বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
জালাল উদ্দিন ওমর
গত ৫ মে অনুষ্ঠিত লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেছেন এবং তিনি গত ৭ মে মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। সাদিক খানের এ বিজয় নিয়ে সারা বিশ্বজুড়েই আজ নানা আলোচনা এবং পর্যালোচনা চলছে। চলছে লেখালেখি এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ। আর এসবের পিছনে যথেষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডও রয়েছে। কারণ সাদিক খান একজন অভিবাসী, একজন মুসলিম এবং একজন অশ্বেতাঙ্গ। স্বাভাবিকভাবেই সাদিক খানের মতো একজন ব্যক্তি যিনি একাধারে অভিবাসী, মুসলিম এবং অশ্বেতাঙ্গ, তিনি যখন ইউরোপের সেরা, অভিজাত এবং ঐতিহ্যবাহী লন্ডন শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়, তখন তা আলোচনার বিষয়বস্তুতেই পরিণত হয়। সুতরাং কেন এবং কিভাবে সাদিক খানের পক্ষে লন্ডন জয় সম্ভব হলো, তা আমাদের সবারই জানা দরকার।
সাদিক খান পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। পিতা আমানুল্লাহ খান এবং মাতা মেহেরুন্নেচা খান। তারা লন্ডনে পাড়ি জমানোর পর ১৯৭০ সালে ৮ অক্টোবর সাদিক খানের জন্ম। পিতা ছিলেন বাস ড্রাইভার আর মা সংসারের খরচ মেটানোর জন্য সেলাইয়ের কাজ করতেন। দরিদ্র পরিবারের জন্য সরকার কর্তৃক নির্মিত লন্ডনের ছোট্ট কাউন্সিলর ফ্লাটে বসবাস করেছেন। সাদিক খান লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন এবং লন্ডনেই বেড়ে ওঠেন। তিনি লন্ডনে বেড়ে ওঠা অভিবাসী সমাজের প্রথম প্রজন্ম। তিনি আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং লেবার পার্টিতে যোগ দেন। বরাবরই নিজেকে লন্ডনের মূল ¯্রােতের একজন হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি স্থানীয় পরিষদের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন এবং বিজয় অর্জন করেন। ২০০৫ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয় এবং ২০০৮ সালে সরকারের কমিউনিটিবিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হয়। ২০০৯ পরিবহনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর ২০১৬ সালে এসে লন্ডনের মেয়র পদে নির্বাচন করেন এবং বিজয় অর্জন করে বর্তমানে লন্ডনের মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এভাবেই তিনি নিজেকে ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করেন। লন্ডনে মোট ৮৬ লাখ মানুষের বসবাস। তন্মধ্যে ১০ লাখ মুসলিম। মোট ৫৭ লাখ ৩৯ হাজার ভোটারের মধ্যে ৪৬% ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সাদিক খান মোট ১৩ লাখ ১০ হাজার ভোট পেয়েছেন আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক গোল্ডস্মিথ ৯ লাখ ৯৫ হাজার ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রাপ্ত ভোটের ৫৬.৮% সাদিক খান পেয়েছেন আর ৪৩.২% গোল্ডস্মিথ পেয়েছেন।
লন্ডন হচ্ছে সারা দুনিয়ার সেরা নগরী, যার পরিচিত বিশ^ব্যাপী। ইংল্যান্ডের রাজধানী হিসেবে লন্ডনের আলাদা একটি ইমেজ রয়েছে। ব্রিটিশরা একসময় সারা পৃথিবীব্যাপী সা¤্রাজ্য বিস্তার করেছিল। লন্ডনে বসেই ব্রিটিশরা সেই সা¤্রাজ্য পরিচালনা করত। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য এত বিশাল ছিল যে, তার বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হত- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। অর্থাৎ এই সা¤্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত একটি দেশে সূর্য অস্ত যেতে যেতে আরেকটি দেশে সূর্য উদয় হত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ একসময় ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের অধীন ছিল। আবার বর্তমান দুনিয়ার এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একসময় ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের অধীন ছিল। সময়ের