Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তাপদাহে দুর্বিষহ জীবন

ভ্যাপসা গরমের দাপট আরও চার-পাঁচ দিন : বিদ্যুৎ পানি সঙ্কটে দুর্ভোগ চরমে : ঘরে ঘরে মানুষ অসুস্থ : বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’র শক্তি বৃদ্ধি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

প্রচন্ড তাপদাহে পুড়ছে দেশ। সর্বত্র দুর্বিষহ জীবনযাত্রা। দিনভর সূর্যের আগুন যেন মাটিতে গলে পড়ছে। রাতেও নেই স্বস্তি। আবহাওয়ায় উন্নতির সুখবর আপাতত নেই। তার মানে হিমেল দমকা হাওয়া মেঘ বৃষ্টি কখন শীতল স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেবে তার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। খরার দহনে অতিষ্ঠ মানুষ তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। নেই মেঘ নেই শান্তির বরিষণ। ভ্যাপসা গরমের দাপট চলছে দুই সপ্তাহ ধরে। গতকাল (সোমবার) সারাদেশে খরতাপ আরেক দফা বেড়েছে। বরেন্দ্র জনপদ রাজশাহীতে আগের দিনের চেয়েও পারদ গরম হয়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেছে। যা চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের সর্বোচ্চ রেকর্ড। মরা পদ্মার ধূ ধূ চরের বালু মরুর আগুনের ঝাপটা দিচ্ছে।
দেড় কোটি মানুষের ঠিকানা ‘ইট-পাথরের খাঁচা’ রাজধানী ঢাকায় পারদ ৩৬ থেকে ৩৭ ডিগ্রিতে থাকলেও বাস্তব তাপের দহন ৪৪ ডিগ্রি। সমগ্র দেশে অসহনীয় গরমে ঘরে-বাইরে টেকা যাচ্ছে না। সকাল হতেই শুরু তীর্যক সূর্যের আগুন ঝরা দিনমান। রাতের তাপমাত্রাও ২৮ ডিগ্রির ঊর্ধ্বে। ফ্যানের সাথে ঘরময় ঘুরছে গরম বাতাস। জলীয়বাষ্পের মাত্রা অত্যধিক হওয়ার কারণে মানুষের শরীর অনবরত ভিজে যাচ্ছে অসহ্য ঘামে। সিলেট ও রংপুর বিভাগের দুয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাতে তাপমাত্রা সাময়িক কমলেও দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ অসহীয় পর্যায়ে উঠেছে।
গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে রোজ বিদ্যুৎবিভ্রাট, লোডশেডিং ও পানির সঙ্কটে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ডায়রিয়া, আমাশয়, পানিশূণ্যতার কারণে হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী রোগব্যাধিতে ঘরে ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষজন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের শহর নগর গঞ্জের হাসপাতাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ক্লিনিক ও চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। তাছাড়া স্কুল কলেজ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গিয়ে ঘামে-গরমে কাহিল হয়ে পড়ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাসে উপস্থিতির হার অনেকটাই কমে গেছে। কোথাও কোথাও গ্রীষ্মকালীন আগাম ছুটি দেয়া হয়েছে। অবিরাম তাপদাহ পরিস্থিতির মুখে গরীব দিনমজুর দিনে এনে দিনে খাওয়া লোকজনের রুজি-রোজগার কঠিন হয়ে পড়েছে।
আবহাওয়া বিভাগ ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া-জলবায়ু নেটওয়ার্ক সূত্র বলছে, ভ্যাপসা গরমের দাপটের সাথেই এহেন বৈরী আবহাওয়া চলতে থাকবে আরও চার-পাঁচ দিন। এরপর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’ উপক‚ল অতিক্রম করে গেলে তার প্রভাবে মেঘ-বৃষ্টি বাদলের সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে এখনও শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’। ‘ফণি’ কবে আঘাত হানতে পারে তা সর্বশেষ মতিগতি নিরিখে স্পষ্ট নয়। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র-তামিলনাডু উপক‚ল বরাবর উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে ঘূর্ণিঝড়টি গতিপথ বজায় রেখে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। ‘ফণি’ বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚ল থেকে প্রায় ১৪শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে।
সর্বশেষ বিশেষ আবহাওয়া বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুছ জানান, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’ আরও উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ১৫৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর থেকে ১৪৬০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৪৮০ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৪৫০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
‘ফণি’ আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
