দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ছাফওয়ান তালুকদার
যুগে যুগে এমন কিছু পীর, মাশায়েখ, আলেম, মুর্শিদ ও মুজাদ্দেদের আবির্ভাব ঘটে, যাদের ক্ষুরধার লেখনী, অনলবর্ষী ওয়াজ-নসিহত, দিবালোকের মতো স্বচ্ছ চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতা, দ্বীন-ইসলামের সঠিক দিকনির্দেশনা, কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার, অলিক ধ্যান-ধারণার বেড়াজাল ছিন্ন করে তৌহিদ ও রেসালাতের সঠিক বিশ্বাস ও আকিদায় জনগণের হৃদয়কে আলোকিত ও চরিত্রকে পুলকিত করে এবং ইহকাল ও পরকালে গৌরবান্বিত করে, এমন একজন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মোজাদ্দেদ, মোহাদ্দিস, হাফেজে কোরআন, কামেল ও মোকাম্মল মুর্শিদ হচ্ছেন আমাদের সকলের পরম শ্রদ্ধেয় মুর্শিদ কেবলা, আওলিয়াকুল স¤্রাট, বেলায়েতে মহান সূর্য, ওস্তাদুল ওলামা, হযরতুল আল্লামা ছৈয়দ ছাইফুর রহমান নিজামী (মঃজিঃআঃ)। মহান মুর্শিদ কেবলা ১৯১৫ইং সাল মোতাবেক ১৩৩৬ হিজরি পবিত্র রমজান মাসের কদরের রাত্রিতে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত মিরসরাই উপজেলার উত্তর ইছাখালী গ্রামে এক মহাসম্ভ্রান্ত অলি পরিবারে শুভাগমন করেন। তার মাতা সৈয়দ আশরাফুন্নেছা প্রতাবশালী ঐতিহ্যবাহী ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা ছিলেন। তিনি তার পিতার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী এবং প্রধান খলিফা। তিনি তার বাবাজান কেবলার লিল্লাহ হাফেজিয়া মাদ্রাসা হতে মাত্র ১০ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন হেফজ করেন এবং নামাজের মাধ্যমে ও সাধারণ তিলাওয়াতে ১০১ খতম পবিত্র কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করে তার বাবাকে শুনান। নাহু, ছরফ, তফছির, কোরআন, হাদিস শরিফ, ফিকাহ ও ফারসি আদব ইত্যাদি দাদাপীর থেকে শিখেন। পরে তিনি ছুফিয়া নুরিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে দাখিল, আলিম, ফাজিল পাস করেন। ১৯৬০ইং সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বোর্ডের পরীক্ষায় কামিল হাদিস শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন।
১৯৬২-৬৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ষোলশহর জামেয়া রহমানিয়া আহমদিয়া ছুন্নিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিছ হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র পাথরঘাটায় অবস্থিত সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও ১ম মোহাদ্দেস হিসাবে বোখারি শরিফ পড়ান। দেশে-বিদেশে বহু আলেম, মুহাদ্দিস তার ছাত্র হিসেবে গর্ববোধ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আঞ্জুমানে ইখওয়ানে মারেফাত (আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃসংঘ) নামে একটি মানব সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি ১৯৭৫ সালে তার পীর, ওস্তাদদের স্মরণে মিরসরাইয়ের মস্তাননগরে একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তার অগণিত মুরিদ ও ভক্তদের সহায়তায় শাহ গোলাম রহমান এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত কিছু সরকারি সাহায্যে বহু এতিম-দুঃখী স্বাবলম্বী হয়ে দেশে-বিদেশে বহু খ্যাতি অর্জন করেছে। ১৯৮৯ সালে তিনি মিরসরাই মস্তাননগর জামেয়া রহমানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা (¯œাতক পর্যায়ের) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে প্রায় ২৭ জন অভিজ্ঞ শিক্ষকম-লীর মাধ্যমে আরবি সাহিত্য, পবিত্র কোরআন, হাদিস শরিফ, ফিকাহ, ইংরেজি, বাংলা ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদি দেয়া হয়। এখানে প্রায় ৫০০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করে, যাদের মধ্যে শতাধিক বোর্ডিংয়ে থাকে। তাছাড়া এতিম, গরিব, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রি পড়ানোসহ অন্যান্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব তার নিজস্ব বাজেটে কারিগরি শিক্ষার জন্য ২,১০,০০০/- (দুই লক্ষ দশ হাজার) অনুদান দিলে এর দ্বারা বারআওলিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়। এতিমখানার পাশে বায়তুল রহমান জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা ও মসজিদের পাশে একটি কবরস্থানও করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রদ্ধেয় বাবাজান