মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
হাসান আল মাহমুদ
নারায়ণগঞ্জের এক শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনাটি যদি আল্লাহকে নিয়ে এভাবে ‘তোদের আল্লাহ নাপাক, তোরাও নাপাক’ কটাক্ষ করা না হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে- ‘শেখ মুজিব নাপাক, তার দলের সবাই নাপাক’ এভাবে কটাক্ষ করা হতো কিংবা ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে ঠিক এইভাবেই বলত; আর এতে করে বঙ্গবন্ধু প্রেমীরা উত্তেজিত হয়ে স্কুল ঘেরাও করে শিক্ষকের বিচার দাবির স্লোগান দিত, না হলে তারাই তাকে শায়েস্ত করার হুমকি দিত, ফলে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান স্কুলে গিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে ও উত্তেজিত জনতার হাত থেকে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে বাঁচাতে তাকে তার ক্ষমার অযোগ্য শাস্তি থেকে সামান্য কান ধরে উঠবোস করিয়েই ছেড়ে দিত এবং উত্তেজিত জনতাও থেমে যেতÑআমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহলে এ ইস্যুটার জন্যে কোনো হলুদ মিডিয়ারও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হতো না এবং আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সকল তথাকথিত সুশীল পরিচয়ের মানুষগুলোর এতো বিরূপ প্রতিক্রিয়াতো দূরের কথা, বরং সেলিম ওসমানকে ক্ষমা চাইতে বলা, তার সংসদ সদস্য বাতিল করার দাবি করার পরিবর্তে তাকে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাপ্রেমীরা জাতীয় বীর খেতাবে ভূষিত করত।
অথবা বলা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ না করে বরং শুধু ছাত্রকে বেদম পেটানোর অভিযোগ কিংবা ইভটিজিং-ধর্ষণের মতো কোনো অভিযোগ এনে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে তাকে মারতে গেলে এবং স্থানীয় এমপি সেলিম সাহেব স্কুলে গিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য শিক্ষককে জনরোষ থেকে বাঁচাতে এরকম করত; তাহলেও ইস্যুটাকে নিয়ে হলুদ মিডিয়ার এতটা বাড়াবাড়ি কতে দেখা যেত না এবং ফেসবুকেও ‘স্যরি স্যার’ বিশিষ্ট ১৭ মে ‘জাতীয় কানধরা দিবসের’ উৎপত্তি ঘটত না। ইভটিজিং-ধর্ষণের বিষয়টি না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু ছাত্র পেটানোর বৈধতা আইনের কোন্ ধারায় রাখা আছে! সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রকে মারধর করার বৈধতা রাখাতো দূরে বরং পত্রিকার পাতায় এমন শিরোনামওতো পড়তে হয়েছে ‘ছাত্র নির্যাতনের অভিযোগে শিক্ষক বরখাস্ত’।
অত্যন্ত গর্বের বিষয় হলোÑএ দেশে সংখ্যাগুরু হিসেবে জন্ম না হয়ে সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মগ্রহণ করা। এ দেশে সংখ্যালঘুর অধিকার, সুবিধা, সুযোগ, ছাড়ের ব্যাপারে যতটা না গুরুত্ব দেয়া হয় তার সিকিভাগ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তাদের সংখ্যালঘুদের দেয়াতো দূরের কথা, বরং সে দেশে সংখ্যালঘুর খাদ্যের উপর বর্বর আক্রমণ চালানোর ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। শ্যামল কান্তি ভক্তকে মোটাদাগে দুটি কারণে হলুদ মিডিয়া ও বামপন্থীরা সমর্থন দিচ্ছে ও তার পক্ষ নিচ্ছে। এক. সে ইসলাম ধর্মকেই না হয় কটাক্ষ করেছে, এতে কী এমন অপরাধ সে করে ফেলেছে যে, যার জন্য স্থানীয় এমপি জনরোষ থেকে তাকে বাঁচাতে লঘু শাস্তি দিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করেছেন। দুই. সে একজন হিন্দু, এ দেশের সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু হিসেবে তার কোনো অপরাধ থাকতে পারে না। সে যাই ইচ্ছা করতে পারবে, চলতে পারবে, বলতে পারবে।
অনেকে বলবেন, দেশে আইন আছে। কিন্তু এমপি নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন কেন? প্রশ্নের উত্তর যদি এরকম আসে যে, এমপি খবর পেয়েও বাসায় নাক ডেকে ঘুমিয়ে রইলেন বা আসলেও শ্যামল কান্তির পক্ষ নিলেন এবং তাতে উপস্থিত উত্তেজিত জনতা যদি কিছু একটা করে ফেলত তাহলে আপনি কি প্রশ্নের অবতারণা করতেন?
