে তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দেই। আল্লাহকে প্রকাশ্য ও গোপন তথা সর্বত্র সর্বদা ভয় করে চলবে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার নিজ বক্ষদেশের প্রতি হাতের ইশারা করে বলেন, তাকওয়া তো এখানে থাকে। তাকওয়া থাকে এখানে। এখানে থাকার বস্তু হলো তাকওয়া। হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তোমাদের চেহারা, সুরত, আমল ও আচরণ দেখে বিচার করবেন না। তিনি তো দেখবেন তোমাদের অন্তরের দিকে।
অন্তরের গহীন গভীর প্রকোষ্ঠে আল্লাহর ভয়, পরকালে জবাবদিহিতার চিন্তায়, কবর, হাশর ও পুলসিরাতের বিপর্যয়ের উৎকণ্ঠায় যে মানুষ অস্থির হয়ে থাকে তার পক্ষে আল্লাহর ইচ্ছা মাফিক চলা এবং তার অসন্তুষ্টির কাজ থেকে দূরে থাকা সহজ। আর এ সতর্কতাপূর্ণ সাবধানী জীবনের নামই ‘পরহেজগারীর জিন্দেগী।’ এ সচেতন, সতর্ক ও সাবধানী মানুষই মুত্তাকী। আল্লাহপাক বলেন, কুরবানীর পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, আল্লাহর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।
তাকওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহপাক মানুষকে অনেক মাধ্যম শিখিয়েছেন। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা কার্যকর এবং বিশিষ্ট মাধ্যম হলো ‘সিয়াম’। সিয়াম বা সওম বলা হয় রোযাকে। দিনের বেলা পানাহার ও সম্ভোগ থেকে বিরত থাকার নাম রোযা। আবশ্যিকভাবে এ রোযা পালন করতে হয় বছরের একটি মাস, চান্দ্র মাসের নবম মাস রমজান শরীফে। আল্লাহপাক বলেন, ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ন্যায় তোমাদের উপরও রোযা ফরজ করা হলো, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান শরীফকে আখ্যায়িত করেছেন মহান মাস, ধৈর্য ও সবরের মাস, সহমর্মিতার মাসরূপে। আল্লাহ পাক বলেছেন, রমজান কুরআন নাযিলের মাস। বলা হয়েছে, রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও মুক্তির মাস। এ মাসের সাথে পাক কুরআনের সম্পর্ক চাঁদের সাথে তার আলোর ন্যায়। ঈমান ও মূল্যবোধ নিয়ে রমজানের রোযা রাখলে এবং এর রাতগুলোতে কুরআন চর্চা ও নামাজরত থাকলে পূর্বেকার সকল গোনাহ মাফ হয়ে যায়। এ মাসের একটি ফরজ অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমমানের। আর এ মাসের কোনো নফলের প্রতিদান অন্য সময়ের ফরজের সমতুল্য।
হাদীস শরীফে এসেছে, রমজান পেয়েও যে ব্যক্তি তার গোনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারলো না, তার চেহারা ধুলি ধুসরিত হোক।
রমজানের রোযা পালনের পর স্বাভাবিক পানাহার ও সম্ভোগে ফিরে যাওয়া তথা বারণ-পর্ব ভঙ্গের জন্য আল্লাহ তাআলা একটি দিনকে আনন্দ ও উৎসবের দিনরূপে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই উৎসব-আনন্দের দিন থাকে, আমাদের আনন্দের দিন এটি। এ দিনে পানাহার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা বা রোযা রাখা হারাম।
ঈদের দিনে আল্লাহ তাআলা তার ফেরেশতাদের বলেন, যে শ্রমিক তার দায়িত্ব পালন করেছে তার অধিকার কি বলো। ফেরেশতারা জবাব দেন, তার পারিশ্রমিক পাওয়াই তার অধিকার। আল্লাহপাক তখন বলেন, আমার মহত্ত ও বড়ত্ব ও সার্বভৌমত্বের শপথ! আমার দাস-দাসীরা দায়িত্ব পালন করেছে, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। ঘোষণা দেয়া হল, ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে যাও ক্ষমাপ্রাপ্ত ও কৃপালব্ধ হয়ে।
ক্ষমা, করুণা, নাজাত ও আশিষ লাভের আনন্দ এ ঈদ। ঈদুল ফিতর। এ ঈদে আল্লাহপাকের নাফরমান বান্দাদের আনন্দের কোনো হেতু নেই। বে-রোযদার , বে-নামাজীদের কোনো হিস্যা নেই এ আনন্দে। এ আনন্দ তাদেরই যারা কাজ করা শ্রমিক। কাজ পালানো শ্রমিকের কিছু নেই এতে। আল্লাহর গোলামী যারা করে যারা তাকওয়া অবলম্বনের চেষ্টায় জীবনপাত করে তাদের জন্যই মোবারক ঈদুল ফিতর।
আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বন, দ্বীনকে বুঝা, দ্বীনের উপর চলা এবং আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দা হওয়ার তওফীক আমাদের সকলকে দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।