পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ক’দিন আগেও তার নাম কেউ জানতো না। অর্ধকোটি লোকের দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম জানার প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু একটি সন্ত্রাসী ঘটনায় তিনি তামাম দুনিয়ার মানুষের চোখে ‘আলোর ঝলকানি’ হয়ে উঠলেন। হিংসাবিদ্বেষের এই বিশ্বে সন্ত্রাস নিমূর্লের নামে মুসলমানদের ধ্বংসের ইঙ্গ-মার্কিন অপকৌশলের মধ্যে তিনি বিশ্ব রাজনীতিতে হয়ে উঠলেন উদীয়মান সূর্য। বিশ্বের দেশে দেশে তাকে নিয়ে আলোচনা, শান্তিময় বিশ্ব গড়ার নতুন স্বপ্ন। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সব ধর্ম এবং আমীর-ফকির সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই তিনি হয়ে উঠলেন চোখেরমণি, হৃদয়ের রানী। যার কথা বলা হলো তিনি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্ন। নিউজিল্যান্ডের আল নূর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে তাকে নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। যদিও ওই হামলা ইঙ্গ-মার্কিন তথা পশ্চিমাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
পশ্চিমারা এতোদিন সন্ত্রাসের জন্য মুসলমানদের দায়ী এবং মুসলমানদের মৌলবাদী জঙ্গিবাদী হিসেবে প্রচার করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে বিশ্বের মুসলিম নয় শ্বেতাঙ্গ (সাদা) সন্ত্রাসীর সংখ্যাই বেশি। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে দেখা যায়, সে দেশে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার ৭১ ভাগের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গরা জড়িত। শ্বেতাঙ্গরা বন্দুক দিয়ে নির্বিচারে স্কুলের শিশু থেকে শুরু করে মসজিদের মুসল্লি এবং অফিস আদালতে কর্মরতদের হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউরোপেও প্রায় অভিন্ন চিত্র।
আগামীর বিশ্ব নেতৃত্বে তরুণদের কাছে যেন জাসিন্ডা আরডার্ন আইডল। ওই দেখো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। একটি পত্রিকার ছাপানো জাসিন্ডা আরডার্নের ছবিতে আঙ্গুল দিয়ে এক রিকশাওয়ালার আরেক রিকশাওয়ালাকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখার আগে বাসে ছিলাম। সেখানেও দেখলাম তরুণ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন বাসের ভাড়া দিতে। ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়লো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্নের ছবি। তরুণ জানালেন, তার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তির ছবি মানিব্যাগে রেখেছেন। ছোট্ট ঘটনা দু’টি কী বার্তা দেয়! সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বাংলাদেশের অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা, বেকার তরুণের এতো ভালোবাসা! শুধু ওই তরুণ ও রিকশাওয়ালাই নয়; গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জাসিন্ডা আরডার্নকে নিয়ে যে হৈহুল্লোর হচ্ছে তা নজীরবিহীন। ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে লাখ লাখ মন্তব্য, বক্তব্য লাইক দেয়া হয়েছে। ইরাকে মার্কিন আক্রমণের সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যেমন সাদ্দাম হোসেনের পক্ষে অবস্থান নেয়; নিউজিল্যান্ডের হত্যাকান্ডের পর জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্নের ভূমিকায় মানুষের মধ্যে যেন সেই ক্রেজ সৃষ্টি হয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ৩৮ বছর বয়সী জাসিন্ডা আরডার্ন যেন এদেশের মানুষের কাছে হয়ে গেছেন নেতৃত্বের ‘অইডল’। শুধু বাংলাদেশ নয়, মিডিয়ার বদৌলতে জানা যায় সারাবিশ্বেই প্রায় একই চিত্র।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্নের জন্ম ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে নিউজিল্যান্ডের ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হয়ে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। নিউজিল্যান্ডের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সভাপতি আরডার্ন ২০১৭ সালের ৮ মার্চ মাউন্ট অ্যালবার্ট ইলেক্টোরেটের সংসদ সদস্য। তিনি ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তালিকাভুক্ত সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথম হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের জন্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে আরডার্ন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী শ্বেতাঙ্গ ভয়ংকর সন্ত্রাসী ব্রেনটন টেরেন্ট। পৈশাচিক ওই হামলায় জুম্মার নামাজ পড়ার সময় অর্ধশত মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রাণ হারায়। বিশ্বের সন্ত্রাস দমনের স্বঘোষিত ব্যাপারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্বর ঘটনার পর নীরব। বিশ্বের সন্ত্রাস নির্মূলের ওই মোড়ল মুসলিম হত্যা ঘটনায় ঘটনার নিন্দা-প্রতিবাদ জানাননি। এমনকি দুঃখ প্রকাশ করেননি। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও নিন্দা-প্রতিবাদ কিছুই করেননি। অথচ ভারতের তিনজন ওই হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের ৩৮ বছর বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্ন যে ভূমিকা পালন করেন তা গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ভাষণেই শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বলেছেন মানবতার দুশমন ওই ঘাতকের প্রতি এতো ঘৃণা জন্মেছে যে ওর নাম আমি মুখেই নেব না। নিউজিল্যান্ডে যারা বসবাস করেন দেশি-বিদেশি সবাই সমান, সবার তিনি প্রধানমন্ত্রী।