পরিক্রমায় ব্রিটিশরা সেই সা¤্রাজ্য হারিয়ে ফেললেও, ব্রিটিশরা এখনো পৃথিবীর অন্যতম সেরা পরাশক্তি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে এখনো ব্রিটিশরা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর সেই ব্রিটিশদের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডন শহরের মেয়র পদে সাদিক খানের মতো একজন অভিবাসী যখন বিজয়ী হয়, তখন তা চমকে ওঠার মতো খবরই বটে। লন্ডন হচ্ছে বহু ধর্মের, বহু বর্ণের লোকদের বাসস্থান। বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষেরা এখানে এসেছে। ফলে লন্ডনে বসবাস করছে বহু সংস্কৃতির লোকজন, যাদের ধর্ম ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন এবং গায়ের রঙও ভিন্ন। এখানে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান এবং আফ্রিকান, খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের লোকজনের বসবাস। সাদিক খানের সফলতা এই যে, তিনি লন্ডনে বসবাসরত সকল ধর্মের এবং সকল বর্ণের মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন। তিনি নিজেকে পাকিস্তানি কিংবা মুসলিম সম্প্রদায়ের গ-িতে আবদ্ধ রাখেননি, বরং সবার মাঝে নিজেকে জেনারেলাইজ করেছেন। একইভাবে তিনি নিজেকে কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি না করে, সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি করেছেন। আর এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
সাদিক খান একজন অভিবাসীর সন্তান হিসেবে লন্ডনে বড় হয়েছেন। তাকে সবকিছুই নিজেকে অর্জন করতে হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে তার প্রাপ্তি কিছুই ছিল না। পারিবারিক পরিচিত এবং ঐতিহ্য ছিল না। এক কথায় অর্থ, বিত্ত এবং আভিজাত্য কিছুই ছিল না। অপরদিকে তার প্রতিপক্ষ কনজারভেটিভ প্রার্থীর জ্যাক গোল্ডস্মিথ হচ্ছে ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী এবং শীর্ষস্থানীয় ধনী পরিবারের সন্তান। তার বাবা গোল্ডস্মিথ লন্ডনের অনেক বড় ব্যবসায়ী এবং দেশজুড়ে রয়েছে পরিচিত। পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের সাবেক শ্বশুর। অর্থাৎ জ্যাক গোল্ডস্মিথ হচ্ছে ইমরান খানের সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের ভাই। এভাবে অর্থ, বিত্ত আর আভিজাত্যে শীর্ষে অবস্থান করা জ্যাক গোল্ডস্মিথকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। এখানে সাদিক খান অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। সাদিক খানের উদার মন-মানসিকতা, উন্নত রুচিবোধ এবং মার্জিত ব্যবহারের কল্যাণে তা সম্ভব হয়েছে। গোল্ডস্মিথ তার নির্বাচনী বক্তব্যে সাদিক খানকে বিশেষ ধর্মের এবং বিশেষ বর্ণের লোক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেও, সাদিক খান কখনো সে বিতর্কে জড়াননি। তিনি বরাবরই লন্ডনবাসীর মূল সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন এবং সেসব সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। তিনি সবসময় বিভেদকে এড়িয়ে গেছেন এবং ঐক্যের কথা বলেছেন। যার কারণে লন্ডনবাসী সাদিক খানের ধর্ম এবং বর্ণ পরিচয় বিবেচনায় আনেননি বরং তার ওপর আস্থা করেছেন। আসলে এটাই হচ্ছে সাদিক খানের সফলতার মূল চাবিকাঠি। কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশে এগিয়ে যেতে হয় এবং প্রতিকূলতাকে জয় করতে হয়, তা সাদিক খানের জীবন থেকে শেখার আছে।
