বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল হান্নান
শেষ পর্যন্ত নিজ ঘোষণায় অটল থাকছেন বলেই মনে হচ্ছে প্রধান বিচারপতি এসকে সিন্হা। গত ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক বাণীতে তিনি বলেছিলেন, অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক। এটা চলতে দেওয়া যায় না। এর পাঁচ দিন পর ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজারে আরেকটি অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি তার পূর্বের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন- একজন বিচারপতি যখন অবসরে যান তখন তিনি সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন। কারণ তিনি তখন আর শপথের মধ্যে থাকেন না। তার উপর কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও থাকে না। ফলে তিনি কোনো রায় দেওয়ার যোগ্য থাকেন না। বিচারপতি সিন্হা দৃঢ়তার সাথে বলেন, তার সময়ে এটা আর তিনি হতে দেবেন না। আদালতের নথি পাবলিক ডকুমেন্ট। অবসর প্রাপ্ত কাউকে তিনি তাতে হাত দিতে দিবেন না। প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্যে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শুরু হয় পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক। আমাদের দেশে একটি অঘোষিত রেওয়াজই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে তাদের ঘোষিত রায় লিখে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা তিন চার বছরও সময় নিয়ে থাকেন। এতে করে ঘোষিত রায়ের সুবিধাভোগী কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পক্ষই তাৎক্ষণিকভাবে আইনগত প্রতিকার লাভ থেকে বঞ্চিত হন। সরকার ছাড়া দেশের অন্য সকল মহল প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করেন। একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখবেন এটা কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। বরং আমাদের এবং ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা যাবে না। ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মত যে সিদ্ধান্তটা আছে (যেটা ১৬ ডি এল আর-এ উল্লেখ আছে) তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের দেওয়া রায় ঘড় লঁফমবসবহঃ হিসেবেই গণ্য হবে। ’৬৪ সালে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া এই সিদ্ধান্ত আজও পাল্টা কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ওভার রুল্ড বা পরিবর্তন হয়নি। ফলে ওই সিদ্ধান্ত মেনে চলা আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য সাংবিধানিকভাবেই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সংবিধান সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের ওপর আমাদের উচ্চ আদালতের মাননীয় সেই বিচারপতিরাই অবসরে যাওয়ার পর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সময় নিয়ে রায় লিখে সংবিধানের চেতনার বিরুদ্ধেই শুধু কাজ করছেন না- আমাদের বিচার বিভাগে এমন একটা খারাপ নজির স্থাপন করেছেন যা বিশ্বের কোথাও নেই।
বিচারপতিদের অবসরে গিয়ে রায় লেখার বিষয়টি বিচারাঙ্গনের সাথে জড়িত অল্প সংখ্যক মানুষেরই জানা ছিল। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এটা জানতেন না। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পরই কেবল বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। বলতে দ্বিধা নেই, এই বিষয়টি জানার পর সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আমাদের উচ্চ আদালত সম্পর্কে মানুষের চিরাচারিত যে উচ্চ ধারণা তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অতি সাধারণ একজন মানুষের মুখ থেকেও উচ্চারিত হয়Ñ এটা কী করে সম্ভব। অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি তো নিজ কর্মক্ষেত্রে থাকেন না বা থাকার সুযোগও নেই, তিনি রায় লিখবেন কী করে। এমনই একটি আলোচনা সমালোচনার মধ্যে দু’জন বিচারপতি যারা অবসরে গেছেন, অথচ বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাদের ঘোষিত রায় আজও লেখা শেষ করেননি এ রকম ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানির জন্য কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এই ১৬৮টি মামলার মধ্যে আপীল বিভাগ থেকে অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের রয়েছে ১৬১টি রায় এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের রয়েছে ৭টি রায়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ও প্রতিহিংসামূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এতে বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যাবে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক- প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন। প্রশ্ন উঠেছে যে, মামলাগুলো পুনঃশুনানিতে আনা হলো সেগুলোর রায় তো ঘোষিত হয়ে গেছে। পুনঃশুনানির পর যদি আগের ঘোষিত রায়ের হেরফের হয় তা হলে কী হবে। আগের ঘোষিত রায়ে যারা সুবিধা প্রাপ্ত হয়েছিলেন তারা এটা মেনে নিবেন কিনা। না নিলে তাদের আইনগত প্রতিকার কী। আইনগতভাবে এসব মামলার পুনঃশুনানির সুযোগ আছে কিনা। এসব প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়। আদালত হচ্ছে মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের পর মানুষের আর কোথাও আইনগত প্রতিকার চাওয়ার জায়গা থাকে না। কাজেই সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হতে হবে এমনÑ যাতে বিচার প্রার্থীরা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন। খেয়াল রাখতে হবে সর্বোচ্চ আদালতকে ঘিরে মানুষের মধ্যে যেন আস্থাহীনতার সৃষ্টি না হয়। আপাত দৃষ্টিতে প্রধান বিচারপতির পুনঃশুনানির এ সিদ্ধান্ত অবাস্তব, নজিরবিহীন এবং বেআইনী মনে হতে পারে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। অবসরে গিয়ে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয় তাহলে ঘোষিত রায় বাস্তবায়িত হতে না দেয়াটাও তো অসাংবিধানিক হতে বাধ্য এমন ধারণা অনেকেই করতে পারেন। যেমনটা অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন। কিন্তু বিষয়টি আদোতেও সেরকম নয়। অবসরে গিয়ে রায় লেখা