বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
রাজু আহমেদ
বিচিত্র বৈচিত্র্যে চলছে স্বদেশ। ব্যবসায়ীরা সরাসরিভাবে রাজনীতিক হওয়ায় কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করায় নিত্যদিন পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। হু হু করে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়লেও কখনো কোন পণ্যের দাম কমেছে শোনাটা এখন রীতিমত সৌভাগ্যের অংশ। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা ক্রমশ অধোঃগতিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে কোন পণ্যের দাম বাড়ানোর পূর্বাভাস পেলেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন জ্যামিতিকহারে অথচ যখন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কোন পণ্যের দাম কমানো হলেও ব্যবসায়ীরা দাম কমাতেই চান না কিংবা বাধ্য হয়ে কমালেও এমনভাবে দাম কমান যা প্রয়োগের অবস্থায় থাকে না। রাষ্ট্র যা নির্ধারণ করে দেয় তা হয় ব্যবসায়ীদের খুশি রেখে নয়তো নিজের মুনাফা দেখে।
রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী মহোদয় যখন পাঁচ টাকার আধুলি পর্যন্ত তুলে দেয়ার স্বপ্নের কথা শোনান তখন কোন পণ্যের দাম যদি পয়সার অঙ্কে কমানো হয় সেটা খুব হাস্যকর শোনায়। তারপরেও যদি সে পয়সাটুকুও হিসাব করে কম নেয়া হতো তবুও তো ন্যূনতম সান্ত¦নার জায়গা থাকতো। কাগজে কলমে দাম কমানো হয় ঠিক কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না মোটেও। কাকে রেখে কার ওপর প্রশ্ন রাখবো, সেটাও ভাবনার বিষয়। রাষ্ট্র যখন নানা অজুহাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে স্থানীয় বাজারের পণ্যের দামের সমন্বয়ে অমত দেখায় তখন ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফালোভী মনোভাবকে খুব বেশি অপ্রাসাঙ্গিক ঘোষণা করা অবান্তর। রাষ্ট্রেরই বা কতটুকু দোষ। সর্বত্র যখন নৈতিকতার দৈন্যদশা চলছে তখন রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভাববে কেন?
আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে যৌক্তিক সমন্বয়ের কথা বলে সরকার ২৪ এপ্রিলের মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক অকটেন ও পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি কমেছে ১০ টাকা এবং ডিজেল কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে কমেছে ৩ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সাথে সাথেই প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থিত হয় পরিবহন বাড়া কমানোর বিষয়টি। এ বিষয়েও অবশ্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, দূরপাল্লার রুটে প্রতি কিলোমিটারে ৩ পয়সা হারে ভাড়া কমানো হয়েছে। অর্থ্যাৎ পূর্বে প্রতি কিলোমিটারের পরিবহন ভাড়া ছিল ১ টাকা ৪৫ পয়সা, এখন সেটা ১ টাকা ৪২ পয়সা হবে। ডিজেলের দাম কমানোয় দেশের দূরপাল্লার পরিবহন ভাড়া সর্বোচ্চ ১৪ টাকা কমবে। তবে এটুকুও যদি বাস্তবায়িত হতো তাও তো সান্ত¦না ছিল। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কঠোর ভাষায় হ্রাসকৃত ভাড়া কার্যকর করার নির্দেশ দিলেও বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন, পরিবহন কর্তৃপক্ষ ভাড়া কমায়নি মোটেও। দূরপাল্লার রুট ছাড়া এসি বাস ও অন্য কোন রুটে পরিবহন ভাড়া কমানো বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ার পরিবহন মালিকরা পূর্বের মতোই ব্যবসা করছেন। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরেও কোন কোন রুটে ভাড়া বর্ধিত করারও অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুফল তো শুধু পরিবহনে নয় বরং জ্বালানি তেলনির্ভর হয়ে উৎপাদিত অন্য সকল পণ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রেই পাওয়া উচিত কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোন সিদ্ধান্ত কিংবা ব্যবসায়ীদের নৈতিক অবস্থান দৃশ্যমান নয়। বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম কয়েকবার হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী তেলের দাম বাড়ালে কিংবা কমালে রাষ্ট্র গণশুনানির আয়োজন করে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করবে। অথচ যখনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে তখন গণশুনানি আয়োজনের পূর্বেই পরিবহন ব্যবসায়ীরা ভাড়া নির্ধারণ করে নিলেও, দাম হ্রাস করলে তারা কখনো স্বেচ্ছায় ভাড়া কমায়নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ রাষ্ট্রও নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম (১ ব্যারেল সমান ১৫৯ লিটার) যখন ১২২ ডলার ছিল তখন আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রতি লিটার পেট্রোল-অকটেনে ৫ টাকা এবং ডিজেল-কেরোসিনের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। ২০১১ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়লে প্রতি কিলোমিটারে পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল ২৫ পয়সা। অথচ ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১১ টাকা কমানো হলে প্রতিকিলোমিটারে পরিবহন ভাড়া কমানো হয়েছিল ১১ পয়সা। জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস-বৃদ্ধি যাই করা হোক না কেন তৎপরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন ভাড়া যা কমানো হয় তা কার্যকর করাটাই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবহন