Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

প্রশংসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর

নানামুখী চাপ সঙ্কটেও সফলভাবে দায়িত্ব পালন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আতিউর রহমান। ওই দিনই নতুন গভর্নর হিসেবে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানান সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন ফজলে কবির। দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনই ‘চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধার এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই প্রধান কাজ’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। শুরু থেকে নানামুখী চাপ ও সঙ্কট থাকলেও সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ফজলে কবির। গত ১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা দায়ের করেন। এর আগে এ ধরনের ঘটনা বিশ্বে কখনও ঘটেনি। অবশ্য বাংলাদেশ প্রথমে দ্বিপক্ষীয় ও কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু অর্থ ফেরতও আনেন। তবে বাকি অর্থ না আসায় অবশেষে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়।
বিষয়টি একটি সঠিক পদক্ষেপ বলে মনে করে সাধুবাধ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ এ মামলার মধ্য দিয়ে চুরি হওয়া অনুদ্ধারকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার পথ সুগম হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মামলা করায় চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়াসহ দোষীদের শাস্তি প্রদানের পথ প্রশস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল রূপালী ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বশীলতার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ফজলে কবির একজন আলোকিত মানুষ। তাকে আমি ভালোভাবে চিনি। তিনি ব্যাংকে আতঙ্ক তৈরির জন্য কোনো কাজ করেননি। একই সঙ্গে সফলভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চালিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানামুখী সঙ্কট ও চাপ থাকা স্বত্তেও সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন ফজলে কবির। যদিও এই পদ থেকে সরাতে থেমে নেই তার বিরুদ্ধে একটি চক্রের অপতৎপরতা।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত বইটিতে তিনটি ছবি ছাপা হয়েছে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপা হয়নি কোথাও। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওই অসাধু চক্রটি এর দায় চাপায় বর্তমান গর্ভনর ফজলে কবিরের উপর। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, এই গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রিজার্ভ চুরির দায়ে পদত্যাগ করা গভর্নর আতিউর রহমান। ২০১৩ সালের জুন মাসে ড. আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তখন উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা নামে দুটি কমিটি গঠন করেন তিনি।
তবে আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর ওই কমিটি দুটি পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশ করে। প্রকাশের পরপরই এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হওয়ায় গভর্নর ফজলে কবির এর বিতরণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে গ্রন্থটি পর্যালোচনার জন্য একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করেন। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকর বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির।
এই গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন আতিউর রহমানের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিংখাতে প্রভাব বিস্তার করা লোকজন। কয়েক দফা গ্রন্থটির সম্পাদক পরিবর্তনের পর সর্বশেষ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তার আগে সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন আরেক নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতে চাউর আছে শুভঙ্কর সাহা ও মাহফুজুর রহমান ছিলেন ড. আতিউর রহমানের একান্ত আস্থাভাজন। আর তারা ইচ্ছে করেই বর্তমান গভর্নরকে বিপাকে ফেলতে জাতির জনকের ছবি ছাপাননি গ্রন্থের কোথাও।
অথচ গ্রন্থ প্রকাশের পুরো বিষয়টিতে জড়িত ছিলেন সাবেক গভর্নরের আস্থাভাজনরা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনেকেই বলছেন, সাবেক কিছু কর্মকর্তা ইচ্ছে করেই গভর্নর ফজলে কবিরকে বিপাকে ফেলতে গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংযুক্ত করেননি। গত বছরের ২৫ মার্চ গ্রন্থটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পর এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে এর বিতরণ।
যদিও ইতোমধ্যে পর্যালোচনা কমিটি একাধিক সভা করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর অন্যতম হলো- গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবেশদ্বারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে তার ছবিসহ গ্রন্থটিতে জাতির জনকের অবদানের যে ধারাবাহিক বর্ণনা (পৃষ্ঠা ৫১, ৭৭ ইত্যাদি) রয়েছে, তার ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো সন্নিবেশ করা হবে সেখানে। গ্রন্থটির অ্যালবাম অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত বিভিন্ন টাকার নোটের ছবি সংযোজন করা হবে। এ ছাড়া গ্রন্থটির সব অধ্যায় পুনরায় সম্পাদিত হবে এবং বাদ দেওয়া হবে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ছবি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস গ্রন্থ পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি ও ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর ফজলে কবিরের নির্দেশনায় এর বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্রন্থে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে, তা দূর করে নতুন করে মুদ্রণের লক্ষ্যে কাজ চলছে।
বইটির প্রকাশনা প্রকল্পের উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. সনৎ কুমার সাহা, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী এবং সাবেক ডেপুটি গভর্নর মো. আবুল কাশেম. আবু হেনা মোহা. রাজি হাসান ও এসকে সুর চৌধুরীর নাম উল্লেখ রয়েছে। সম্পাদকমন্ডলী হিসেবে নাম রয়েছে শুভঙ্কর সাহা, ম. মাহাফুজুর রহমান, ড. আবুল কালাম আজাদ, নাসিরুজ্জামান, এফএম মোকাম্মেল হক, গোপাল চন্দ্র দাস, আনোয়ারুল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন, জোবায়দা আফরোজ ও ইন্দ্রানী হকের।
এদিকে সম্প্রতি রিজার্ভ চুরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করায় ওই চক্রটি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চক্রটি বিভিন্ন মহলে ফজলে কবিরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে মামলা লোক দেখানো, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হলো, শুধু শুধু অর্থ ব্যয়, অর্থ উদ্ধার সম্ভব না সহ নানা কথা বলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. বাকী খলীলী মামলা দায়েরকে ইতিবাচক অখ্যায়িত করেছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার অবসান হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, মামলার বিষয়টি ইতিবাচক। ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ যখন টাকা দিতে অস্বীকার করছে, তখন মামলা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিল না। একই সঙ্গে রায়টি বাংলাদেশের পক্ষে আসবে, এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমসের নিউইয়র্ক শাখায় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়ে যায়। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলংকার একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ফেরত আনতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে যায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে ফেরত এসেছে। উল্লেখ্য, মার্কিন আইন অনুযায়ী এ ধরনের কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে মামলা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর বাংলাদেশ যথাসময়ের মধ্যেই মামলা করেছে।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ ব্যাংক

২৫ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