Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কি সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল

প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এনায়েত আলী বিশ্বাস
সম্প্রতি দেশে গুপ্তহত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরোও বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে সন্ত্রাস দমন এবং উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব নিশা দেশাই বিসওয়াল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে সন্ত্রাস এবং উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইয়ে বিশেষজ্ঞ এবং কারিগরি সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি এই গুপ্তহত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। বিসওয়াল কমিউনিটি পুলিশকে শক্তিশালী করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সদস্যদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, তার সরকার সবসময়ই সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠ। তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধীই, সন্তাসী-সন্ত্রাসীই, তাদের কোনো ধর্ম নেই।
সাম্প্রতিক হত্যাকা- সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ করে ইউএসএআইডি স্টাফ জুলহাজ মান্নান, মসজিদের ইমাম মন্দিরের পুরোহিত এবং গির্জার পাদ্রী এরা সবাই সফট টার্গেট। এসব অমানবিক হত্যাকা-গুলো ঠা-া মাথায় খুন। এসব হত্যাকা-ই ঘটানো হয়েছে বিষয়টিকে আরোও উসকে দেওয়ার জন্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিবকে সন্ত্রাস বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং তথ্য সরবরাহেরও অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুম-হত্যা হয়ে থাকে। কিন্তু এবারের গুপ্তহত্যার নতুন করে মাত্রা যোগ হয়েছে। হঠাৎ করে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। এবার মধ্যবর্তী নির্বাচন বা গণতন্ত্রের জন্য চাপ নয়। বাংলাদেশে আইএস রয়েছে তা স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য এ চাপ। এ চাপ সৃষ্টির জন্যে জঙ্গি সংগঠন যারাই এ কাজ করুক না কেন, তারা আইএসের নাম ভাঙাচ্ছেন। এটা পশ্চিমা বিশ্বের কারসাজিও হতে পারে।
কারণ বাংলাদেশে আইএস রয়েছে এই অজুহাতে সাহায্যের নাম করে পশ্চিমারা অনুপ্রবেশের সুযোগ খুঁজতে পারেন বলে অনেকে মনে করেন। তবে বাংলাদেশে আইএস এর অবস্থান নিয়ে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরই এ দাবি নাকোচ করে আসছেন। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলও বিষয়টির প্রতি অনড়। এটি পশ্চিমা নয়া কৌশল বলেও মনে করেন ক্ষমতাসীনরা। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, সরকারকে চাপে ফেলতে এই মুহূর্তে বিভিন্ন কৌশল খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে এটি আগে স্ট্যাবলিস্ট করতে চায় পশ্চিমারা। এই ইস্যুতে বাংলাদেশে এসে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। কৌশলের অংশ হিসেবে আরো আছে সরকারের দুর্বলতা চিহ্নিত করা। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দাবি, সম্প্রতি কলাবাগানে জোড়া খুনের ইস্যুটাকে সামনে এনে পশ্চিমা দেশগুলো নতুন করে আবারও সরব হয়ে উঠেছে। ইউএসআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয় খুনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও ফোন করেন এবং তিনিও আইএস প্রসঙ্গে কথা বলেন। এরপরই দক্ষিণ, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বাংলাদেশ সফর করেন।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা অনেক দেশ বিভিন্ন কৌশলে সরকারকে চাপে ফেলার প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছে। তাই পশ্চিমা দেশগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা রয়েছে তা খুঁজতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম বলেন, বাংলাদেশে আইএস আছে এটি প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কয়েকটি দেশ। কোনো ঘটনা ঘটলেই আইএসের অস্তিত্ব খোঁজা শুরু করে পশ্চিমারা। তিনি বলেন, পশ্চিমা শক্তির ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত আছে। নীতিনির্ধারকরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশকে চাপে ফেলার আগের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে দেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের চাপ ব্যর্থ হয়। এই নির্বাচন আদায় করতে গত দুই বছর সরকারকে বিভিন্নভাবে পশ্চিমা দেশগুলো চাপ দিয়ে এলেও ক্ষমতাসীনরা তা আমলে না নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা এখন সরাসরি মধ্যবর্তী নির্বাচন বা গণতন্ত্রের প্রশ্নে সরকারকে আর চাপ দিতে চান না। তাদের কৌশল সরকারের দুর্বলতা বের করে সেগুলো নিয়ে কীভাবে সরকারকে চাপে ফেলা যায়।
