Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ জয় করেন

খালেদ সাইফুলাহ সিদ্দিক | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:১০ এএম

বিশ্ব ইতিহাসে বিস্ময়কর অদ্ভুত ঘটনার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। রণাঙ্গন-যুদ্ধ ক্ষেত্রে অসাধারণ-অপূর্ব বিজয় বা শোচনীয় পরাজয়ের অসংখ্য নজির রয়েছে। এমনকি রণাঙ্গনে শত্রু পক্ষের লাখ লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটানোর উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু এইরূপ কোনো ঘটনা ইতিহাসের দেখা যাবে যে, মাত্র ১৮ জন সৈন্যের অতি ক্ষুদ্র একটি দল একটি দেশ জয় করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এটি সম্ভব করেছেন একজন মুসলিম সেনানায়ক বখতিয়ার খিলজী। মাত্র ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি বঙ্গ জয় করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
উপমহাদেশের ইসলামী ইতিহাসে মোহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজী এমন এক অসাধারণ বীরপুরুষ, যিনি মাত্র ২০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে প্রথমে বিহার আক্রমণ করেন এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গোটা এলাকা অধিকার করেন। কুতুবুদ্দিন আইবেক তখনো বাদশাহ হননি। তিনি ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ ঘোরীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নায়েব।
মোহাম্মদ ইবনে বখতিয়ারের এ বিজয়ের সংবাদে আনন্দিত হয়ে আইবেক তাকে উচ্চ মর্যাদা ও খেলাত প্রদান করেন এবং তাকে বিজিত এলাকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। অতঃপর তিনি বাহিনী প্রস্তুত করেন এবং বাংলার রাজা ল²ণ সেনের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হন। তার খ্যাতি আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি এত দ্রুত ও তীব্র গতিতে অগ্রসর হন যে, তার সমগ্র বাহিনী পেছনে থেকে য়ায়। তার সঙ্গে মাত্র ১৭ জন থেকে যায়।
এভাবে তিনি শহরে রাজার দুর্গে উপনীত হয়েই প্রহরীদের উপর আক্রমণ চালান এবং তার সৈন্যদের পৌঁছানোরও অপেক্ষা করলেন না। রাজা তখন আহার করছিলেন। বাইরে লোকদের হইচই ও চিৎকার শুনে তিনি বিচলিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েন এবং পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে ঢাকার সোনারগাঁয়ে পৌঁছে দম নেন। অল্প দিনের মধ্যেই বখতিয়ার খিলজী বিহারের মতো সমগ্র বাংলায় তার অধিকার ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বখতিয়ার খিলজীর জীবন ও বিজয় সম্পর্কে আরো বিবরণ রয়েছে যা কিছু নিন্মরূপ :
বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের সাথে জড়িত রয়েছে এ দেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তার বঙ্গ বিজয়ের সঠিক সন-তারিখ সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। ১২০০ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই চার বছরের মধ্যে কোন সালটি সঠিক তা যথাযথভাবে নির্ণীত না হলেও অনেকের মতে, ১২০২ সালে তিনি বঙ্গ জয় করেন।
অবশ্য একটি বর্ণনায় তার আসল নাম ছিল মোহাম্মদ। তার বাবার নাম বখতিয়ার এবং উপাধি ইখতিয়ার উদ্দীন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, তার পূর্ণ নাম বখতিয়ার খিলজী। তার জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা না গেলেও কারো কারো মতে, তিনি পার্বত্য এলাকা ঘোরের অধিবাসী ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি গজনীর পূর্ববতী কোনো একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দীর্ঘকায়, প্রশস্ত বক্ষ, দীর্ঘ হস্ত-পদবিশিষ্ট ছিলেন। বিশেষত, তার হাত এত দীর্ঘ ছিল যে, হাঁটুর নিচে পর্যন্ত পৌঁছত।
ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, যৌবনকালে তিনি গৃহত্যাগ করে গজনীতে আসেন এবং সেখানে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এটি ছিল সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরী নামে প্রসিদ্ধ মোয়েজুদ্দীন মোহাম্মদ সামের যুগ। সম্ভবত ভর্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বখতিয়ার খিলজী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে না পেরে বাধ্য হয়ে লাহোরে চলে আসেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থান করার পর দিল্লিতে চলে যান। সেখানেও তার কোনো কদর হলো না।
কিন্তু ঘটনাক্রমে মালিক মোওয়াজ্জাম হোসামুদ্দীনের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়, যিনি সে সময়কার আমীর-ওমারাহদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। দোআব এলাকার কয়েকটি পরগনা তার অধিকারে ছিল। তার অনুগ্রহে মোহাম্মদ বখতিয়ারও বদায়ুনের এলাকার কিছু ভূখণ্ড লাভ করেন। বদায়ুনে কিছুটা স্বস্তি লাভের পর তিনি তার শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। এ সময় বিজয়ধারা অব্যাহত থাকায় ঘোর ও গজনীর পারদর্শী যোদ্ধা বীরপুরুষ বেকার জীবন-যাপন করছিলেন।
মোহাম্মদ বখতিয়ার তাদের একটি দল সংগ্রহ করেন, তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০। তিনি মানি এলাকায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় লাভ করার পর তার বীরত্বের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কুতুবুদ্দীন আইবেক সুলতান মোয়েজুদ্দীন মোহাম্মদ সামের নায়েব হিসেবে হিন্দুস্তানের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি বখতিয়ারের কাছে বিশেষ পুরস্কার (খেলাত) ও পতাকা প্রেরণ করেন।
অতঃপর ১১৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহার জয় করেন। বখতিয়ার খিলজী হিন্দুস্তানে আগমনের পর ১০-১১ বছরের মধ্যে বহু বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেন। তিনি ছিলেন তরবারি পরিচালনার সাথে শাসনকার্য পরিচালনায়ও একজন সুদক্ষ। বঙ্গ বিজয়ের উদ্দেশ্যে তিনি সম্ভবত সিকিমের পথে তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন এবং এ সময় তার সৈন্য সংখ্যা ছিল ১২ হাজার।
কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ সামগ্রী না থাকায় এবং রাস্তায় নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা থাকায়; উপরন্ত শীতকাল হওয়ায় তার অগ্রযাত্রা থেমে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে তিনি পিছু হটে যান এবং তার বাহিনীর লোকেরা পার্বত্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। বলা হয়ে থাকে, বঙ্গের সীমান্তের নিকবর্তী একটি নদীতে একজন ঘোড়সওয়ার তার ঘোড়া ধাবিত করেন এবং বেশ দূর পর্যন্ত চলে যান। বখতিয়ার ও তার সঙ্গীরা ভেবেছিলেন, নদীতে পানি বেশি হবে না। তাই তারা সবাই নদীতে ঘোড়াগুলো ধাবিত করেন। কিন্তু নদী ছিল অত্যন্ত গভীর।
বখতিয়ার ও তার প্রায় চার-পাঁচ শ’ সৈন্য কোনো রকমে প্রাণ রক্ষা করত: তীরে উঠতে সক্ষম হন এবং অবশিষ্ট সকলেই ডুবে মারা যান। নদীর অপর তীরে দেবকোটের বসতি ছিল। সেখানে উপনীত হওয়ার পর বখতিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। কোনো কোনো লেখকের ধারণা, আলী মর্দান খিলজী নামক তার অধীনস্থ এক আমীর অসুস্থ অবস্থায় বখতিয়ারকে হত্যা করে। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে। সুলতান মোয়েজুদ্দীন সামও বখতিয়ারের ওফাতের কিছুদিন আগে শাহাদত বরণ করেছিলেন।
উল্লেখ্য, বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ বিজয়ের দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে বঙ্গের রাজধানী নদীয়ায় পৌঁছেন। তখন তার সঙ্গে মাত্র ১৭ জন সৈন্য ছিল, তারা সবাই ছিলেন ঘোড়সওয়ার। বখতিয়ার খিলজীর আকস্মিক আক্রমণে চকের নিকটবর্তী বৃদ্ধ রাজা ল²ণ সেনের প্রাসাদে হইচই শুরু হলে দুপুরের আহাররত রাজা পেছন দ্বার দিয়ে সোনারগাঁয়ে পালিয়ে যান।
