দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ফিরোজ আহমাদ
মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানী, ওস্তাদ-শিক্ষক-মোর্শেদ, চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফু, ছেলে-মেয়ে, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও ভক্ত-অনুরক্ত ইত্যাদি আমাদের আপনজন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যে বয়সের ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনজনের ধরন ও আকার পরিবর্তন হয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ বিয়েশাদি করলে কিংবা সন্তানাদি ভূমিষ্ঠ হলে আপনজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারো মৃত্যু হলে জাগতিকভাবে আপনজন সংখ্যা হ্রাস পায়। ক্ষেত্রবিশেষ রেডিও-টেলিভিশনের একজন শিল্পীও আপনজন হয়ে যায়। একজন শিল্পীর মৃত্যুতে ভক্তের হৃদয়ে শূন্যতা বিরাজ করে। নিজের অজানাতে চোখের মণি কোঠায় শিল্পীর জন্য পানি চলে আসে। ভক্তদের কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলেন। অথচ ওই শিল্পীর সাথে ভক্তের রক্তধারার কোনো পরিচয় সম্পর্ক নেই। সহকর্মী বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যু হলে তার স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে খেলাধুলার টুর্নামেন্ট ছাড়া হয়। মেমোরিয়াল সংসদ কিংবা ট্রাস্ট গঠন করা হয়। বিয়েশাদি আচার-অনুষ্ঠান জ¤œদিন ইত্যাদিতে আমরা আপনজনদের দাওয়াত করি। পবিত্র কোরআনে আপনজনের প্রতি অনেক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোরআন শরিফে আপনজনের স্মরণে প্রায় অর্ধশতাধিক আয়াত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে হাবিব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত ইব্রাহিমকে’। (সূরা মরিয়ম, আয়াত-৪১)। ‘হে হাবিব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত মূসাকে’। (সূরা মরিয়ম, আয়াত-৫১)। ‘হে হাবিব! আপনি কিতাবে স্মরণ করুন মরিয়মকে’। (সূরা মরিয়ম, আয়াত-১৬)। ‘হে হাবিব! আপনি আপনার উম্মতদেরকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে উপদেশ দিন’। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত-৫)। একজন নবী (আ.) পূর্ববর্তীর নবী (আ.)-এর উত্তরাধিকারী। এ জন্য কোরআনে নবী (আ.)-এর মধ্যে পার্থক্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। কলেমা মুফাচ্ছালে বলা হয়েছে ‘ওয়া রসুলিহি’। অর্থ : সকল রাসূল গণের ওপর। ঈমানের একটি অংশ হলো সকল নবী (আ.)-এর ওপর ঈমান আনা। কোরআনের ভাষা অনুযায়ী এক মুমিন অপর মুমিন বান্দার আপনজন। উম্মতের আপনজন হলেন নবী (সা.)। নিজ পরিবার-পরিজনের চেয়ে নবী (সা.) আমাদের নিকট অধিক আপনজন। আমাদের আত্মীয়তা হবে প্রিয় নবী (সা.)-এর সাথে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজের চেয়েও বেশি প্রিয় এবং নবীর স্ত্রীরা হচ্ছেন তাদের (উম্মতের) মাতা; আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আত্মীয়স্বজন (তারা) সব মুমিন মুহাজির ব্যক্তির চেয়ে একজন আরেকজনের বেশি নিকটতর’। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৬)। পূর্ববতী আপনজনের আমল আখলাক স্মরণ করার মাধ্যমে ঈমান আখলাক দৃঢ় হয়। মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার নিকট পূর্ববর্তী যুগের রাসূলগণের যা ঘটনা বর্ণনা করেছি তা আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য’। (সূরা হুদ, আয়াত-১২০)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় তাদের ঘটনাসমূহে রয়েছে তোমাদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ’। (সূরা ইউসুফ, আয়াত-১১১)। কোরআনে আপনজনের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়তার হক বিনষ্ট করা হতেও (বিরত থাক) আল্লাহকে ভয় কর’। (সূরা নিসা, আয়াত : ১)। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ আমাদের কারো মৃত্যু হলে পড়ি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়্যুন’। অর্থ : নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আমরা তাহারই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৫৬)। আপজনের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি পরিবার-পরিজনদেরকে নামাজের আদেশ দিতে থাকুন এবং নিজেও এর প্রতি যতœবান হোন। (সূরা ত্বা-হা, আয়াত : ১৩২)।
আজকাল আপনজনের স্মরণে দোয়া মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করলে বিদায়াত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। খোশরোজ কিংবা জ¤œদিনের আয়োজন করলে বাধা প্রদান করা হয়। পবিত্র কোরআনে হযরত ইয়াহয়া (আ.)-এর শুভ জন্ম ও বেচাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, এবং তার প্রতি সালাম বা শান্তি- যে দিন (হযরত ইয়াহয়া (আ.) জন্মগ্রহণ করেছেন, যে দিন তিনি ওফাত পাবেন এবং যে দিন তিনি পুনর্জীবিত হবেন। (সূরা মরিয়াম, আয়াত-১৫)। হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং আমার প্রতি সালাম ও শান্তি- যে দিন আমি জ¤œগ্রহণ করেছি, যে দিন আমি ওফাত পাব এবং যে দিন আমি পুনর্জীবিত হব। (সূরা মরিয়ম, আয়াত-৩৩)। কোরআন একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। কোরআনের ভিতরে আমরা প্রবেশ করতে চাই না। শুধুমাত্র তেলোয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখি। আপনজন সম্পর্কিত ফেতনা-ফেসাদ থেকে বেঁচে থাকার উপায় হলো কোরআন আরবিতে পাঠ করার পাশাপাশি কোরআনের অর্থ মাতৃভাষায় অনুশীলন করা। যারা রাসূল (সা.)-কে আপনজন করবেন তাদের সবাইকে রসুল (সা.) সুন্নত পালনের প্রতি উদ্ধুদ্ধ হবে। মায়ের গর্ভে জন্মেছি বলে পিতার পরিচয় এবং বংশ পরিচয় জানার চেষ্টা করি। মুসলিম হিসেবেও নিজের পরিচয় ও অবস্থান জানা প্রয়োজন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা চয়ন করে নিয়েছেন হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহিমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সারা বিশ্ববাসীর মধ্য থেকে’। (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৩৩)। তারা হলেন ওই পরম সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যাদেরকে আল্লাহতায়ালা সঠিক পথের ওপর অধিষ্ঠিত রেখেছেন। সুতরাং তোমরাও তাদের সেই সঠিক পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম, আয়াত-৯০)। আপনজনের অনন্য উদাহরণ হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.)। বায়তুল্লাহ শরিফের পাশে হচ্ছে মক্বামে ইব্রাহিম। তা হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ। ছাফা ও মারওয়া হলো সেই স্থান যে দুই পাহাড়ে মা হাজেরা (আ.) তাঁর শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর জন্য পানির সন্ধানে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। জমজম কূপ হলো সেই স্থান যা হযরত ইসমাঈল (আ.) পদাঘাতে তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর সকল স্থানের পানি বসে পান করতে হয় শুধুমাত্র জমজম কূপের পানি দাঁড়িয়ে পান করতে হয়। হজের সময় হাজীদেরকে জামারায় গিয়ে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। কারণ হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার পথে এই স্থানে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে শয়তান প্রলোভিত করার চেষ্টা করেছিল। আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের লক্ষ্যে সেদিন হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং ইব্রাহিম (আ.) যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে ত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন আজ তারই নাম হলো কোরবানি। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০১-১৮)। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।