Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুলশান লেক উন্নয়নে দুর্নীতির শঙ্কা

ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে, একনেকে যাচ্ছে না

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পের মতো গুলশান-বনানী-বারিধারার লেকগুলোও দৃষ্টিনন্দন করতে চায় সরকার। লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু না হতেই ইতোমধ্যে ৪১৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রাজউক। গত বছর ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পের কাজ শুরু না হতেই ৪১৪কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে নতুন প্রস্তাবও আটকে আছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে।
২০১৫ সালে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্টাডি রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্পের বিশাল এ আকার বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ অবস্থায় শুরুতেই জনমনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, রাজউকের প্রকল্পের ইতিহাস হচ্ছে, ধাপে ধাপে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি। এ সুযোগে অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসে। প্রকল্পের সেবা সুযোগ-সুবিধার চেয়ে অর্থ খরচ হয় অঢেল।
গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চার বছরেও শুরু না হওয়ায় তিনগুণ জমির মূল্য চেয়ে ভূমি সচিব ও ঢাকার ডিসিকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে জমির মালিকরা। একই সাথে এ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিতে জনগণের উপকারের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের পকেট ভারি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জমির মালিকরা মনে করেন, এখন ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হলেও দেখা যাবে ধাপে ধাপে তা বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানকে দায়ি করেছেন ভুক্তভোগিরা।
এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার ইনকিলাবকে বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারার লেকর প্রকল্পের সংশোধনের প্রস্তাব আমরা একনেকে পাঠাবো। এজন্য কাজ চলছে। তবে কবে একনেকে যাবে তা বলা যাবে না।
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিবকে বলেন, গুলশান লেক উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে আমি যুক্ত ছিলাম। পরে যখন দেখা গেল লেকের উন্নয়নে আরও কিছু সংস্কার করা দরকার। তখন প্রকল্প সংশোধনের চিন্তা করা হয়। তিনি বলেন, বুয়েট গুলশান-বনানী-বারিধারা লেককে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় অনওয়ে ট্রাফিক সিস্টেমের আওতায় আনতে পরামর্শ দিয়েছে। আর সে কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি মনে করি, গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় অনওয়ে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করা যৌক্তিক হবে না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাছের খান ইনকিলাবকে বলেন, গুলশান লেকের উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গুলশান লেকের উন্নয়নের নামে প্রকল্প ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু জমির মালিকরা তিনগুন টাকা পাচ্ছে না। এটা ঠিক নয়। রাজউকের উচিত ছিল ভালো-মন্দ বিবেচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করা।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে চায় রাজউক। এসব জমির প্রতি শতাংশের অধিগ্রহণ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। ল্যান্ড একুইজিশন কেস (এলএ) ১৬/১০/১১ এবং ল্যান্ড একুইজিশন কেস (এলএ) ১/১৬/১৭ এর আওতায় এসব জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাবেন দেড়গুণ। অথচ এ এলএ কেসের পরে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ তিনগুণ করা হয়েছে। আর অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে ৪৩ একর জমি বিটিসিএলের। ৩৭ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বাকিটা সরকারি জমি স্থানান্তরিত হবে। ওই জমির কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হবে না। সংশোধিত প্রকল্পে প্রস্তাবিত সময়কাল প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২২ সাল। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয় ২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এর আগে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সংশোধিত লেক উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে রাজউক।
জানা গেছে, গুলশান-বনানী-বারিধারা প্রকল্পে এ পর্যন্ত রাজউক ২৭০ কোটি টাকার লেক খনন ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় করেছে। অথচ গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান নয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়ক-ফুটপাত উন্নয়ন ও লেক খননের নামে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা যোগসাজশ করে সব নয়ছয় করছেন। খনন কাজ না করেও বিল উঠিয়ে নিচ্ছেন। এসব কাজের কোনো হিসাব রাখছে না সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা। গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক খনন, উন্নয়ন, সংস্কার, আধুনিকায়ন এবং অভিজাত এসব এলাকার যানজট নিরসনকল্পে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে রাজউক। আর এ প্রকল্পটি অভিজাত তিন এলাকার লেককে কেন্দ্র করে বাস্তবায়িত হবে। ২০১০ সালে ৪১৪ কোটি টাকার প্রকল্পে লেক খনন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় এর সঙ্গে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট যুক্ত করে যানজট নিরসনের প্রস্তাব করা হয়। এক্ষেত্রে লেকগুলো কার্যকর প্রবাহমান করতে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে গুলশান-বনানী ও বারিধারা লেকের ২২২ একর আয়তন বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ একর, যা হাতিরঝিল প্রকল্পের সমপরিমাণ হবে।
সময়মতো এ প্রকল্পের কাজ না হওয়ায় ময়লা পানি ড্রেনের মাধ্যেমে লেকের পানিতে পড়ছে। এতে করে লেকের পানি দূষিত হচ্ছে। গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের টেকসই দখলমুক্ত করতে ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে লেক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করে। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০১৯ করা হয়েছে। চলমান প্রকল্পের আকার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১৪ কোটি টাকা জমি অধিগ্রহণ ব্যয় রাখা হয়। দু’দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্প ব্যয় বাড়েনি জমি অধিগ্রহণের। শুরুতে লেক প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ছিল লেক দখল ও দূষণ মুক্ত করা, লেকের পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে নগরীর নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা, পরিবেশ উন্নয়ন ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, বুয়েটের স্টাডি রিপোর্টে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার যানজট নিরসন করতে অনওয়ে ট্রাফিক সিস্টেম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বনানী ১১ নম্বর সড়কে ছোট আকৃতির দুটি ফ্লাইওভার এবং শুটিং ক্লাব থেকে হাতিরঝিল- তেজগাঁও-নিকেতন তিন এলাকাকে সংযোগ করে আরও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় চারটি বোট (নৌ ঘাট) স্টেশন করা হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ও লেক প্রকল্পের কনসালট্যান্ট ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেকে প্রেরণ করেছিল রাজউক। সেখান থেকে বুয়েটকে দিয়ে সার্ভে করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর রাজউক বুয়েটের কাছে আসে। পরে আমরা পরিবহন, পরিবেশ, স্ট্রাকচারাল বিশেষজ্ঞরা মিলে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক প্রকল্পের সুপারিশ করেছি। একনেক থেকে হাতিরঝিলের আদলে প্রাধান্য দিয়ে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমাদের এ সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। এটা অনেক বড় উন্নয়ন হবে, যার সুবিধা পাবেন পুরো রাজধানীবাসী।
রাজউকের লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান সুমন ইনকিলাবকে বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের টেকসই দখলমুক্ত করতে চায় রাজউক। সে কারণেই রাজউক বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্টাডি করে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে এটি। লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিখুঁতভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের অর্থ লুটপাট হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজউক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