রেকর্ড তাপদাহ রাজশাহীতে ৪০ ডিগ্রি
গতকাল চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের রেকর্ড তাপদাহ রাজশাহীতে ৪০ ডিগ্রি সে.। আগের দিন রোববার সেখানে পারদ ছিল ৩৯.৯ ডিগ্রিতে। গতকাল ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬.৩ এবং সর্বনিম্ন ২৮.৩ ডিগ্রি সে.। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৩৪.৪ এবং সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সে.। ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ জেলায় দিনের তাপদাহের পাশাপাশি রাতের তাপমাত্রাও ২৭ ডিগ্রির ঊর্ধ্বে উঠেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দুয়েকটি জায়গায় বিক্ষিপ্ত ছিটেফোঁটা বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে সিলেটে ১৪, শ্রীমঙ্গলে ২, রংপুর বিভাগের রাজারহাটে ৪ মিলিমিটার।
আজ (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, রংপুর ও সিলেট বিভাগে দুয়েক জায়গায় সাময়িক দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টি কিংবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া সমগ্র দেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
রাজশাহী, ঢাকা ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায়ও আবহাওয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। এর পরের ৫ দিনে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, তীব্র তাপদহ আর বিদ্যুতের যাওয়া আসার খেলায় বিপর্যস্ত রাজশাহীর নাগরিক জীবন। ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সকালের সূর্য যেন উঠছে আগুনের হল্কা নিয়ে। বেলা বারোটার মধ্যে তেঁতে উঠছে চারিদিক। বইছে চামড়া জ্বালানো লু হাওয়া। প্রচন্ড খরতাপের সাথে নগরীর কোলজুড়েই পদ্মার বিশাল বালুচর। খরতাপে বালুচর পরিণত হচ্ছে তপ্ত কড়াইয়ে। সেখান থেকে ভেসে আসা গরম বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে জ্বালা ধরাচ্ছে।
খরতাপের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। গতকাল দিনভর বিভিন্ন এলাকায় বার বার বিদ্যুত যায় আর আসে। বিশেষ করে নগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেব বাজার এলাকায় এ অবস্থা ছিল অসহনীয়। মার্কেট গুলোয় ব্যবসায়ী আর ক্রেতার ছিল অস্বস্তিকর অবস্থা। বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিকমত না থাকায় ওয়াসার পানির পাম্পগুলো একসাথে চলেনি ফলে পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। একদিকে খরতাপ আর লোডশেডিং সাথে পানি সঙ্কট চরম বিপাকে ফেলে জনজীবনকে।
গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ পশুপাখি প্রকৃতি। দুপুরের মধ্যে রাস্তা ঘাটে ফাঁকা ফাঁকা ভাব। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে আসছে কম। কষ্ট বেড়েছে দিন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলের মানুষের কাজই মাঠে। এখন ভরা ধানের ক্ষেত। লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে পাট। লাউ কুমড়ো পটল ঢেড়স ঝিঙ্গেসহ শাক স্বব্জির ক্ষেতে রোদে পুড়ে ব্যাস্ত সময় পার করছে কৃষক।
টিনের চালা চুইয়ে নামছে খরতাপ। দালান বাড়ির ছাদের পানির ট্যাংকের পানি যেন ফুটন্ত পানির আধার। এর সাথে যোগ হয়েছে বিদ্যুতের যাওয়া আসার খেলা। অবস্থাকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে। মানুষ আকাশ পানে চেয়ে আছে রহমতের বৃষ্টির জন্য।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ জানায়, তীব্র গরমের কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। হাসপাতালে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশি, হৃদরোগ ও স্ট্রোকসহ বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ইনডোরে চিকিৎসা নিতে আসছেন। এসব রোগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের সংখ্যাও বাড়ছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। ২০০৫ সালের ১২ জুন রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর ২০১৪ সালের ২১ মে উঠেছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল উঠেছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর আর এই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অতিক্রম করেনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তাপদাহ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১৬ জুলাই, ২০২২
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