অসাংবিধানিক বিধায় এবং ’৬৪ সালে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আছে তার আলোকেই বলা যায় যে ১৬৮টি মামলার রায় সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় লিখে যাননি এবং তাতে স্বাক্ষর করেননি। অবসরে এসে সেই রায়গুলো লিখে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেগুলোকে রায় হিসাবে গণ্য করার সুযোগ নেই। যেসব মামলার ঘোষিত রায় আইনগতভাবে রায় হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই সেসব মামলা পুনঃশুনানিতে কোনো বাঁধা থাকতে পারে না। এতে বিচার প্রার্থীদের সাময়িক অসুবিধা হওয়া ছাড়া বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এটাকে একটি ক্রান্তিকালীন অবস্থা হিসেবেই দেখতে হবে। ধরে নিই একজন বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে একটি সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর তিনি মারা গেলেন। পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে তাতে তিনি স্বাক্ষর করে যেতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবে ঘোষিত ওই রায় অকার্যকর হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে মামলাটি নতুন কোনো বেঞ্চে পুনঃশুনানি হওয়া এবং নতুনভাবে রায় ঘোষণা করা। এতে আগের ঘোষিত রায় পরিবর্তিতও হয়ে যেতে পারে। আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। আমাদের সুপ্রীম র্কোটের হাইর্কোট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো একটি মামলার রায়ে বেঞ্চের এক বিচারপতি এক ধরনের রায় দিলেন এবং অপর বিচারপতি তার বিপরীত রায় দিলেন। এমতাবস্থায় প্রধান বিচারপতি মামলাটি পুনঃ শুনানীর জন্য তৃতীয় কোনো বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেন। উভয় পক্ষকে শুনে তিনি নতুন করে রায় ঘোষণা করেন। এর ফলে আগের রায় বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়াও কোনো পক্ষের রিভিউ আবেদনের কারণেও কোনো আদালত তার পূর্বঘোষিত রায় পুনঃশুনানির মাধ্যমে পরিবর্তন, সংশোধন, এমন কী পুরোপুরি বাতিলও করতে পারেন।
কাজেই কোনো একটি মামলার একবার রায় ঘোষিত হয়ে গেলে ওই মামলা পুনঃশুনানি করে নতুন করে রায় দেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটা আইনেরই বিধান। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, প্রধান বিচারপতি যে ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তা কোনভাবেই বেআইনী নয়। এ সিদ্ধান্তকে প্রথমত বিভক্তি রায়ের ক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতির আলোকে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত রিভিউ এর আলোকেও দেখা যেতে পারে এবং তৃতীয়ত সর্বোচ্চ আদালত যে কোনো সময় ন্যায় বিচারের স্বার্থে তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের দুটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। এক. আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে একটি আদালত অবমাননার মামলায় সর্বোচ্চ আদলত ৬ মাসের জেল এবং দুই লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দেন। কিন্তু আদালত অবমাননা আইনে এত বড় ধরনের শাস্তির বিধান ছিল না। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন বলে রায়ে উল্লেখ করেন। একইভাবে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালত তথা আপীল বিভাগ থেকে আপীলের রায় হয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে রিভিউ করার কোনো বিধান সংশ্লিষ্ট আইনে ছিল না। কিন্তু কাদের মোল্যার রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত সর্বোচ্চ আদালত তার সহজাত ক্ষমতা বলে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায়ও সকল পক্ষকে রিভিউ করার সুযোগ করে দেন। কাজেই সংক্ষিপ্তভাবে ঘোষিত অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা না করে অবসরে যাওয়া দুই বিচারপতির ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানিতে পাঠানোকে প্রধান বিচারপতি তথা সর্বোচ্চ আদালতের সহজাত ক্ষমতা হিসেবেও দেখতে হবে। এসব মামলার রায় যাদের পক্ষে গিয়েছিল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় ঘোষিত রায় তাদের পক্ষে গেলেও আজ পর্যন্ত তারা তার সুফল ভোগ করতে পারেননি পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষিত না হওয়ায় ঘোষিত রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি না পাওয়ার কারণে।
তার পরেও বলব, এ অবস্থার দায় সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদেরই নিতে হবে। তারা আইনের রক্ষক হয়ে আইন ভঙ করেছেন। এর ফলে বিপদে পড়ে গেছেন বিচার প্রার্থীরা। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অনিয়ম দূর করতে প্রধান বিচারপতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। কারণ বড় ধরনের কোনো অনিয়ম দূর করতে অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা হয়ত সবার পছন্দ নাও হতে পারে।
এখন প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের সবচাইতে বড় প্রত্যাশা তিনি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়টি বাতিল করে আপীল মামলাটি পুনঃ শুনানির ব্যবস্থা করবেন। যে কারণে প্রধান বিচারপতি ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই একই কারণ এই মামলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত মামলা পুনঃ শুনানি হওয়ার ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ রয়েছে যা বিবেচনায় নেওয়া আরো অনেক বেশি জরুরি। যে ১৬৮টি মামলা পুনঃ শুনানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার সাথে হাতেগোনা দু’একটি ছাড়া জাতীয় স্বার্থ তেমনভাবে জড়িত নেই। কিন্তু নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মামলার সাথে জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কজনক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি। একই ধারায় পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা, পৌরসভা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি সকল মহল থেকেই স্বীকৃত বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে গণতন্ত্র। