Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ : জাতীয় গণহত্যা দিবস

রাত ৯টা ১ মিনিটে প্রতীকী ব্ল্যাক আউট

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ। এদিন রচিত হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম বর্বরতম অধ্যায়। মধ্যরাতের পূর্বমুহূর্তে ঢাকায় শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ড ও ধ্বংসের তান্ডব। অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নে পাশব নখর বিস্তার করে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সৈন্যরা। ঘুমন্ত মানুষের উপর নেমে আসে গজব। পাকিস্তানি সৈন্যরা সে রাতে বইয়ে দিয়েছিল রক্তের বন্যা। ঢাকা পরিণত হয়েছিল লাশের শহরে।
অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য মতে, শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। এছাড়া দিবসটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য কাজ করছে সরকার।
দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিনটির স্মরণে আজ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিটের জন্য জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ব্যতীত সারাদেশে প্রতীকী বø্যাকআউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাঙালি দমনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রণীত করেছিল নীল নকশা। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন ১৪ ডিভিশনের জিওসি মে. জে. খাদিম হোসেন রাজা ও ৫৭ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি।
১৬ মার্চ (অন্য তথ্যে ১৭ মার্চ) টিক্কা খান মে. জে. খাদিম ও মে. জে. ফরমানকে দমন অভিযানের পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করতে বলেন। এর নাম দেয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ের লেখক ও তৎকালিন পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের পিআরও মেজর সিদ্দিক সালিক বলেছেন, ১৮ মার্চ সকালে এই দু সেনা কর্মকর্তা মূল অপারেশনাল পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করতে জিওসির সদর দপ্তরে মিলিত হন। ২০ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মে. জেনারেল রাও ফরমান আলি, মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মে. জেনারেল আরুবকর ওসমান মিঠার সাথে গোপন বৈঠকে টিক্কা খান অপারেশন সার্চলাইট অনুমোদন করেন।
২১ মার্চ রাতে ঢাকায় অবস্থানরত ভুট্টো ও ইয়াহিয়া এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং গণহত্যার নীলনকশা (অপারেশন সার্চলাইট) চ‚ড়ান্ত করেন। ২৫ মার্চ সকাল ১১টার দিকে টিক্কা খান মে. জে. খাদিমকে ফোন করে রাতে অপারেশন করতে হবে বলে জানান। নির্ধারিত সময় ছিল ২৫ তারিখ দিনগত রাত ১টা অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। কিন্তু বাঙালিদের প্রতিরোধের খবরের প্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১১টায় সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে শুরু করে। এভাবে নির্ধারতি সময়ের দেড় ঘন্টা আগেই অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়।
এদিন দুপুর ১২টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান। এ খবর পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেন। সবার মধ্যেই পাকিস্তাানিদের সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে আশঙ্কা বিরাজ করছিল। রাত পর্যন্ত তাদের সাথে আলোচনা হয়।
এদিনই কিছু একটা ঘটতে পারে বলে সবার মধ্যে আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠে। তারা বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে সরে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করেন। কিন্তু সাহসী নেতা তাদের বলেন, ‘আমি জানি আজই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তবুও আমি এখানেই থাকব। কারণ, ওরা যদি আমাকে না পায়, তাহলে ঢাকা শহরকে ওরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে।’
এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্যে ইয়াহিয়া খান বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু সাথে সাথেই সে খবর বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে যায়। তবে ভুট্টো এ রাত্রি ঢাকাতেই হোটেলে ছিলেন। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে তিনি বাঙালির লাশের শহর ঢাকা ছেড়ে করাচি রওনা হন। বিমানে ওঠার আগে তিনি মন্তব্য করেন- শোকর খোদার, পাকিস্তান রক্ষা পেল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দলগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, লক্ষীবাজারে হামলা চালায়। এদিকে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন শুরুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তার সে ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য মেজর বেলালের নেতৃত্বে একটি কমান্ডো দল তার বাসভবনে পৌঁছে। তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রাতে আদমজি স্কুলে রাখা হয়। পরদিন নেয়া হয় ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে। তিনদিন পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের দমন অভিযানের বিরুদ্ধে বাঙালির তিন ধরনের স্বতস্ফ‚র্ত প্রতিরোধ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। একটি ছাত্র-যুবকদের, আরেকটি ইপিআরের ও অন্যটি পুলিশ বাহিনীর। পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশরা পাকিস্তানিদের উন্নত, ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ছিল বিক্ষিপ্ত ও অসম প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। কিন্তু এটাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বাঙালি সেনা বিদ্রোহ। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।
আগের দিন ২৪ মার্চ ঢাকার টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মচারীরা ধর্মঘট করছিলেন। কেউ কাজে যোগদান না করায় এদিন ঢাকায় টেলিভিশনের পর্দা ছিল অন্ধকার। তাই সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় টিভি খুলে দর্শকদের নিরাশ হতে হয়। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ জানান, এক সামরিক কর্মকর্তার দুর্ব্যবহারের ফলে টিভি স্টাফরা কাজে যোগদান করেননি।
এদিন ঢাকায় আসা পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের নেতারা ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা হলেন পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি খান ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মাওলানা মুফতী মাহমুদ, জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের মাওলানা শাহ আহমদ নূরানী, সর্দার শওকত হায়াত খান এবং জনাব গাউস বক্স বেজেঞ্জো।
ঢাকা অবস্থানকালে দেশের বর্তমান সঙ্কট ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এদিন ধানমন্ডিস্থ বাসভবনের সম্মুখে এক বিরাট গণসমাবেশে বক্তৃতাদানকালে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর কোনরূপ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যাবে না এবং আমরা তা কখনই সহ্য করব না।
তিনি বলেন, আমাদের দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত স্পষ্ট এবং তা অবশ্যই মানতে হবে। এদিন জনতার সাথে সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষের ফলে উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে রংপুরে পুনরায় কারফিউ জারি করা হয়। সৈন্যদের গুলিতে ৫০ জন নিহত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে জনতা ও শ্রমিকরা বাধা দেয়। সৈন্যরা নিজেরা ১২টি ট্রাকে অস্ত্র বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার পথে জনতা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে । সৈন্যরা গুলি চালালো ২০০ জন নিহত হয়।
দিনটির স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়াও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং সকল জেলা ও উপজেলায় ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করাসহ সারাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।