আজ ২০১৬ সালের মাঝপথে এসে একজন অভিবাসী মুসলিম পরিবারের সন্তান লন্ডনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আর আজ থেকে আট বছর আগে পৃথিবীর সেরা পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেছিল; একজন অভিবাসী মুসলিম পরিবারের সন্তান। লন্ডনের মেয়র সাদিক খানের মতই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একজন অভিবাসী এবং তিনি ও সাদিক খানের মতই যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম। তিনিও সাদিক খানের মতই যুক্তরাষ্ট্রে সবকিছু অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে তারও অর্থ, বিত্ত এবং আভিজাত্য কিছুই ছিল না। অথচ ওবামা পরপর দুই বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তার আট বছরের শাসন শেষে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় ডোনাল্ড ট্রাম্প কাজ করেছেন। তিনি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বর্ণবাদী বক্তব্য রেখেছেন। সরাসরি মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। তিনি মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দিয়ে খ্রিস্টান সমাজের আনুকল্য পেতে চেষ্টা করছেন। ট্র্যাম্পের জানা উচিত, তার এই বর্ণবাদী বক্তব্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সমাজ তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। মনে রাখতে হবে মুসলিমরা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ এবং তারা সবচেয়ে বিকাশমান জনগোষ্ঠী। নাসার মত প্রতিষ্ঠানের অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানীও আজ মুসলিম। সুতরাং মুসলমানদের দূরে ঠেলে নয় বরং তাদেরকে সাথে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হবে। তার জন্য ট্রাম্পদের মত রাজনীতিবিদ যারা সমাজকে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রের ভিত্তিতে বিভক্ত করে ফায়দা লুটতে চায়, তাদের জানা উচিত এতে সমাজ এবং রাষ্ট্র কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হয়। তখন সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে শান্তি বিদায় নেয় এবং অশান্তি আসন লাভ করে।
যুুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ সারা পশ্চিমা বিশ^জুড়েই আজ ইসলামবিরোধী প্রচারণা চলছে। কিছু হলেই মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। মুসলমানদের নজরদারী করা হচ্ছে, তাদের সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি বলা হচ্ছে। হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করেছে পশ্চিমা বিশে^র অনেক দেশ। হিজাব পরিধানের অপরাধে মুসলিম ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল ছাত্র আহমদ বাড়িতে ঘড়ি বানিয়ে স্কুলে এনেছিল, অথচ তার কর্মকা-কে সন্ত্রাসী কর্মকা- অভিহিত করা হয়েছিল। একশ্রেণীর মানুষ ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পশ্চিমা বিশে^ মুসলমানরা কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রুমানা আহমদ হিজাব পরিধান করেই হোয়াইট হাউজে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। এতে রুমানার যেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না, ঠিক তেমনি হিজাব পরিধান করায় হোয়াইট হাউজেও কোন সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নাদিয়া জমির হোসাইন হিজাব পরিধান করেই বিবিসির জনপ্রিয় ‘দ্য গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন। গত ২১ এপ্রিল ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের ৯০তম জন্মদিনের কেকটি এই নাদিয়াই বানিয়েছেন। হিজাব পরিধান এক্ষেত্রে নাদিয়ার কর্মক্ষেত্রে কোনো সমস্যার কারণ হয়নি এবং ব্রিটিশ সমাজেও কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনি। একইভাবে লন্ডনের মেয়র পদে সাদিক খানের বিজয়ের কারণে ব্রিটিশ সমাজেরও কোন ক্ষতি হবে না। সুতরাং যারা কথায় কথায় মুসলমানদের সমালোচনা করেন, মুসলমানদের উত্থানে সমাজের সমস্যার কথা বলেন এবং হিজাবের বিপক্ষে কথা বলেন, তাদের উচিত এসব সংকীর্ণ এবং বর্ণবাদী চিন্তা পরিহার করে সমাজের মধ্যে ঐক্য এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। তাহলেই বিশ^ব্যাপী ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে এবং সবর্ত্রই শান্তি বিরাজ করবে। আর এটাই তো সবারই কাম্য।
য়
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।