বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মর্জিনা আফসার রোজী
ছয় ঋতুর এই অঞ্চলে বৈশাখ মাসটি আসে বাঙালিদের জীবনে এক অনাবিল আনন্দ আর পুলক নিয়ে। ‘পহেলা বৈশাখ’ এর সাথে ভেসে আসে আরো কিছু মিষ্টি মধুর কথার রেশ। বৈশাখী মেলা, আ¤্রকাননে মুকুলের সমাহার, বাঙালি রীতিনীতির পুনর্জাগরণ। সবকিছুই বড় আপন আর নিজস্ব নিখাঁদ খাঁটি অনুভূতি বলে মনে হয়। সে আকাক্সক্ষা থেকেই গিয়েছিলাম জাতীয় বৈশাখী মেলায়। বিসিক আয়োজিত এ মেলাটি অতীতে নব উদ্যমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বাংলাদেশি বাঙালিদের অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্ত করার এক প্রচেষ্টা ছিল বলা চলে। মানুষ তার শৈশব-কৈশোরের ¯িœগ্ধ কোমল আলোর ন্যায় সুখ-ভোগকে আজীবন হৃদয়ে সঞ্চয় করে রেখে তার পরশ পেতে চায়, মানুষের বয়স যত বেশি পেরিয়ে যায় তত বেশি পেছনে তাকায়, খুঁজে ফিরে হারানো প্রশান্তি মমতায় ভরা সম্পর্কগুলোকে। সে চেতনার কেন্দ্রবিন্দু থেকেই কিশোরী মেয়েকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম বৈশাখী মেলায়। এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্যে এটাও ছিল, এ প্রজন্মকে বাঙালিয়ত্বের মধুর রসে সিক্ত করে দেয়া। নিজস্ব আচার-পার্বণের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করা। আমাদেরও যে গর্ব করার মতো কিছু রয়েছে; যেখানে মাটির ঘ্রাণের সাথে হৃদয়ের বন্ধন রয়েছে। সে অনুভূতির যথার্থতা বোঝাতে।
বেশ কয়েক বছর আগে এ মেলাটি হতো কলাবাগান মাঠে। প্রথম দিন থেকে সাত দিন চলত মেলাটি। প্রচুর ভিড় হতো, ঠেলাঠেলি করে হাঁটতে হতো। অনেকে আবার পহেলা বৈশাখের দিনটিকে পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করার জন্য সকালে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান শেষ করে একটু মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরেফিরে বিকালে কলাবাগান মাঠের মেলা ঘুরে একেবারে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরত। আমি নিজেও এমনটি করেছি। স্বকীয় এ আনন্দের অনুভূতির বর্ণনা দেওয়া কঠিন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সেই গানের প্রথম কয়েকটি লাইন, যা ছোট-বড় সবারই মুখস্থÑ ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ মিউজিক বাজতে থাকে। বেলুন বাঁশির চেনা আওয়াজ, ছোট ছোট ঢোল, কাচের চুরির ঝনঝনানী, চারদিকে উজ্জ্বল রঙিন কাপড় পরিধান করা শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণীদের সমাগম। সব কিছুর মধ্যেই সুস্থ বিনোদনের ছোঁয়া ছিল। মনের মধ্যে এক অহংকারের সুর জেগে ওঠে, এই আমার দেশ, এ আমার নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টিÑএ সুখানুভূতি একান্তই আমার। আপন মায়ার উপলব্ধিতে হৃদয় মন ছেয়ে যেত। আনন্দে মেতে ওঠা প্রতিটি জনকেই মনে হতো কত না চেনা, ভীষণ কাছের।
আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার দহন হয়েছে সেদিন, যেদিন ২০১৬ সালের বৈশাখী মেলায় গেলাম। গেইট দিয়ে ঢুকতেই দ্বিধার পাহাড় এসে বাদ সাধল। বারবার মন বলছিল, এ নয় সে অতীতের মেলা প্রাঙ্গণ, এ যে বড্ড অচেনা, একেবারেই নিরস-বদন। আন্তরিকতা আর মমতার মাধুর্যতা নেই কোথাও। পুরোটাই কৃত্রিমতায় আবৃত। সর্বস্থানে দৃষ্টি দিয়ে এটাই মনে হচ্ছিল যে, নিজস্ব এ বাঙালিয়ত্বকে ধরে রাখতে কেউ যেন আর চায় না। মনে হচ্ছে এটুকু আয়োজনও না পারতেই করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কেমন দায়বদ্ধতা, ভালোবাসার প্রতিদান কোথায় উড়ে গেল। নিজের সাথে, নিজের সংস্কৃতির সাথে কেন এই বিশ্বাসঘাতকতা। কেন