ছাড়া জ্বালানি তেলনির্ভর অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের দাম কমানোর তো প্রশ্নই ওঠে না বরং একবার যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় তবে সে প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের দাম নিশ্চিতভাবেই বাড়ানো হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুই বছর পূর্বেই জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেলেও দেশীয় বাজারে তা সমন্বয় করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পাওয়ার পর যখন দেশের বিভিন্ন মহল থেকে স্থানীয় বাজারে তেলের দাম কমানোর দাবি উঠে তখন বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) অতীতে ক্ষতির যুক্তি দেখিয়ে আন্তার্জাতিক বাজারের সাথে স্থানীয় বাজারের জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করেনি। এই দুই বছরে বিপিসি সকল ক্ষতি কাটিয়ে, দেনা-পাওনা শোধ করে ১৪ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। গণমাধ্যমের বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ সময়ে বিপিসিতে বিপুল অর্থ লুটপাটও হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১২২ মার্কিন ডলার ছিল তখন দেশীয় বাজারে যে দামে তেল বিক্রি হতো, এখন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ২৭-৩০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে অথচ প্রতি লিটারে দাম কমানো হয়েছে মাত্র ৩ টাকা। দেশে প্রতি লিটার বোতলজাত পানির মূল্যের চেয়েও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম অনেক কম হওয়ার পরেও পানির চেয়ে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে । জ্বালানি তেল (পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল) থেকে বিপিসি ৮০ ভাগ লাভ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তুলনা করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হিসাব থেকে দেখা গেছে, প্রতি লিটার অকটেন থেকে বিপিসি ৪৫ টাকা, পেট্রোল থেকে ৪০ টাকা, ডিজেল থেকে ২৭ এবং ফার্নেস অয়েল থেকে ৩০ টাকা লাভ করেছে (বিগত দু’বছর)। দেশে প্রতি বছর গড়ে জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে ৫৩ লাখ ২১ হাজার টন (১ হাজার ১০০ কোটি লিটার)। প্রতি লিটারে বিপিসি যা লাভ করছে এবং যে হিসাব দেখাচ্ছে তাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গড়ে সর্বনি¤œ ৫ টাকা করে লাভ কম দেখালেও বিপিসির লোপাটের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১২ রুপিতে অথচ আমাদের দেশে প্রতি লিটার ডিজেলের বর্তমান মূল্য ৬৫ টাকা। তারাও সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে আর আমাদের দেশে সে দেশগুলো থেকেই আমদানি করে। তারপরেও এমন বিস্তর বৈষম্য থাকার প্রশ্নগুলো সম্ভবত অমীমাংসিতই থাকবে।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল ব্যবহৃত হয়। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ায় স্থানীয় বাজারে এর দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ টাকা। তবে কিছুদিন পূর্বে আন্তর্জাতিক বাজারে সাথে সমন্বয়ের অংশ হিসেবে ফার্নেস অয়েলের দাম ১৮ টাকা হ্রাস করে ৪২ টাকা করা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম এখন ৩০ টাকারও কম। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বেশি পড়ছে। সরকার ফার্নেস তেলের দাম না কমিয়ে এই বাবদ কিছু মুনাফা করছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাম বেশি পড়ায় সেখানে ভর্তুক্তি দিচ্ছে। ফার্নেস তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের সমান্তরাল করা না হলে, এক হাতে মানুফা, অন্য হাতে ভর্তুকি দেওয়ার অহেতুক কর্মকা- শেষ হবে না। সরকার ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনলে বিদ্যুতের দামও কমানো যেত। যার ফলে, উপকৃত হত সাধারণ মানুষ। কেননা বিদ্যুৎশক্তিনির্ভর সকল যান্ত্রিক কলকারখানায় উৎপাদনের খরচ কমলে তার প্রভাব পড়ত পণ্য মূল্যের স্থিতিতে এবং পণ্য দ্রব্য থাকতো মানুষের ক্রয়ের নাগালে।
রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান। কাজেই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলো এমন হওয়া উচিতÑযার দ্বারা উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম বেশি ছিল তখন বিপিসিকে ঠিকই ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এখন যেহেতু সকল ভর্তুকি ও দেনা-পাওনা মিটিয়ে বিপিসি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তখন আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় রেখে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সেই পরিমাণ হ্রাস করা উচিত যাতে বিপিসি ক্ষতিতে না পড়ে এবং জনসাধারণের নাভিশ্বাসও না ওঠে। জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। কেননা এদেশের সকল উৎপাদন হয়তো জ্বালানি শক্তি নয়তো বিদ্যুৎ শক্তির সাথে সম্পর্কিত। সরকার শুধু পণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েই নীরব থাকতে পারে না বরং সেটা যথাযথভাবে কার্যকর হয়েছে কিনা সে দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রেখে গণমানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব।
য় লেখক : কলামিস্ট
ৎধলঁ৬৯ধষরাব@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।