পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বিশেষ সংবাদদাতা : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি জ্ঞানতাপস, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুরকে ‘চেতনার বাতিঘর’ হিসেবে অবিহিত করেছেন দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি বলেছেন, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর দৈনিক ইনকিলাবের রত্নভান্ডার, দেশের রত্ন। তিনি আমাদের সবার গর্ব ও অহংকার। ছেলেবেলায় তিনি ’৫২ ভাষা আন্দোলন করেছেন; এখন ৯১ বছর বয়সেও দেশ-জাতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন কলমসৈনিক গুণীজন পেয়ে আমরা ধন্য, বাংলাদেশ ধন্য।
অধ্যাপক আবদুল গফুরের ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল বুধবার ইনকিলাব ভবনে আয়োজিত এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, আবদুল গফুরের মতো দেশবরেণ্য ব্যাক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমরা নিজেরাই সম্মানিত গৌরাম্বিত হচ্ছি। তবে রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য দুর্ভাগ্য যে, তার মতো এত বড়মাপের গুণীপন্ডিতকে আজও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এটা শাসকদের দৈন্যতা; জাতির জন্য সত্যি বড় দুর্ভাগ্য। তিনি বলেন, আবদুল গফুরের যাপিত জীবনের পরতে পরতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমরা সৌভাগ্যবান এখনো তার কাছে শিখছি; সানিধ্যে থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করছি।
প্রখ্যাত সাংবাদিক এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, আমাদের দেশে যোগ্য ব্যাক্তিদের পাশাপাশি অনেক অযোগ্য ব্যাক্তিকে স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদকে ভ‚ষিত করা হচ্ছে। অথচ ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর বর্তমান সময়ে সবদিক থেকে যোগ্যতম ব্যক্তি হওয়ার পরও তাকে যথাযথ সম্মান দিতে দেখছি না। আমরা চাই জাতি তাকে যথাযথ সম্মানে ভ‚ষিত করে জাতিকে সম্মানিত করবে। তিনি আরো বলেন, অধ্যাপক আবদুল গফুর সাংবাদিক হিসেবেও আমাদের রোল মডেল। মানুষ হিসেবেও অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। তিনি সৎ-আদর্শ এবং প্রকৃত অর্থে একটি ডিসিপ্লিন লাইফের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ৯১ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিত অফিস করেন, মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ৬ তলায় উঠেন। এটা তার কর্মে নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্যই সম্ভব হচ্ছে। তিনি জাতিকে দিয়েই যাচ্ছেন; কিন্তু জাতি তার জন্য তেমন কিছু করতে পেরেছে বা করার চেষ্টা করেছে বুঝতে পারছি না। অধ্যাপক গফুরের সংস্পর্শে, সহচার্যে আমরা আছি এটা আমাদের সৌভাগ্য। তিনি যতদিন চাইবেন ততদিনই ইনকিলাবে তথা আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা তার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অধ্যাপক আবদুল গফুর তার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় স্বভাবসুলভ বিনয়ীভাবে বলেন, আজ আমার সম্মানে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রিয় সম্পাদক যে আয়োজন করেছেন এ জন্য তাকে মোবারকবাদ জানাই। আমি সব সময় আমার বিশ্বাস, আমার বিবেকবোধ থেকে কাজ করেছি। জীবনে যা চেয়েছি তার সব কিছু যে করতে পেরেছি এমনটা নয়। সফলতার চেয়ে আমার অনেক ব্যর্থতাও আছে। আমার কাছ থেকে আপনারা যা প্রত্যাশা করেন তা হয়তো আমি দিতে পারি না। আমি অতি সাধারণ মানুষ। আমি এ জীবনে আল্লাহর অনেক রহমত পেয়েছি। এ জন্য আমি মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেন আল্লাহর পথে থেকে মৃত্যুবরণ করতে পারি। আর মৃত্যুর পরও যেন আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারি, তার কাছ থেকে পুরস্কৃত হতে পারি।
সহকারী সম্পাদক উবায়দুর রহমান খান নদভী বলেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম বাংলাদেশে আধুনিক মাদরাসা শিক্ষার রুপকার মরহুম আলহাজ মাওলানা এম.এ.মান্নান (রহ.) দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠালগ্নেই অধ্যাপক আবদুল গফুরকে নিয়ে আসেন। ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষণজন্মা মানুষটি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর হীরের টুকরো। তিনি ইনকিলাবে দ্যুতি ছড়াতে পারবেন। সে প্রমাণ অধ্যাপক গফুর লেখনির মাধ্যমে দিয়ে যাচ্ছেন।