এ দৈন্যতা। যা কিছু প্রবাহিত সেটাই তো গর্ব করার মতো বিষয়। ধার করা, চুরি করা, দানে পাওয়া কোনো প্রাপ্তিতেই সম্মান ও আনন্দ নেই। কেন আমরা নিজের সাথেই নিজেরাই প্রতারণা করছি। এ কিসের আলামত। তবে কি জাতীয়ভাবেই আমরা মানবতা-বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফানুস আকৃতি ধারণ করে চলেছি। সেদিন বড্ডই লজ্জিত হয়ে ছিলাম কিশোরী কন্যার নিকট। যত গর্ব অহংকার আর সমৃদ্ধির কথা বলেছি সবই অনুপস্থিত, বিলুপ্ত। মনের মধ্যে লুকায়িত একটি গুপ্ত বাসনা ছিল যে, সে বলবেÑবেশ ভালো লেগেছে, সত্যিই জাতীয় সংস্কৃতিতে আমরা দরিদ্র নই। কিন্তু সেটা শুনতে পাইনি।
সেখানে স্টল ছিল খুবই যৎসামান্য। নাগোর দোলাটি জরাজীর্ণ হয়ে কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। মৃত্তিকার তৈজসপত্রের একটি দোকানও নেই, পিতল কাঁসার মাত্র একটি তাও গুটিকয়েক জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে। সব খানেইই দৈন্যতার ছাপ। বাঁশ-বেত আর কাঠের দোকানেরও অবস্থা করুণ। কামার-কুমার, তাঁতী বুননকারীদের অবস্থান একেবারেই ছিল না। সেই সাথে দেশীয় ফলের জোগান নেইÑঅথচ কাঁচা আম, তেঁতুল, বেতফল, বৈচী ফল, অরবড়ই, আমলকী ইত্যাদির সমাহার থাকত পূর্বেকার আয়োজনে। এখন তা কেবলি স্মৃতি। বেদিনী শাপুড়ে, বাদড়-নাচ বায়োস্কোপ ইত্যাদি গ্রামবাংলার বিনোদনের উপকরণেরও উপস্থিতি ছিল না। যদিও বা আধুনিকতার উৎকর্ষের সাথে সাথে এগুলো তাদের প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে তথাপিও এর নমুনার চর্চা আর বিশেষ দিনে এর উপস্থিতি দিনটিকে মাহিমান্বিত করে রাখতে পারত। নিজেদের নিঃস্ব করে উপস্থাপন করার মধ্যে কোনো মহত্ব নেই।
আধুনিক যুগের সন্তানরাও পূর্বসূরিদের সোনালি অতীতকে বেঁধে রাখতে চায়। তাদের মনেও দৃপ্ত বাসনা, হারানো পরশ পাথরের স্পর্শে নিজেকে মূল্যবান করে গড়ে তোলার। প্রচলিত রীতিনীতি সংস্কৃতি পার্বণকে মমতার সঙ্গে বুকে লালন করেও প্রবাহিত সময়ের জয় গান গাওয়া যায়। বিশেষ করে নিজেদের পরিচিতি, নিজস্ব ঢং, নিজেদের উৎসবÑ এ সবই জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। এ থেকে বিচ্যুত হওয়া অথবা একে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব কিংবা মহত্ব নেই। ব্রিটিশ কালচারে মিশে আছে পুরান-নতুনের সমাহার। তারা পুরাতনকে যেভাবে সসম্মানে রেখেছে, তেমনি নতুনকেও সাদরে গ্রহণ করেছে। আমাদের ভাষা, রীতিনীতি, পোশাক-পরিচ্ছেদ, সামাজিকতা সবই যৌথ এবং একক উপকরণের দাবিদার। তাই যতটুকু সম্ভব নিজেকে চেনা-জানা নিজের আঙ্গিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখা, নিজের আনন্দ-অভিলাষের বিস্তার ঘটানো, প্রভাবিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তাতে মন প্রশান্তিময় হয়। যত উষ্ণতাই থাকুক না কেন হৃদয়ের অন্তিম বাসনাÑতা কখনই ধার করা বা চুরি করা সংস্কৃতি দ্বারা পূরণ হয় না।
যা কিছু হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংরক্ষণের ঝুড়ি থেকে, আমাদের কথা ও কাজের মধ্য থেকে যারা সরে যাচ্ছেÑএ অভিমানিদের আদর করে কাছে টেনে নিয়ে স্থাপন করতে হবে। সামাজিক-পারিবারিক জীবনের সর্বত্র। তবেই না এ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সুদীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে। আমি হারাতে চাই না বাঁশের বাঁশির সুমিষ্ট সুর, কোকিলের কুহুতান, বাউল গান, মারফতি, ভাটিয়ালীর মন পাগল করা সুরের সুধা। আমি বিচ্যুত হতে চাই না গ্রামবাংলার আবহ সংস্কৃতির ভা-ার হতে। এ-যে আমার বাঙালি হওয়ার গৌরবগাথা কথামালা।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।