Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দিক দর্শন - অনুসরণীয় আদর্শ হযরত ফাতিমা (রা.)

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোছাম্মৎ বিলকিস খানম
বিশ্বের নারীবাদী সংগঠনগুলো আজ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলো নারীদের অধিকার আন্দোলনের বড় সমর্থক। নারী অধিকার এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার কাজ। কিন্তু এ আন্দোলন যদি নারীকে শ্রেণি হিসেবে পুরুষের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে নিপতিত করে তাহলে সমাজ-সভ্যতা কোনটার জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না। নারী-পুরুষ কখনই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সমাজ সভ্যতা বিনির্মাণে এরা একে অপরের পরিপূরক। অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের সূচনায় নারীকে এগুতে হবে ভালবেসে সহযোগিতা অবলম্বনে এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে। নয়তো সমাজ সভ্যতার মূল কাঠামো ভেঙে যেতে বাধ্য হবে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে সভ্যতার প্রাচীন প্রাচীর এবং একক ভীত পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি ধসে গেলে সমাজ সভ্যতা হয়ে পড়ে অস্থির, অসহিষ্ণু এবং নিরাপত্তাহীন।
নারী নিঃসন্দেহে পূর্ণাঙ্গ মানুষ কিন্তু কখনই পুরুষ নয়। নারীকে তার প্রকৃতিগত সৃষ্টি বৈশিষ্ট্য পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করা প্রকারান্তরে তার নারীত্বকে বিসর্জন দিতে বলা। মানুষ হিসেবে নারীর যেমন মর্যাদা আছে পুরুষের তেমনি সমান মর্যাদা রয়েছে। ইসলামে নারী- পুরুষ উভয়ই আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি নারী সব সময়ই পুরুষের পাশে ছিল। যেমন: আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ), ইব্রাহীম (আঃ) ও সারাহ (আঃ), ইসমাইল (আঃ) ও হাজেরা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ), মুসা (আঃ) ও আছিয়া (আঃ), ইয়াকুব (আঃ) ও রহিমা (আঃ), হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও খাদিজা (রাঃ), হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমা (রা.), হোসাইন (রা.) ও যয়নব (রা.) এরা সবাই নারী ও পুরুষের অংশীদারীত্বের উদাহরণ। ইসলামে নারী ও পুরুষ হলো একে অপরের পরিপূরক। আল্লাহ নারী ও পুরুষকে পাশাপাশি রেখেছেন জীবনে শান্তি আনার জন্য এবং নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য।
একমাত্র ইসলামই নারীকে বিশেষ অধিকার দিয়ে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছে। “মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।” (আল হাদীস) এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে নারীকে বসিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে। পবিত্র কোরআনের সূরা আল ইমরানের ১৯৫নং আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, “আমি তোমাদের মধ্যে কারও কাজকে বিনষ্ট করে দিব না, পুরুষ হোক কি স্ত্রী তোমরা সকলেই সমজাতের লোক।” সূরা তাওবার ৭১নং আয়াতে বলা হয়েছে, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ইসলামী সমাজে নারী নিজেকে গৃহে আবদ্ধ রাখবে না এবং সামাজিক কর্মকা- থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখবে না। এতে আরো বলা হয়েছে, নারীরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সক্রিয় ও কার্যকরভাবে অংশ নেবে। ফলে পুরো সমাজ উপকৃত হবে।
সাধারণত কোন দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হলো নারী। তার মানে সমাজের বিকাশ ও উন্নয়নে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত ভূমিকা থাকা দরকার। এ ছাড়াও কোন একটি দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, মোট জাতীয় উৎপাদন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নারী প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। একজন মুসলিম নারী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেন। একজন যোগ্য নারীকে সমাজ উন্নয়নের কাজে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া মানে মূল্যবান মানব সম্পদের অপচয়, যা সমাজের জন্যও বড় ক্ষতির কারণ। ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নে ইসলাম নারীর মর্যাদার বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। সে কারণে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা-তুয-যাহরাকে নারী জাতির আদর্শ মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নারী জাতির মর্যাদার ডেমনেস্ট্র্রেশন করেছেন। হযরত ফাতিমা নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আজীবন ভূমিকা রেখে গেছেন। আরবের অন্ধকার যুগে এই মহীয়সী নারী বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে ইসলামে নারীর দেয়া মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি বিশ্বের নারী জাতির অনুপম আদর্শ। হযরত ফাতিমা (রা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল মহানবী (সা.)-এর কন্যা, তিনি ছিলেন শেরে খোদা হযরত আলী (রা.)-এর স্ত্রী, মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠতম শহীদ বেহেশতে যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের শ্রদ্ধেয়া জননী।
