Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নারিন্দা শিশু পার্কের জায়গায় লায়ন্স ক্লাব

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

রাজধানীর পুরনো ঢাকার নারিন্দা শিশু পার্কটি এখন অস্তিত্বহীন। পার্কের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নারিন্দা জুনিয়র লায়ন্স ক্লাবের তিন তলা ভবন। এই শহরের সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ ঐতিহাসিক বিনদ বিবির মসজিদের পাশেই ৩৩ শতাংশ জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছিল এই পার্কটি। পার্কেটির পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বেশ কিছু বহুতল ভবন উঠেছে। পূর্বে বিনদ বিবির মসজিদ, আরকান আলী (র.) ও বিনদ বিবির মাজার শরিফ। ৮৬৬ হিজরীতে এই স্থাপত্যগুলো গড়ে তোলা হয়। মসজিদ, মাজার ও পার্ক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহসিক কালের স্বাক্ষী হয়ে। যদিও বর্তমান পার্কটি অস্তিত্বহীন। এতো সুন্দর পরিবেশ পুরানো ঢাকায় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মেলবন্ধনে গড়ে উঠা নারিন্দা রোডের সেই মায়াবী দৃশ্য দখলদারদের কবলে পড়ে পাল্টে গেছে বহু আগেই। রোডের পাশে ঐতিহাসিক মসজিদ-মাজার থাকলেও এলাকাবাসীর শরীর চর্চা ও বিনোদন আর ছোট্টো সোনামনিদের খেলাধুলা জন্য পার্কটি আর নেই। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে নারিন্দা পার্কের দৃশ্য। পার্কের জায়গা দখল করে নির্মাণ হয়েছে তিন তলা ভবন। এই ভবনে গড়ে উঠেছে নারিন্দা জুনিয়র লায়ন্স ক্লাব। এতে শৈশবের আনন্দ হারিয়ে ফেলেছে নারিন্দা রোডের ছোট্টো শিশুরা। বহুদিন ধরে দখল হয়ে যাওয়া পার্কটির জায়গা ফিরে পাওয়ার দাবি জানিয়ে যাচ্ছে এলাকাবাসী।
নারিন্দা শিশু পার্কটি উদ্ধারের কোন উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের জায়গা অবৈধ দখলে রাখার অধিকার কারো নেই। ইতোমধ্যে আমরা খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছি, ডিএসসিসি’র কোন কোন খেলার মাঠ-পার্ক অবৈধ দখল বা দুষণে আছে। অবৈধ দখলে থাকা মাঠ ও পার্কগুলো আমরা দখল মুক্ত করবো। তিনি বলেন, বিশেষ করে নারিন্দা শিশু পার্কটি নিয়ে আমি মেয়র মোহদয়ের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নিব। তিনি বলেন, দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন পার্ক ও খেলার মাঠের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্পের আওতায় একটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে বলে আমি জানি। এই প্রকল্পের আওতায় ২২টি পার্ক ও চারটি খেলার মাঠ সংস্কার করে অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। একে একে ঢাকার সব মাঠ-পার্কেই এই প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হবে বলেও আমি জেনেছি।
সরেজমিন দেখা যায়, নারিন্দা শিশু পার্কের জায়গায় তিন তলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের মূল ফটকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে ক্লাবের সাইবোর্ড। বোঝার কোনো উপায় নেই ‘নারিন্দা জুনিয়ার লায়ন্স ক্লাবে’র জায়গাটিতে এক সময় শিশু পার্ক ছিল। ১৯৬১ সালে ৩৩ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে উঠে নারিন্দা পার্ক। কালের পরিক্রমায় নব্বইয়ের দশকের দিকে পার্কের জায়গায় গড়ে তোলা হয় দুই তলা ভবন। ক্রমশে দুই তলা ভবন তিন তলায় পরিণত হয়। তিন তলা ভবন নির্মাণের পরও যতটুকু ফাঁকা জায়গা ছিল সেখানে ঢাকা ওয়াসার স্টাফ কোয়ার্টার গড়ে উঠে। আর তিন তলায় লায়ন্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ক্লাব ছাড়াও এ পার্কের জায়গায় ওয়াসার স্টাফ কোয়ার্টার করা হয়েছে। ভবনের নিচ তলায় ৪টি কেরামবোর্ডে খেলা চলে প্রতি দিন। এভাবেই নারিন্দাবাসীর চোখের সামনে পার্কের জায়গাটি দখলে চলে যায়। বর্তমানে পার্কের জায়গাটি উদ্ধার করার জন্য এলাকাবাসী স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ মেয়রের কাছে দাবি জানান।