 

Show all comments
  • বেলী আফরোজ ২৫ মার্চ, ২০১৯, ৩:৩৯ এএম says : 0
    আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর। স্বাধিকারের আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত এক অভিযানে এই রাতে হত্যা করা হয় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। গণহত্যার তাণ্ডবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশলাইনসহ গোটা ঢাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাজিদ উদ্দিন ২৫ মার্চ, ২০১৯, ৩:৫১ এএম says : 0
    সকল শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা
    Total Reply(0) Reply
  • ম নাছিরউদ্দীন শাহ ২৫ মার্চ, ২০১৯, ৭:৫৫ পিএম says : 0
    অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজিত বাঙ্গালী মুক্তি সংগ্রামের লৌহ মানব। তৎ কালিন সাড়ে কোটি মানুষের ঠিকানি আপোষহীন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ড়াক এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম এবারের মুক্তির সংগ্রাম। কোটি জনতার স্বাধীনতা প্রিয় বাঙ্গালীর স্বাধীনতা চেতনা ধ্বংস করতে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পচিশে মার্চ ইতিহাসের ঘৃন্যতম গনহত্যা চালায়। সবুজ বাংলার মাঠি লাল রক্তের সাগরে পরিনত করেন টিক্কা খান রাও পরমান আলীর নরপিসাস হায়েনার দল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন স্বাধীনতা। দু লাখ মায়ের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা।এই স্বাধীনতার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অতন্দ্র প্রহরী হতে হবে সচেতন বিবেক মান সবাই কে। সবাই কে বঙ্গ বন্ধুর আদশ্য ধারন করে। মানবতাবাদী। দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতির লৌহ মানবী। বিশ্ব দরবারে শক্তিশালী নেতা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহনের মাঝেই স্বাধীনতার পকৃত সম্মান হবে। বঙ্গ বন্ধূর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্টটিত হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