তাদের গৃহীত কৌশলের অংশ হিসেবেই সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইস্যুটি নিয়ে প্রথম চাপে ফেলার চেষ্টা করে যুক্তরাজ্য। এ নিয়ে তুলকালাম কা- শুরু করে দেয়। সরকার তাদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ায় বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পোশাক খাতের প্রতি তীক্ষè নজর রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ খাতে দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করছে। জিএসপি সুবিধা বন্ধ করা তাদের ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এ সংক্রান্ত তাদের দাবি অনেকটা পূরণ হলেও অজানা কারণে জিএসপি সুবিধা এখনো বন্ধ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে একটা শক্তিশালী দেশ। তারা তাদের আধিপত্য বিস্তার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সবকিছু করতে পারে এবং করেও এসেছে ইতোমধ্যে। সম্প্রতি কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের আল মোবারক আল হামাদ আল সাবাহ তিন দিনের সফরে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বীপক্ষীয় এক বৈঠকে বাংলাদেশ ও কুয়েতে সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আখ্যায়িত করে একযোগে কাজ করার বিষয়ে একমতে পৌঁছেছেন। এ ছাড়া তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে সন্ত্রাস রোধে কার্যকর ভূমিকার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে সংস্থাটির নেতৃবৃন্দ।
গত তিন বছরে বাংলাদেশে উগ্রপন্থীরা ৩৮ বার হামলা করেছে। এসব হামলায় ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় ১৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হামলার মামলায় মোট ৪৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। হামলার ঘটনায় দায়ের করা ৩৮টি মামলার মধ্যে মাত্র ১টির বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৬টি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। আরও ৩২টি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। জঙ্গি হামলাগুলোর মধ্যে ২৫টি হামলা করেছে জিএমবি সদস্যরা। এ ছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ৮টি হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আর ৪টি ঘটনা ঘটিয়েছে অন্যান্য গোষ্ঠী। এসব ঘটনা ২০১৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মে পর্যন্ত সময়ে ঘটেছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলার বিচারে দুজনের মৃত্যুদ- ও ৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। তিন বছরে হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে একমাত্র এই মামলাটির বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অন্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর উত্তরায় আসিফ-মহিউদ্দিনের ওপর হামলা, টিএসসির কাছে ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা, আশুলিয়ায় কমার্স ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতি, তেজগাঁও শিল্প অঞ্চলে ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা, সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যা, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ব্লগার নিলান্দ্রি চ্যাটার্জি হত্যা, চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় ফকির রহমত উল্লাহ ওরফে লেংটা ফকির খাদেম হত্যা, চট্টগ্রামে সদরঘাটে শাহ করপোরেশনে ডাকাতি ও নিরাপত্তা কর্মী হত্যা, রাজধানীর গুলশানে ইটালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও হত্যা, ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারের ওপর হামলা, রাজধানীর বাড্ডায় প্রকৌশলী খিজির খান হত্যা, মিরপুরে এএসআই ইব্রাহিম হত্যা, পুরান ঢাকায় হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা, শাহবাগে আরেফিন দীপন হত্যা, মোহাম্মদপুরে শুদ্ধশ্বর প্রকাশনীতে হামলা, আশুলিয়ায় পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হত্যা, রংপুরে বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনের ওপর হত্যা, রংপুরের কাউনিয়া এলাকায় খাদেম রহমতউল্লাহ হত্যা, সৈয়দপুর মাজারের খাদেমের ওপর হামলা, দিনাজপুরের ইটালিয়ান ডাক্তার পিয়েরো পারোনরিকের ওপর হামলা, ফরিদপুরে অলোক সেনের ওপর হামলা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা, দিনাজপুরের কাহারোল ইস্কন মন্দিরে বোমা হামলা, দিনাজপুরের দিপ্তি ফিলিং স্টেশনে হামলা, রাজশাহীর বাগমারার আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত মসজিদে হামলা, দিনাজপুরে ঐতিহাসিক কান্তজিউ রাম মেলায় বোমা হামলা, ঝিনাইদহে ডাক্তার সমীর উদ্দীন ম-ল হত্যা, গাইবান্ধায় ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত হত্যা, পঞ্চগড়ে মঠ প্রধান হত্যা, ঝিনাইগহে আব্দুর রাজ্জাক হত্যা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হোসেন আলী সরকারকে কুপিয়ে হত্যা, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানার ব্লগার নাজিম উদ্দিন ছামাদ হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যা, রাজধানীর কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু খন্দকার মাহাবুব রাব্বি তনয় হত্যা এবং টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র হত্যা ও রাজশাহীর তানোর উপজেলার পীর শহীদুল্লাহ হত্যা।
এতগুলো হামলা ও হত্যার পিছনে মোটিভ বুঝতে কারো বেগ পাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এসব হত্যাকা- নিয়ে পশ্চিমাদের বাড়াবাড়িও সন্দেহজনক। তাই সরকারকে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে অবশ্যই সকল দিক ভেবেচিন্তেই নিতে হবে।
য় লেখক : অধ্যাপক ও সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কি সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