পার্কের জায়গায় ভবন নির্মাণ করে ক্লাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আলো ইনকিলাবকে বলেন, পার্কের জায়গায় শুধু তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তাই নয়, এরসঙ্গে ওয়াসার স্টাফ কোয়ার্টার হয়েছে। এসব ঘরে ড্রাইভারদের ভাড়া দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির লোকজন। এখানে বাজে আড্ডা-আসর জমানো হয়। যেদিন থেকে পার্কের জায়গায় ক্লাব সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকেই এখানকার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।
এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হোসেন মোহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, ক্লাবের সামনে এলে আজও শৈশবের স্মৃতি মনে ভেসে উঠে। পার্কে বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন চলতো নানা রকম বিনোদন। এখন চলছে ক্লাবের নামে বাজে ছেলেদের রাজত্ব। তিনি বলেন, পার্কের সঙ্গে বন্দি হয়ে আছে আমার জীবনের শৈশব স্মৃতি। তখন এলাকা ছেড়ে বন্ধুরা দূরে খেলতে যেতে ভয় পেতাম। এই পার্কে কেটে গেছে জীবনের শৈশব কাল।
ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলেন হোসেন মোহাম্মদ। কান্নামাখা চোখেই বলতে থাকেন, সেই পার্কটি এখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই। হঠাৎ করে পার্কের জায়গা দখল করে ক্লাব তৈরি করা হয়। এলাকার শিশু কিশোররা যখন রাস্তার উপর ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলে তখন আমার ছোটোবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়ে। আমরা যখন-তখন পার্কে খেলতাম এখন শিশুরা রাস্তায় খেলে। ক্লাবটি ভেঙে পার্কের জায়গা উদ্ধারের দাবি জানান তিনি।
নারিন্দা এলাকার জাফর আহম্মদন নামে এক শিক্ষক বলেন, স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখন খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মনে ইচ্ছা থাকলেও খেলতে পারে না। অসহায় অভিভাবক হিসেবে এটি আমার কাছে বড়ই লজ্জার। আমার একটি ১০ বছরের নাতি রয়েছে। সে স্কুলে যায় আর বাসায় এসে টিভি দেখে। ফাঁকা জায়গা না থাকায় বাইরে খেলার সুযোগ পায় না। আর আমার একারপক্ষে জুনিয়র লায়ন্স ক্লাবটি ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। যদি তা থাকতো তাহলে আমি নিজেই ক্লাবটি ভেঙ্গে আবার শিশুদের এই খেলার ও বিনোদনের জায়গাটি ফিরিয়ে দিতাম।
সংস্কৃতিকর্মী রাফিয়া জামান মুন্নি বলেন, পার্কের জায়গায় ভবন নির্মাণ করে ক্লাব তৈরি করে বিনোদনের মাধ্যম করা হলেও পার্কের আনন্দ কিন্তু পার্কের মধ্যেই। এই সংস্কৃতিকর্মীর মতে, শৈশবে ছেলে মেয়েরা খেলার সুযোগ না পাওয়ায় মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। খেলবেই বা কোথায় পুরান ঢাকার অধিকাংশ মাঠ ও পার্কের জায়গা দখল করেছে প্রভাবশালীরা। বাবা-মা তাদের সন্তানদের বাইরে যেতে দেয় না, ঘরের মধ্যেই বাধ্য করে টিভি দেখতে। এতে শিশুদের মস্তিষ্কে সুষ্ঠু চিন্তার ব্যত্যয় ঘটে। পার্কের জায়গায় যারা ভবন তৈরি করে ক্লাব নির্মাণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ভয়ে মুখ খুলতে চান না। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