এতে আরও বক্তব্য রাখেন ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক মুনশী আবদুল মান্নান, নিউজ কো-অর্ডিনেটর এ এস এম হাফিজুর রহমান, বিশেষ সংবাদদাতা স্টালিন সরকার ও মেহেদী হাসান পলাশ। অনুষ্ঠানে দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক আবদুল গফুরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন। পরে সহকারী সম্পাদক মুনশী আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সব শেষে অধ্যাপক আবদুল গফুরের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনায় মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার এ কে এম ফজলুর রহমান মুনশী।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুরের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি রাজবাড়ী জেলার দাদপুর গ্রামে। ভাষাসৈনিক এই গুণী মানুষটি কলেজে অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, প্রাবন্ধিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, ইসলামী ফাউন্ডেশনে চাকরিসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার শানিত লেখা পড়ে এখনো পাঠককুল আপ্লুত হয়ে পড়েন, দেশপ্রেমের প্রেরণা পায়। ইনকিলাবে তার লেখাগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। তিনি যেন ইনকিলাব পাঠকই শুধু নয়, ইতিহাস-ঐতিহাসিকদের জন্য জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি ১৯৪৫ সালে সমগ্র বাংলা ও আসামের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ফরিদপুর ময়েজ উদ্দীন হাই মাদ্রাসা থেকে (প্রবেশিকার সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে সরকারি নজরুল কলেজ) থেকে ঢাকা বোর্ডের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন।
ছাত্রজীবনেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ফাইনাল অনার্স পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে ভাষা আন্দোলনসহ তমদ্দুন মজলিসের কাজে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করায় আবদুল গফুর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন । ফলে দীর্ঘ ১১ বছর পর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সমাজকল্যাণে এমএ ডিগ্রি নিতে হয়। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি পাক্ষিক জিন্দেগী পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিস প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর সহকারী সম্পাদক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এতে তিনি সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করলেও সরকারের কোপানলে পড়েন। তিনি ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ফলে সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তিনি ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত ও ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সূচনা থেকে তিনি এই পত্রিকার ফিচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
তিনি ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভ‚ষিত হন। তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী উমর, কর্মবীর সোলায়মান, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, আসমান জমিনের মালিক, শাশ্বত নবী, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশ আমার।
তমদ্দুন মজলিসের দোয়া ও আলোচনা অনুষ্ঠান
ভাষাসৈনিক আবদুল গফুরের জন্মদিন উপলক্ষে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন তমদ্দুন মজলিস ১৯ ফেব্রুয়ারি দোয়া আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আলোচনা রাখেন। এ সময় তাকে ফুল দিয় শুভেচ্ছা জানায় বিভিন্ন সংগঠন। আলোচনায় বক্তারা বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিস প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ এর সহকারী সম্পাদক ও পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার নিজ বাসায় অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খান, সিনিয়র নেতা এরতাজ আলম, ইন্টারন্যাশনাল লিটারারী সোসাইটির সভাপতি, লেখক ও গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল লিটারারী সোসাইটির সেক্রেটারী ও মিডিয়া কর্মী জাহিদ আবেদীন, ন্যাশনাল ফর কালচার (সিএনসি) মো. আবদুল হান্নান, সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের লিটন হাফিজ চৌধুরী, মো. আবুল খায়ের, মিডিয়া কর্মী মো. জসিম উদ্দিন, আবদুল্লাহ আল মামুন, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, ভাইস চেয়ারম্যান ফারুক রহমান, সাংস্কৃতিক কর্মী মুহাম্মদ সুজন মাহমুদ প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।