আর এভাবে ১৮ ব্যক্তি কর্তৃক নদীয়া অধিকৃত হয়। কিছু দিনের মধ্যে বঙ্গের অন্যান্য এলাকাও বিজিত হয় এবং নদীয়ার পরিবর্তে লাখনুতিকে অধিকৃত এলাকার সদর মোকাম করা হয়। বর্ণিত বিবরণের আলোকে দৃঢ়ভাবে বলা যায়, তৎকালীন বাঙ্গলা বা বঙ্গদেশের রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের প্রচার বিস্তারের ক্ষেত্রে বখতিয়ার খিলজীর অতুলনীয় অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।



 

Show all comments
  • আন্দালিব ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫০ এএম says : 0
    যে সকল ব্যক্তি তাদের বীরত্ব, কর্ম দক্ষতা আর সাহসের জন্য আজো পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি অন্যতম। তিনিই বাংলা বিজয়ের প্রথম নায়ক।
    Total Reply(0) Reply
  • Zulfiqar Ahmed ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫১ এএম says : 0
    বখতিয়ার খিলজি তার অবদানের জন্য বাংলার মানুষদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন শত শত বছর। তার কাছে বাংলার জনগণ বিশেষভাবে ঋণী। তিনি উদ্যোগী হয়ে সেন রাজাকে পরাজিত করে বাংলাকে স্বাধীন না করলে এ জাতির ভাগ্যে আরো কত যে দুর্গতি ছিল তা আল্লাহপাকই জানেন। তার এ অপোরশোধিত ঋণ শোধ করার জন্য আমাদের উচিত এ বীর পুরুষটির জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
    Total Reply(0) Reply
  • তাসলিমা বেগম ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫১ এএম says : 0
    কয়েক হাজার অক্ষরের বিন্যাসে লেখা ইতিহাসের বইটা যতটা নীরস লাগে, মূল ইতিহাস কিন্তু ততোটা রসহীন হয় না। প্রতিটি ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকে অজস্র উত্থান-পতন, রক্তপাত, দুর্বিষহ বাস্তবতা। “বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন”- ইতিহাসের বইয়ের এই লাইনটি নিশ্চয় সবার ঝাড়া মুখস্ত রয়েছে? যদিও এর আগের বা পরের কোনো কিছুই আমাদের ঠিকমতো জানা নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Kawsar Raiyan ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫১ এএম says : 0
    বর্তমানে বাংলাদেশের যে অবস্থা সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আল্লাহপাক বাংলার বুকে যেন আরেকজন বখতিয়ার খিলজিকে পাঠান। দেশের সর্বত্রই এখন ধ্বনিত হচ্ছে মজলুম মানুষদের আত্মচিৎকার।
    Total Reply(0) Reply
  • Nur Alam ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৩ এএম says : 0
    মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে বঙ্গদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মধ্য দিয়েই এ দেশে এক নবযুগের সূচনা হয়। এ বিজয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গদেশে প্রাচীন যুগের অবসান এবং মধ্যযুগের আরম্ভ হয়। অন্য কথায় হিন্দুযুগের অবসান ঘটিয়ে বখতিয়ার খিলজি এদেশে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Bosir Ubbin ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৩ এএম says : 0
    পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল মহান ব্যক্তি তাদের মেধা, কর্মতৎপরতা, সাহস এবং দেশপ্রেমের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন বখতিয়ার খিলজি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাইতো এত বছর পরও আমরা বখতিয়ার খিলজিকে নিয়ে আলোচনা করছি। তার জীবনী পাঠ করছি। শিক্ষা নিচ্ছি। এখানেই মনে হয় বখতিয়ার খিলজির জীবন সার্থক হয়ে উঠেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Shaukaut ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ৯:৪১ এএম says : 0
    Deshe neta na thakar karone bangalike 4000 botshor porjonto poradhin thakte jhoeche golamer moto tai jatir pitake janai bishesh dhonnobad tono chirodin bangalir mone gethe thakben.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ জয়
আরও পড়ুন