সেলিম ওসমানের বড় পরিচয় তিনি আওয়ামী সংসদ সদস্য এমপি নন, তিনি একজন ঈমানদারের মতো আচরণ করেছেন। আর শ্যামল কান্তি ভক্তের বড় পরিচয় সে শুধু শিক্ষক নয়, হিন্দু নয়, সংখ্যালঘু নয় বরং সে একজন অপরাধী। আর দায়িত্বশীল কর্তৃক অপরাধীর শাস্তি হওয়াই কাম্য।
তৃতীয় আরেকটা কারণ যেটাকে বড় করে, হাইলাইট করে এমনকি এটাকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সেটা হলো, শ্যামল কান্তি ভক্ত হচ্ছেন একজন শিক্ষক। জাতি গড়ার কারিগর। অতএব তাকে কান ধরানো মানে পুরো জাতিকে কান ধরানো। যেন একজন শিক্ষক কান ধরে উঠবোস করে নাই পুরো দেশ কান ধরে উঠবোস করেছে! এই যদি হয় শিক্ষকের মর্যাদা, তাহলে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দিনের পর দিন প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার বিনিময়ে শেষমেষ পুলিশের কাঁদানো গ্যাস, লাঠিচার্জ উপহার পেল কেন! তাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হলো কেন! এদেরকে আক্রমণ করা, নির্যাতন করা মানে কি পুরো জাতির উপর আক্রমণ করা হয় না? গত বছর ঢাকায় আন্দোলন করতে আসা শিক্ষকদের উপর পুলিশি আক্রমণ ও গরম লাল পানি-পিপার স্প্রে ছিঁটানোর পর ময়মনসিংয়ের একজন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। রাস্তায় পড়ে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনে রক্তাক্ত হয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকায় এসে লাশ হয়ে ফিরে গেছেন জাতি গড়ার কারিগর এক মহান শিক্ষক। কই এখনকার কান ধরে উঠবোস করার লোকেরাতো একটিবারও বললো না ‘স্যরি স্যার’!
শ্যামল কান্তি একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। অথচ শুধু বাংলাদেশ নয়; প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহকে যখন রাস্তায় পিটিয়ে জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল তখন এই ‘কানধরা জাতি’ কই ছিল!
বেশিদূর যাব না, ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনার ফিরিস্তি দিতে গেলে এই লেখার পরিধি বড় হয়ে যাবে। সচেতন লোকমাত্রই জানেন সবকিছু। না হলে অনলাইনে সার্চ দেন। অবাক হয়ে যাবেন মাত্র এই তিন বছরে এত এত শিক্ষক নির্যাতন হলো, অপমান হলো, কান ধরে উঠবোস করা জাতিদের একটারেও দেখলাম না প্রতিবাদ করতে। শুধু তাই নয়, এই চলমান সময়ের সাথে তো ঢাকার ধামরাইয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বিদ্যালয়ের সহসভাপতি কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে অজ্ঞান পযন্ত হয়ে গেছেন। কানধরা জাতিদের কেউতো বলল না ‘স্যরি ম্যাডাম’! এভাবে শুধুমাত্র এই তিন বছরে মুসলিম-অমুসলিম বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা নির্যাতিত হয়েছেন। অপমানিত হয়েছেন। জাতি গড়ার মহান সেই কারিগরদের কাউকে নিয়ে নব্য গজিয়ে ওঠা এই ‘কানধরা জাতি’দের কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি।
সুতরাং শ্যামল কান্তিকে নিয়ে ন্যাকামি আন্দোলনে ‘কানধরা জাতির’ উত্থান এবং বামপন্থী, হলুদ মিডিয়ার অভিসন্ধিতে কি প্রতীয়মান হয়? শিক্ষকের মর্যাদা নাকি আল্লাহকে কটূক্তিকারীর মর্যাদা!
ষ লেখক : সমাজ গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।