কেবলা আড়াই একর জমি অনুদান দেন। তার বাড়ি হাজীপাড়া, আগ্রাবাদ প্রাঙ্গণে পবিত্র রহমানী দরবার শরিফ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রত্যেক চন্দ্রমাসের ২য় বৃহস্পতিবার তরিকতের শিক্ষা, মিলাদ, খতম, জিকির আজকার, ছালাতু-ছালাম ও দোয়া-মুনাজাত হয়। দেশবরেণ্য প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, মোফাসসের, পীর-মাশায়েখগণ এখানে অংশগ্রহণ করেন এবং পবিত্র কোরআন-হাদিস শরিফ সম্মত ওয়াজ-নসিহত করেন। তিনি অতিশয় পরোপকারী সদা-সর্বদা মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের ধ্যানে মক্ত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কাউকে কাফের বলেন না। অনেক মুসলমান, অমুসলমান তার পবিত্র সংস্পর্শে এসে আলোকিত জীবন (তাওহীদভিত্তিক ও রেসালতকেন্দ্রিক জীবন) তথা পবিত্র কালেমার জীবনের সন্ধান পেয়েছে।
তিনি সত্যবাদী, ওয়াদা পালনকারী, পরমতসহিষ্ণু, ন্যায়পরায়ণ, অতিব দয়ালু, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা থেকে মুক্ত, শিষ্টভাষী, মিশুক, অতিব দয়ালু এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তার জ্ঞান ব্যক্তিত্বের কারণে ১৯৮৩ সালে সর্বসম্মতিক্রমে আহলুছ ছুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। সভা-সমিতি, মিলাদ-মাহফিল ইত্যাদিতে তার অতুলনীয় জ্ঞানের প্রকাশ পাওয়া যায়। তিনি আহলুছ ছুন্নাত ওয়াল জামাতের খেদমতে মানুষকে সত্য (ঈমান) সহজে বোঝার জন্য আলোকিত জীবনের অধিকারী হওয়ার জন্য সর্বোপরি মুসলমান পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়ে এক কলেমার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে বদর-উহুদ-কারবালার সৈনিক হয়ে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে ইহকাল ও পরকালীন মুক্তির জন্য অনেক পুস্তক রচনা করেছেন। তিনি মানুষকে সত্য সুন্দর জীবনের রূপরেখা প্রদানের লক্ষ্যে ‘মাসিক আসল পথ’ নামে একটি পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২৩বার পবিত্র হজ পালন করেছেন। তিনি তার পীরের (আমাদের দাদাপীর হযরত ছৈয়দ শাহ গোলাম রহমান এছমতি রাহমাতুল্লাহে আলাইহি) খেলাফত লাভের পর, স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পীরানে পীর হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী এবং হযরত খাজা বাবা শাহনশাহ মঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরী গরীব নাওয়াজ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে রূহানী খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার নিকটও অনেক আশেক মুরিদ করার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছেন।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে তিনি মুরিদ করেননি। আহলুছ ছুন্নাত ওয়াল জামাতের শরীয়তসম্মতভাবে তার কাছে বায়াত (মুরিদ হওয়া) গ্রহণ করেন। এখানে টাকা-পয়সার কোনো লেনদেন নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি মসজিদ-মাদ্রাসা, এতিমখানা তথা গরিব-দুঃখীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন (জোরপূর্বক নয়), ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ করেন। শরিয়তসম্মত চলার উপদেশ দেন। ওয়াজ নসিহতে বা কোথাও কখনো তিনি অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করেননি। পবিত্র কোরআন-ছুন্নার বাহিরে বৃথা বাক্যালাপ একদম পছন্দ করেন না। তিনি সদা সর্বদা অহংকার, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত থেকে মুক্ত থাকেন। তিনি ও তার স্ত্রী (আমাদের আম্মাজান কেবলা) মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য জমির অর্থসংস্থান করেন। তিনি পবিত্র কলেমার অঙ্গীকার পালনের উদ্দেশ্যে মানুষের কল্যাণ ও হেদায়াতের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ইরাক, কুয়েত, সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল সফর করেন। তিনি ছোটদের অতিশয় ¯েœহ ও আদর দেন এবং তার চোখে ধনী-গরিব সবাই সমান। তিনি তার ছেলেমেয়েদের সবাইকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার ৩ ছেলে এবং ২ মেয়ে। ছেলেমেয়েরা সবাই বিবাহিত এবং প্রতিষ্ঠিত। তারা সবাই বাহ্যিক শিক্ষা ও পবিত্র কোরআন ছুন্নাহর গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তিনি গদিনসিনে বিশ্বাসী নন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।