হযরত ফাতিমা (রা.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর হাদীস হতে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের টুকরা। যে তাকে অসন্তুষ্ট করবে, সে আমাকে অসন্তুষ্ট করবে। যে আমাকে অসন্তুষ্ট করবে আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হবে। যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করবে সে অবিশ্বাসী হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের সম্মুখে হযরত ফাতিমার ইবাদত-বন্দেগীর প্রশংসা করতেন। তাই মহানবী (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, ফাতিমার আপাদমস্তক আল্লাহর নুরের একটি প্রতিকৃতি। হাদীসে (কানযুল উম্মাল) স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে হতে হযরত ফাতিমা সর্বাগ্রে বেহেশতে প্রবেশ করবেন।
মহানবী (সা.) তাবুক যুদ্ধের পর খ্রিস্টানদের সাথে মোবাহেলায় হযরত ফাতিমা, হযরত আলী, হাসান ও হোসাইনকে নিয়ে খ্রিস্টানদের মুখোমুখি হন। খ্রিস্টানরা মোবাহেলা না করে ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করেন। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতিমার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, ফাতিমা একটি পুষ্প শাখা। এভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ফাতিমাকে নারীকুলের জন্য আদর্শ এবং সকল মুসলিম নারীর জন্য অনুসরণীয় বাস্তব দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছেন। নারীকুলের শিরোমণি হযরত ফাতিমা ধরণীর বুকে খুব স্বল্পকাল বেঁচে ছিলেন। তিনি মাত্র ১৮ বছর মতান্তরে ২০ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বল্পকালীন জীবনের অধিকারী হলেও তাঁর জ্ঞান ও কর্ম নারী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে রেখে গেছেন। যার অনুসরণ যুগে যুগে মুসলিম নারীদেরকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত করতে থাকবে। শৈশবকাল থেকেই হযরত ফাতেমা নারীকুলের ব্যতিক্রমী আদর্শ মডেল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। শুধুমাত্র জ্ঞান, আমল, তাকওয়া-পরহেজগারী, শালীনতা, লজ্জাশীলতা, পবিত্রতা ইত্যাদির ক্ষেত্রেই তিনি নারীকুলের আদর্শ ছিলেন তা নয়, বরং কন্যা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, সমাজের সদস্য হিসেবে এবং নাগরিক হিসেবেও তিনি ছিলেন নারীকুলের আদর্শ।
হযরত ফাতেমা (রা.) নারীকুলের ভূষণ ও গৌরব। আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও ইসলাম তাঁকে যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তার মাধ্যমে জাহেলী যুগের অবহেলিতা নারীকুল সকল দিক থেকে পুরুষের সমমর্যাদা লাভের অধিকার অর্জন করেছে। অতঃপর জ্ঞান, যোগ্যতা, চরিত্র, তাকওয়া, পরহেজগারী ও সমাজের জনগণের প্রতি খোদায়ী দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে যে কোন নারীর জন্য আল্লাহতায়ালার নিকটেও প্রকৃত ইসলামী সমাজে যে কোন পুরুষের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। অতঃপর নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আল্লাহর পথে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় অগ্রগণ্যতা ও পশ্চাৎপদতা ছাড়া মর্যাদায় অগ্রগণ্যতা ও পশ্চাৎপদতার আর কোন বৈধ ও ইসলাম স্বীকৃত মানদ- থাকলো না। হযরত ফাতিমা (রা.) ছিলেন নারী জাতিকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিতকরণে এক বিপ্লবী পথ প্রদর্শক। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা প্রহণকারী আদর্শ মহান নারী নেত্রী হযরত ফাতিমা (রা.)-কে চর্চা করি, তাঁকে অনুসরণ করি। তাহলে আমরা সত্যিকার অর্থে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুফল হবে।



 

Show all comments
  • Banjo ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:১৬ পিএম says : 0
    Impevssire brain power at work! Great answer!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দিক দর্শন - অনুসরণীয় আদর্শ হযরত ফাতিমা (রা.)
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