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কর্তৃত্ববাদী শাসন। জবাব দিহিতার বালাই নেই কোথাও। জনগণের বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ। বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এমন এক রাজনীতিহীন সংস্কৃতিতে যেখানে প্রতিবাদের সব ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে মামলা, হামলা, গুম, খুনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের একজন মানুষও এখন আর বিশ্বাস করে না নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ আছে। গণতন্ত্র ও রাজনীতিহীন এই অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি। তারা বাংলাদেশেকে গ্রাস করার সব পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। একথা বলা মোটেও অন্যায় হবে না যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলেই দেশে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না থাকার কারণেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দাবার গুটিতে পরিণত হতে দেওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে সুযোগ হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত আপীল মামলাটির পুনঃ শুনানির। দেশের সবচাইতে জনগুরুত্ব সম্পন্ন এই মামলাটির রায়ও লিখেছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি। তিনি অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়টি লিখে তা প্রকাশ করেন। ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল চেয়ে করা আপীল মামলায় সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। রায়টি সর্বসম্মত ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রায়টি দেওয়া হয়। রায় প্রদানকারী সাত জন বিচারপতির মধ্যে চার জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে, এক জন বিষয়টি সংসদের উপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে এবং দুই জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বাতিলের পক্ষে যারা রায় দেন (তাদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতিও ছিলেন) তাদের পক্ষে রায় লেখার দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেওয়া হলেও সংক্ষিপ্ত ওই রায়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুপারিশও করা হয়। যেটা ছিল রায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত একটি দিক। সংক্ষিপ্ত ওই রায় ঘোষণার সাত দিনের মাথায় অবসরে চলে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। অতঃপর তিনি ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে তাতে নিজে স্বাক্ষর করেন এবং অন্যান্য বিচারপতিদের স্বাক্ষর নিয়ে তা প্রকাশ করেন। অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি সংক্ষিপ্ত রায়ের মূল চেতনা পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে বাতিল হওয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সুপারিশ করা হয়েছিল তা থেকে সরে এসে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি নতুন আঙ্গিকের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সুপারিশ করেন। নির্দলীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সুপারিশ করেন। তার এই নতুন সুপারিশ ছিল মূলত তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার জন্যইÑতা বলাই বাহুল্য। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায় থেকে এভাবে তার সরে আসাটা ছিল বেআইনী তো বটেই, চরম অনৈতিকও।
সবশেষে বলব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত রায়টি এমনিতেই অবৈধ হয়ে গেছে। প্রধান বিচারপতি যে কথাটা বলেছেন অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক এটা যদি আমরা সঠিক ধরে নিই (বাস্তবে এটাই সঠিক) তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায় একটু দেখি। আগেই বলেছি ৭ জন বিচারপতির মধ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সহ চার জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাদের পক্ষে রায়টি লিখেন বিচারপতি খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে তার লেখা রায়টি সঙ্গত কারণেই অসাংবিধানিক হয়ে যাওয়ায় তা বাতিল হিসাবে গণ্য হবে। তার মানে এই অংশটুকুকে আর রায় হিসেবে গণ্য করা যাবে না আইনগতভাবেই। বাকি যে তিন জন ভিন্নমত পোষণ করে রায় দিয়েছিলেন তাদের রায় বহাল আছে। এই তিন জনের মধ্যে একজন বিষয়টি সংসদের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর অবশিষ্ট দুই জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তাহলে চূড়ান্তভাবে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে এ রকমÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ আদালতের আপীল মামলায় যে তিনজন বিচারপতির রায় আইনগতভাবে বহাল আছে তার মধ্যে দুই জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেওয়ায় তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন। অতএব, একথা আমরা বলতেই পারি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনো বহাল আছে। এমতাবস্থায় জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতি মামলাটি পুনঃ শুনানিতে পাঠাবেন নাকি বিদ্যমান রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল আছে সেই ঘোষণা দিবেন সেটাই দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। দেশ যে কঠিন সময় পার করছে এবং নির্বাচন প্রশ্নে দেশের দুই প্রধান শক্তি যেভাবে মুখোমুখি অনড় অবস্থান নিয়ে প্রেসটিজ ইস্যুতে চলে গেছেÑ এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির একটি সাহসী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বিদ্যমান অচলাবস্থা ভেঙে দিয়ে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সৃষ্ট সংকট সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে নিরসন হলে বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোরও এ নিয়ে আপত্তি করার কিছু থাকবে না।
য় লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ফরিদপুর
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।