Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪, ১ শ্রাবন ১৪৩১, ০৯ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

শ্রীলঙ্কায় বন্দুকযুদ্ধে ৬ শিশুসহ নিহত ২০

হামলাশঙ্কায় মার্কিনীদের সতর্কতা : আরো কয়েকটি শহরে কারফিউ সম্প্রসারণ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

শ্রীলঙ্কার পূর্বাঞ্চলে সন্দেহভাজন সশস্ত্র হামলাকারী দল এবং পুলিশ ও সেনাসদস্য নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ছয় শিশুসহ ১৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চার বন্দুকধারী ও একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। ইস্টার সানডের দিনে আত্মঘাতী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আটকে গত শুক্রবার রাতে এই অভিযান পরিচালনা করে দেশটির পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ড। গতকাল শনিবার সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ও সরকারি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে গার্ডিয়ান। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বাত্তিকালোয়ার আমপারা শহরের সেইন্টামারুথু নামক স্থানে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র ইসলামী চরমপন্থীদের মধ্যে এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। ইস্টার সানডের দিনে এখানেও আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে।
সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র সুমিত আতাপাত্তু জানিয়েছেন একটি বাড়িতে অভিযান শুরু করলে বন্দুকধারীরা সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে। তিনি বলেন, ‘পাল্টা প্রতিরোধের অংশ হিসেবে চালানো গুলিতে দুজন বন্দুকধারী নিহত হয়।’ বন্দুক হামলায় পড়ে একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানান তিনি। পরে পুলিশ জানায় নিহতদের মধ্যে অভিযুক্ত চারজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিহত হয়েছেন। ইস্টার সানডের সেই বোমা হামলার পর হামলাকারীদের খুঁজতেই সেনাবাহিনী ও দেশটির পুলিশ এই যৌথ অভিযান পরিচালনা করে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেশটির এক সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, শ্রীলঙ্কার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বাত্তিকোলার আমপারা শহরে পুলিশের চালানো ওই অভিযানের সময় একটি বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলের পাশেই আরও একটি অভিযানে চালায় তারা। সেই অভিযানে বেশ কিছু বিস্ফোরক ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের ব্যবহার করা পোশাক উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে বলেন, হামলার আশঙ্কা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। গত রোববারের সেই ভয়াবহ হামলার পর দেশজুড়ে ১০ হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা এবং ধর্মীয় স্থাপনায় নিরাপত্তার জন্যই অতিরিক্ত এই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার হামলার জন্য স্থানীয় ইসলামী চরমপন্থী দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতকে দায়ী করলেও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
এদিকে ইস্টার সানডে’তে বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজনদের খোঁজে তল্লাশি অভিযানের মধ্যে শুক্রবার বেশ কয়েকটি শহরে কারফিউ সম্প্রসারণ করেছে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী। দেশটির পুলিশ জানিয়েছে, পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় শহর কালমুনাই, চাভালাকাদে এবং সামাণথুরাইতে প্রতিদিন রাত আটটা ৪৫ মিনিট থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত কারফিউ কার্যকর থাকবে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব শহরে তল্লাশি অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলির পর কারফিউ-এর ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় হামলাশঙ্কায় মার্কিনীদের সতর্কতা
২১ এপ্রিলের ভয়াবহ সিরিজ বিস্ফোরণের পর শ্রীলঙ্কায় নতুন করে আরও হামলার আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার রাতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে দেশটিতে বিদ্যমান ভ্রমণ সতর্কতা আরও উন্নীত করে ‘উচ্চতর ভ্রমণ সতর্কতা’ জারি করা হয়েছে। এতে ‘সন্ত্রাসজনিত কারণে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ পুনর্বিবেচনার’ জন্য আমেরিকানদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের সব সরকারি চাকরিজীবীদের স্কুলে যাওয়ার বয়সী সন্তানদেরও দেশটি ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় খুবই জরুরি নয় এমন মার্কিন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও দেশে ফেরার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভ্রমণ সতর্কতায় বলা হয়, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো শ্রীলঙ্কায় সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে।’
শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের দিন গত ২১ এপ্রিল সঙ্ঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাকে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য হয়তো ঠেকাতে পারত। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য উপেক্ষা করায় বয়ে গেল রক্তবন্যা। গোয়েন্দা তথ্যের এই উপেক্ষার পেছনে দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার দ্ব›েদ্বর জের আংশিকভাবে হলেও দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
শ্রীলঙ্কার সরকারও স্বীকার করেছেন, হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা সতকর্তা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। বিশ্লেষকদের মত, দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক সঙ্কটকে এর জন্য দায়ী করা যায়।
ইস্টার সানডের দিন যে হামলা চালানো হলো, সে বিষয়ে সতর্কতায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। ১১ এপ্রিল একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান এক সতর্কতা জারি করে বলেন, স্থানীয় চরমপন্থী গোষ্ঠী ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত (এনটিজে) ‘গুরুত্বপূর্ণ গির্জাগুলোতে’ আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে। এই সতর্কতা নিয়ে সরকারের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা আলাপ-আলোচনা করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী কিছুই জানলেন না। শ্রীলঙ্কার কর্দমাক্ত রাজনৈতিক দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত এমন মানুষের কাছে এটি খুব সামান্যই বিস্ময়ের। এই মলিন রাজনৈতিক দৃশ্য প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে বিবাদে প্রভাবিত। প্র্রেসিডেন্ট পদ ছাড়াও শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা, আইন ও শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রীর পদে রয়েছেন সিরিসেনা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শ্রীলঙ্কাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যালান কিনান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চলমান লড়াইয়ের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট নানাভাবেই তাঁকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে একটি পুলিশ বাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা।’ কিনান আরও বলেন, ‘এটি খুবই স্বাভাবিক, প্রেসিডেন্টের সমর্থক নন, এমন মন্ত্রীদের সঙ্গে পুলিশ তথ্য বিনিময় করবে না।’
সরকারি কিছু সূত্র এএফপিকে বলেছে, দেশের সঙ্কটাপূর্ণ এ অবস্থায়ও প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি প্রেসিডেন্ট। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর জরুরি বৈঠক আহ্বানের পর প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তারা প্রেসিডেন্টের কাছেই শুধু জবাবদিহি করবেন।
কলম্বোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের প্রধান পাইকিয়াসোদি সারাভানামুত্তু বলেন, এই রাজনৈতিক দ্ব›েদ্বর অর্থ নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ বা সতর্কতা একটি অকার্যকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া। সারাভানামুত্তু প্রশ্ন করে বলেন, ‘এই দুজন (প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী) কী করছেন?’ তাদের অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের ব্যক্তিগত রেষারেষি নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের ওপর কালো ছায়া ফেলছে। নেতাদের দায়িত্ব জনগণকে সুরক্ষা দেয়া, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাদের ব্যর্থতার মূল্য সাধারণ মানুষ দিয়েছে নিজেদের জীবন দিয়ে। সূত্র : গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, রয়টার্স।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রীলঙ্কা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