সন্ত্রাসী হামলা ঘটনার পরের জুম্মাবারকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্যোগ নেন তিনি। জুম্মার নামাজের আগে আল-নূর মসজিদের পার্শ্ববর্তী খেলার মাঠ ‘হ্যাগলে পার্কে’ সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে ও মুসলিমদের প্রতি সংহতি জানাতে আয়োজন করেন স্মরণসভার। স্মরণসভায় প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন যোগ দেন মুসলিম পরিধান কালো স্কার্ফ পরে। তার সঙ্গে শত শত খ্রিষ্টান নারী স্কার্ফ পড়ে স্মরণ সভায় শরিক হন। এ সময় তিনি মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন, পুরো নিউজিল্যান্ড আপনাদের দুঃখে ব্যথিত। আপনাদের কষ্টে মর্মাহত। আমরা সবাই এক। আমরা হয়তো আপনাদের (স্বজন হারানো মুসলমান) দুঃখটা নিয়ে নিতে পারছি না। কিন্তু আমরা আপনাদের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গী হতে পারি। কোনো বিশ্ব নেতার মুখে বহুদিন এমন শান্তির বাণী শোনেনি বাংলাদেশ সব বিশ্বের মানুষ।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে হামলা চালিয়ে অর্ধশত মুসল্লির প্রাণহানিতে বিশ্বজুড়ে যে ঘৃণা, ভয়, ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তা এখনো বিদ্যামান। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আল আজহার মসজিদের প্রধান ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এবং বাংলাদেশসহ প্রভাবশালী বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা নিন্দা জানিয়েছেন। তারা সকলেই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন।
নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলায় অর্ধশত মুসলমানের প্রাণহানির ঘটনার পর দু’টি বিষয় বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট হয়েছে। এক. সন্ত্রাসী কারা? দুই. বিশ্ব নেতৃত্ব আগামীতে কাদের হাতে যাবে? প্রথমত, নিউজিল্যান্ডে হত্যাকান্ডের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিক্তিক সংস্থা ‘অ্যান্টি-ডিফেম্যাশন লীগ’ একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যতগুলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ৭১ ভাগ ঘটিয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা। আর মুসলিমরা জড়িত ২১ শতাংশ হামলার সঙ্গে। এতে বোঝা যায় ইহুদিবাদী মিডিয়াগুলো যে ইসলামফোবিয়া, মুসলিমবিদ্বেষ থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ প্রচার করছে তা সর্বত্তই মিথ্যা। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের মধ্যেও সন্ত্রাসী বীজ। বিশ্বে যে সন্ত্রাস হচ্ছে তার মূলে রয়েছে ওই পশ্চিমারাই। সে জন্যই ট্রাম্পের নীরবতা।
দ্বিতীয়, হলো বিশ্ব নেতৃত্ব। পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই নিজেদের মোড়ল ও বিশ্ব নেতা হিসেবে জাহির করতে চাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামসহ যে কোনো ধর্মবিদ্বেষী হয়ে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া যায় না। নেতা হলে বিশ্বের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সব মেরুতে বসবাসরত ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হয়। এক সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি হিসেবে বিশ্ব নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা বিশ্বকে দুই ধারায় বিভক্ত করেছিল। পুরো নেতৃত্ব পাননি। কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা সাম্রাজ্যবাজ বিরোধী নেতা ছিলেন। তারা কেউ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব কেউ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্ব নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখনো রিসেপ তায়েপ এরদোগান, শিং জিনপিংসহ অনেক নেতা রয়েছেন যারা নেতৃত্বগুণে আলো ছড়াচ্ছেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ৩৮ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা কেট লরেল আরডার্ন একটি ঘটনার পর সময়োপযোগী নেতৃত্বের কারণে গোটা বিশ্বের নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের হৃদয়ে যেভাবে গেঁথে বসেছেন, তাতে আগামীতে বিশ্ব নেতৃত্বের তার মতো ব্যক্তিদের যে মানুষ প্রত্যাশা করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।