বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
সরকারি পাটকল মানেই লোকসান। লোকসান খাত থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছে না সরকারি পাটকলগুলো। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর পাটকলগুলোতে ৪৬৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে সরকার। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেরুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সময়মতো দায়িত্ব পালন না করা, সময়মতো কাঁচাপাট কিনতে ব্যর্থ হওয়া, পাটের গুণগত মান ভালো না হওয়া, বেশি জনবল, সিবিএ’র দৌরাত্ম, পুরাতন যন্ত্রপাতি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ডুবেছে সরকারি পাটকলগুলো। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ খাতকে উৎসাহ দেওয়া হলেও লাভ তো দুরে থাক লোকসানের অঙ্কও কমানো যাচ্ছে না। এদিকে সরকারি পাটকলশ্রমিকেরা বকেয়া মজুরি, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বরখাস্ত শ্রমিকদের পুনর্বহাল, মৌসুমে পাট ক্রয়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দসহ ৯ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটে নামায় নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। গত ৫ বছরে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। তারপরও টাকার অভাবে সময়মতো পাট কেনা যাচ্ছে না।
গত ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাটশিল্প কীভাবে লাভজনক হবে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাট এমন একটি পণ্য, যার কিছুই ফেলনা নয়। অতএব কেন এতে লোকসান হবে? আমি কোনো লোকসানের কথা শুনতে চাই না।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ইনকিলাবকে বলেন, শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন, মিছিল মিটিং করেছে সেখানে বাধা দেওয়া হয়নি। এটি তাদের অধিকার। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করে। তারা ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। এটি বাস্তবায়নে সরকার বিজেএমসির দেনা পরিশোধ করতে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয়। এই অর্থ দিলে ভবিষ্যতে বিজেএমসির জন্য আর কোনো আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হবে নাএ শর্তে পাট মন্ত্রণালয়, বিজেএমসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরপর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া খুলনার খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাম কার্পেটস ফ্যাক্টরি ফিরিয়ে নিয়ে চালু করে সরকার। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। লোকসান হতেই থাকে। বেসরকারি খাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়া মিলগুলোও বড় লোকসান দিতে থাকে। ২০১৫ সালে পাট মন্ত্রণালয় বিজেএমসির জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাইলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চিঠি দিয়ে বলেছিলেন,আমার মনে হয়, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পুনরায় চালু করে মারাত্মক ভুল করেছে।
বন্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে ৩০৭টি পাটকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ২৬টি। বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। পাশাপাশি গতবছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। ওই সময়ে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তার ২৮ শতাংশও পূরণ হয়নি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কাঁচাপাটের রফতানি কমেছে ৬১ শতাংশ, পাটের সুতা ২৩ শতাংশ ও অন্যান্য পাটপণ্য ৫৪ শতাংশ। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে এ হার কিছুটা বেড়েছিল। বর্তমানে দেশে বেসরকারি খাতে পাটকলের সংখ্যা জুট স্পিনিং মিলসহ সব মিলিয়ে ২২২টি। সবগুলোই চলছে ভাল। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ শতাংশ রফতানি প্রণোদনা পেয়ে খুবই খুশি বেসরকারি পাটকল মালিকরা। কিন্তু সরকারি পাটকলগুলোতে তার কোন প্রতিফলন নেই।
গত ৯ বছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর লাভ-ক্ষতির পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল-এই ৯ বছর পাটকলগুলোতে লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৯১৪ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে সরকারি পাটকলগুলোতে লোকসান হয় ৩০৯ কোটি ৫৫ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০১০ সালে লোকসান ২৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৭ হাজার টাকা, ২০১২ সালে লোকসান ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৩ সালে লোকসান ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ ১২ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে লোকসান ৫১৩ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ২০১৫ সালে লোকসান ৭২৯ কোটি ১ লাখ ৬১ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে লোকসান ৬৫৬ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বিজেএমসির লোকসান হয় ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ২০১১ সালে বিজেএমসি লাভ করে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর আগে সর্বশেষ ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা মুনাফা করে পপ্রতিষ্ঠানটি। এরপর নানা প্রতিবন্ধকতায় মন্দার সাগরে ডুবে যায় পাটকলগুলো।
বিজেএমসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা হয় ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ১০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এরপর ৮০-৮১ অর্থবছরে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু ৮০দর দশকে সিনথেটিক পণ্যের ব্যবহার ঢুকে যাওয়ার পর পাট খাতে ধস শুরু হয়। সিনথেটিক পণ্য সস্তা হওয়ায় পাটজাত পণ্যের চাহিদা কমে যায়। ফলে ক্রমেই বাজার হারাতে শুরু করে এ শিল্প। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় সুদ বাড়তে থাকে। ফলে প্রতিবছর পুঞ্জীভূত লোকসানও বাড়তে থাকে। তবে বিশ্ব সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রাকৃতিক পণ্যের ওপর আবারো চাহিদা তৈরি হচ্ছে। ২০১০ সালে পণ্যে ও মোড়কীকরণে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে সংসদে মেন্ডেটারি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ পাস হয়। তবে তা এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হলেও বহির্বিশ্বে পাটজাত পণ্যের মোড়কীকরণ ও পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে। ফলে বিজিএমসির পণ্যের চাহিদাও তৈরি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষকও পাটচাষে আগ্রহী এবং বিপণন এরিয়াও বেড়ে গেছে। তাই আবারও লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে সরকারি পাটকলগুলোর।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হচ্ছে। কিন্তু দেশের চাহিদার মাত্র ২৪ শতাংশ পাটপণ্য সরকারি পাটকল পূরণ করতে পারে। চাহিদার বাকি ৭৬ শতাংশ পূরণ করে বেসরকারি পাটকলগুলো। ওসব পাটকল লাভের মুখ দেখলেও দীর্ঘদিন ধরে সরকারি পাটকলগুলো লোকসানে রয়েছে। টাকার অভাবে অনেক সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম বলেন, আর্থিক সংগতি না থাকাসহ কয়েকটি কারণে জাতীয় মজুরি স্কেল এত দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। আশা করছি,শ্রমিকেরা কাজে ফিরে যাবেন। অবশ্য নতুন কাঠামোতে শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে সোহরাব হোসেন বলেন, মজুরি না পেয়ে শ্রমিকেরা অমানবিক জীবনযাপন করছেন। অনেকেই অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শ্রমিকেরা বাধ্য হয়েই ধর্মঘটে নেমেছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি পাটকলের শ্রমিকদের দাবির একটি মানবিক দিক রয়েছে। সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনকভাবে চলছে। সরকারি পাটকল লাভজনক করতে হলে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আকার ও প্রযুক্তির যৌক্তিক পর্যায়ে এবং আধুনিকায়ন করতে হবে। তা হলে এ সমস্যা থাকবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।